নিজস্ব প্রতিবেদক :
ঝুঁকিতে পড়েছে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক ঋণ। তার পরিমাণ প্রায় ১ লাখ ৮৬ হাজার কোটি টাকা। মূলত করোনার কারণে ঋণের ব্যবহার ব্যাহত হওয়া এবং সাম্প্রতিক সময়ে ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমে যাওয়ার কারণে বেড়ে যাচ্ছে ঋণের অঙ্ক। পাশাপাশি যথাসময়ে ঋণ পরিশোধ না করায়ও বাড়ছে সুদের অঙ্ক। সব মিলিয়ে ওসব ঋণের বিপরীতে এখন বেশি সুদ ও ঋণ পরিশোধ করতে হবে। ওই কারণেই ঝুঁকির সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বৈদেশিক ঋণ নেওয়ার সময় এর ব্যবহার, তা থেকে প্রাপ্ত আয় ও ঋণ পরিশোধের বিষয়ে একটি আগাম হিসাব কষা হয়। কিন্তু ওই হিসাব এখন মিলছে না। হিসাবের তুলনায় আয় কম হয়েছে। কিন্তু ব্যয় হচ্ছে বেশি। কারণ ঋণের একটি বড় অংশই স্থানীয় মুদ্রায় আয় হবে এমন প্রকল্পে নেয়া হয়েছে। ফলে বাজার থেকে ডলার কিনে ওসব ঋণ শোধ করতে হবে। তাতে ডলারের ওপর চাপ আরো বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ফলে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও চাপে পড়বে। তাছাড়া বৈদেশিক ঋণ ও বকেয়া এলসি দেনা পরিশোধ করাতেও রিজার্ভের ওপর চাপ বেড়েছে। রিজার্ভ অক্টোবরে ৪ হাজার ৭০০ কোটি ডলারে উঠলেও এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ৫০০ কোটি ডলার।
সূত্র জানায়, করোনার কারণে ২০২০ সালে বৈদেশিক ঋণের ব্যবহার খুব কম হয়েছে। ২০২১ সালেও ওই খাতে ব্যবহার ছিল কম। কিন্তু ঋণের বিপরীতে ঠিকই সুদ হিসাব কষা হয়েছে। তাছাড়া ঋণের কিস্তি পরিশোধ স্থগিত করায় সুদ যোগ হয়ে ঋণের অঙ্ক বেড়েছে। স্থানীয় মুদ্রা আয়ের প্রকল্পগুলোর ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে বাজার থেকে ডলার কিনতে হবে। আগে প্রতি ডলার যেখানে কেনা যেত ৮৫ থেকে ৮৬ টাকায়। এখন তা কিনতে হচ্ছে ৮৭ থেকে ৮৮ টাকায়। প্রতি ডলারে প্রায় ২ টাকা বেশি গুনতে হচ্ছে। তাতে টাকার অঙ্কে ঋণ বেড়ে যাচ্ছে প্রায় ২ দশমিক ৩৫ শতাংশ। ফলে ঋণ নিয়ে যে টাকা পাওয়া গিয়েছিল এখন তার চেয়ে অনেক বেশি টাকা পরিশোধ করতে হচ্ছে।
সূত্র আরো জানায়, করোনার কারণে দেশের বৈদেশিক ঋণ বেড়েছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে বৈদেশিক ঋণ ছিল ১ হাজার ৬৯০ কোটি ডলার। গত অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ১৬৫ কোটি ডলারে। এক বছরে বৈদেশিক ঋণ বেড়েছে ২৮ দশমিক ১১ শতাংশ। ওই ঋণ গড়ে ৮ থেকে ১৫ শতাংশ বেড়েছে। আর করোনার সময়ে আগের ঋণের কিস্তি পরিশোধ না করার কারণে ঋণের অঙ্ক বেড়েছে। বৈদেশিক ঋণের মধ্যে স্বল্পমেয়াদি ঋণ সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। স্বল্পমেয়াদি ঋণ বেশি বাড়লে ঝুঁকি থাকে। কারণ সেগুলো দ্রুত পরিশোধ করতে হয়। সেজন্য বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহ করতে গিয়ে চাপে পড়তে হয়। আর ঝুঁকি কম থাকলেও দীর্ঘমেয়াদি ঋণ বেড়েছে কম। ওই ঋণ পরিশোধে দীর্ঘ সময় পাওয়া যায়।
সূত্র আরো জানায়, চলতি বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত বেসরকারি খাতে বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ১ হাজার ৮৬৯ কোটি ডলার। তার মধ্যে স্বল্পমেয়াদি ঋণ ১ হাজার ১৮০ কোটি ডলার এবং দীর্ঘমেয়াদি ৬৮৯ কোটি ডলার। আর সরকারি খাতে মোট ঋণের পরিমাণ ২৯৬ কোটি ডলার। তার মধ্যে স্বল্পমেয়াদি ঋণ ৪৪ কোটি ডলার এবং দীর্ঘমেয়াদি ঋণ ২৫২ কোটি ডলার। ২০১৯-২০ অর্থবছরে বেসরকারি খাতে বৈদেশিক ঋণ ছিল ১ হাজার ৪০৮ কোটি ডলার। তার মধ্যে স্বল্পমেয়াদি ঋণ ৮৭৩ কোটি ডলার এবং দীর্ঘমেয়াদি ঋণ ৫৩৫ কোটি ডলার। আর সরকারি খাতে মোট ঋণ ছিল ২৮২ কোটি ডলার। তার মধ্যে স্বল্পমেয়াদি ঋণ ২৫ কোটি ডলার এবং দীর্ঘমেয়াদি ঋণ ২৫৭ কোটি ডলার। মূলত সরকারি খাতের চেয়ে বেসরকারি খাতেই বৈদেশিক ঋণ বেশি বেড়েছে। স্বল্পমেয়াদি ঋণও বেসরকারি খাতে বেশি। ওই কারণে ঝুঁকির মাত্রাও বেশি। ২০১৯-২০ অর্থবছরের তুলনায় ২০২০-২১ অর্থবছরে বেসরকারি খাতে বৈদেশিক ঋণ বেড়েছে প্রায় ২০ শতাংশ। আর সরকারি খাতে বেড়েছে প্রায় ৫ শতাংশ।
এদিকে এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদদের মতে, বৈদেশিক ঋণ নিয়ে এর সঠিক ব্যবহার করতে পারলে ভালো। কিন্তু না পারলে পুরো অর্থনীতিতে চাপ সৃষ্টি করে। বৈদেশিক ঋণের ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কঠোর তদারকি থাকা দরকার। কারণ ঋণ পরিশোধের চাপটা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপরই আসবে। করোনার কারণে নীতিমালা অনেক শিথিল করা হয়েছে। ওই কারণে এখন চাপ বেড়েছে। বৈদেশিক মুদ্রা আয় হবে এমন প্রকল্পে বৈদেশিক ঋণ নিলে ঝুঁকি কম। কিন্তু বৈদেশিক মুদ্রা আয় না হলে ওসব ঋণে ঝুঁকি বেশি। দেশে যেসব বৈদেশিক ঋণ নেয়া হয়েছে তার খুব কম অংশ দিয়েই বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব।
অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন দায়িত্বশীর কর্মকর্তার মতে, বৈদেশিক ঋণে একসঙ্গে তিনটি ঝুঁকি এসেছে। তা হচ্ছে- করোনার কারণে ঋণের ব্যবহার কমে যাওয়া, ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন এবং করোনার কারণে হঠাৎ স্বল্পমেয়াদি ঋণ বেড়ে যাওয়া। সেগুলো মোকাবিলা করার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক কাজ করছে। একটি পরিশোধ সূচি তৈরি করা হয়েছে। ২০২৩ সাল পর্যন্ত একটু চাপে থেকে সেগুলো পরিশোধ করা হবে। তবে রিজার্ভ বেশি থাকায় দুশ্চিন্তার কারণ কম। কিন্তু রেমিট্যান্স কমে যাওয়া দুশ্চিন্তার সৃষ্টি করেছে। রেমিট্যান্স বাড়ানো গেলে সহজেই চাপ মোকাবিলা সম্ভব হবে।