নিজস্ব প্রতিবেদক :
দেশে কৃষি উপকরণের দাম বাড়ায় খাদ্যনিরাপত্তায় ঝুঁকি বাড়ছে। বর্তমানে বীজ, সারসহ সব কৃষি উপকরণের দামই ঊর্ধ্বমুখি। আর ওই বাড়তি খরচে কৃষি উৎপাদন কমে যাওয়ার আশঙ্কাও বাড়ছে। ইতোমধ্যে আমনের ক্ষতি কাটিয়ে বাড়তি খরচে বোরো আবাদ নিয়ে দুশ্চিন্তা দানা বাঁধছে। আমন ও বোরোর উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হলে দেশের খাদ্যনিরাপত্তা শঙ্কায় পড়বে। কৃষি খাত সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, গত আগস্টে আমন মৌসুমের শুরুতে ইউরিয়া সার এবং ডিজেলসহ সব জ¦ালানি তেলের দাম বেড়ে যায়। আর লোডশেডিংয়ের কারণে সেচ ব্যবস্থা ব্যাহত হয়। এমন পরিস্থিতিতেও বাড়তি খরচের বোঝা মাথায় ধান উৎপাদনে মাঠে নামে কৃষক। কিন্তু বয়ে যাওয়া ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং কৃষকের স্বপ্নে আঘাত হানে। ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং যে পথ দিয়ে গেছে সেখানেই ক্ষত চিহ্ন রেখে গেছে। দেশে খাদ্য সংকটের শঙ্কার মাঝে এমন বিপর্যয় বিপদ আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। পাশাপাশি স্বল্পসময়ের মধ্যেই বোরো ও রবি মৌসুম শুরু হচ্ছে। ওই মৌসুমেই দেশে খাদ্যশস্য সবচেয়ে বেশি উৎপাদন হয়। তখন সারসহ চাষাবাদে প্রয়োজনীয় উপকরণের চাহিদাও বেশি থাকে। কিন্তু বর্তমানে কৃষি উপকরণের উচ্চমূল্যে কৃষকের দিশেহারা অবস্থা।
সূত্র জানায়, এবারের আমন মৌসুমে বিরূপ প্রকৃতির মাঝেও ধান আবাদের লক্ষ্যমাত্রার শতভাগ অর্জিত হয়। এ বছর ৫৯ লাখ হেক্টর আমন আবাদ লক্ষ্যমাত্রা ছিল। কিন্তু ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ে সব মিলিয়ে আমন উৎপাদন বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সরেজমিন উইংয়ের তথ্যানুযায়ী মোট আবাদের ২ শতাংশ আমন ক্ষতিগ্রস্ত হলেও ওই সংখ্যা এক লাখ ৭৬০ হেক্টরে দাঁড়াবে। দেশের ৩১টি জেলার কৃষিতে ঘূর্ণিঝড়ের আঁচ লেগেছে। ওসব জেলার ৫৮ হাজার ৯০০ হেক্টর জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে খুলনায় ১১ হাজার ২৮৩ হেক্টর জমির ফসল। তবে বেসরকারিভাবে পাওয়া তথ্যানুযায়ী সিত্রাংয়ে ২ লাখ হেক্টরেরও বেশি কৃষিজমি কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
সূত্র আরো জানায়, কয়েকদিনের মধ্যেই দেশের সবচেয়ে বড় ফসল বোরো ধানের বীজতলা তৈরির কাজ শুরু হবে। সরকারি হিসাবে শুধু বোরো মৌসুমেই দেশে রাসায়নিক সারের বার্ষিক ব্যবহারের ৭০ শতাংশেরও বেশি হয়। একইভাবে সেচের ব্যবহারও বেশি হয়। কিন্তু সেচযন্ত্রের প্রধান জ¦ালানি ডিজেল ও সারের দাম বেড়ে যাওয়ায় এবার ধান উৎপাদন খরচও বাড়বে। ডিজেলের দাম বাড়ায় শুধু সেচের জন্য বোরোতে কৃষকের খরচ বাড়বে প্রায় দুই হাজার ৯১৪ কোটি টাকা। তার সঙ্গে সার, বীজসহ অন্যান্য উপকরণের দাম বাড়ার চাপও থাকঝে। ইতোমধ্যে ইউরিয়া সারের দাম কেজিপ্রতি ৬ টাকা বাড়ানো হয়েছে। আর চলতি মাস থেকে সব ধরনের বীজের দাম ২০-৩০ শতাংশ বেড়েছে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে ধানের উৎপাদন খরচ বাড়ার প্রভাব ভোক্তা পর্যায়ে পড়বে। তাছাড়া বোরো মৌসুমে সার সংকটেরও শঙ্কা রয়েছে। কারণ রাসায়নিক সারের চাহিদা পূরণের জন্য বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক বাজারের ওপর নির্ভরশীল। দেশে রাসায়নিক সারের বার্ষিক চাহিদা ৬০ লাখ টনেরও বেশি। তার প্রায় ৮০ শতাংশই আমদানি করতে হয়। তবে কৃষি মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বর্তমানে ৬ লাখ ৪১ হাজার টন ইউরিয়া সারের মজুত আছে।
এদিকে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা পূর্বাবাস দিয়েছে চলতি বছর ধান উৎপাদন কমবে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) চলতি মাসের প্রতিবেদনে বাংলাদেশের খাদ্য উৎপাদন পরিস্থিতির বিষয়ে প্রক্ষেপণ করা হয়। তাতে বলা হয়, বাংলাদেশের ধান, গম ও অন্যান্য দানাদার খাদ্যশস্যের উৎপাদন কমবে শূন্য দশমিক ৩ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি কমবে ধানের উৎপাদন। চলতি বছরও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে ৯ লাখ ১০ হাজার টন চাল আমদানির অনুমোদন দিয়েছে সরকার। সেজন্য চালের পর্যাপ্ত মজুত নিশ্চিতে আমদানিতে শুল্ক সাড়ে ৬২ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। তারপরও গত চার মাসে কাক্সিক্ষত পরিমাণ চাল আমদানি হয়নি। মূলত ভারতে চালের বাজার ঊর্ধ্বমুখী থাকা ও ডলারের বিনিময় হারের অস্থিতিশীলতার কারণে ব্যবসায়ীরা চাল আমদানিতে আগ্রহী হচ্ছে না। খাদ্য অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী ১ জুলাই থেকে ১৯ অক্টোবর পর্যন্ত বেসরকারিভাবে চাল আমদানি হয়েছে মাত্র ১ লাখ ৬১ হাজার ২৭০ টন। আর সরকারিভাবে চাল আমদানি হয়েছে সাড়ে ২৩ হাজার টন।
অন্যদিকে কৃষি বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতে এ মুহূর্তে সবজির চারা, বীজ, সারসহ অন্যান্য উপকরণ কৃষককে বিনামূল্যে দিতে হবে। বোরো মৌসুমেও সব রকম সহায়তা দিতে হবে। প্রয়োজনে অন্য খাতে বরাদ্দ কমিয়ে হলেও কৃষিতে প্রণোদনা বাড়াতে হবে। না হলে খাদ্য নিরাপত্তা বড় ঝুঁকিতে পড়তে পারে। কারণ দেশের ৬০ শতাংশ চাল বোরো থেকে আসে। যার পুরোটাই সেচনির্ভর। তাছাড়া সব মিলে ১৫ লাখ কৃষি যন্ত্রপাতি আছে, যার ৭৫ শতাংশই ডিজেলচালিত। ফলে ডিজেলসহ সব উপকরণের দাম কমানো জরুরি।
এ প্রসঙ্গে কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আবদুর রাজ্জাক জানান, কৃষি উৎপাদন বাড়াতে সরকার নানা পরিকল্পনা নিয়েছে। বোরো মৌসুমের ব্রি-২৮, ব্রি-২৯সহ আমন ও আউশ চাষের প্রচলিত জাতগুলোর প্রতিস্থাপন করে উচ্চফলনশীল ও হাইব্রিড জাতের চাষ বাড়িয়ে ২০২৪-২৫ সালের মধ্যে ধানের উৎপাদন প্রায় ৩২ লাখ টন বাড়ানো সম্ভব। রবি মৌসুমে আবাদ ও উৎপাদন বাড়াতে ১৩৭ কোটি টাকার প্রণোদনা দেয়া হচ্ছে। কৃষক সারে ভর্তুকি পাচ্ছে।