নিজস্ব প্রতিবেদক :
রাজধানীর কদমতলী থানার মাতুয়াইল মেডিকেলের পাশেই শামিমবাগ আবাসিক এলাকা। ওই এলাকায় আবদুস সালামের বাড়িতে ছয় মাস আগে পঞ্চম তলায় নতুন ভাড়াটিয়া আসেন। ওই ভাড়াটিয়ার সঙ্গে মাঝে মাঝে ওই বাসায় এসে থাকতেন তার ননদ সাফিয়া বেগমও। সেই ননদের সঙ্গে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে এশিয়ান এইজ পত্রিকার সার্কুলেশন ব্যবস্থাপক আশিকুল হক চৌধুরী ওরফে পিন্টুর প্রেমের সম্পর্ক হয়। কয়েক মাস ধরে এভাবেই চলছিল তাদের সম্পর্ক। গত ১ জুন সাফিয়ার ভাবী গ্রামের বাড়ি কুমিল্লা যান। সাফিয়াকে একাই রেখে যান বাসায়। এ সুযোগে ২ জুন পিন্টু মাঝরাতে সাফিয়ার সঙ্গে দেখা করতে আসেন। রাতে ওই বাসায় অবস্থান করেন পিন্টু। পরে সকালে কদমতলী থানা পুলিশ এসে পিন্টুর লাশ উদ্ধার করে। এ ঘটনায় পরেরদিন পিন্টুর ভাই অ্যাডভোকেট আরিফুল হক চৌধুরী কদমতলী থানায় পরিকল্পিতভাবে বিষাক্ত দ্রব্য বা নেশা জাতীয় ওষুধ প্রয়োগ করে হত্যার অভিযোগ এনে মামলা করেন। মামলায় সাফিয়াসহ অজ্ঞাতনামা ৫/৬ জনকে আসামি করা হয়। মামলার পর ৪ জুন সাফিয়াকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে ৫ দিনের রিমান্ড আবেদন করে পুলিশ। আদালত তার তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। ৮ জুন রিমান্ড শেষে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন সাফিয়া বেগম। এদিকে, আগামী ৫ জুলাই মামলাটি তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য ধার্য রয়েছে। মামলা সম্পর্কে জানতে চাইলে তদন্ত কর্মকর্তা কদমতলী থানার সাব-ইন্সপেক্টর (নিরস্ত্র) লালবুর রহমান বলেন, ২/৩ মাস আগে মোবাইলের সূত্র ধরে ভিকটিমের সঙ্গে সাফিয়া বেগমের সম্পর্ক হয়। তাদের মধ্যে একটা সম্পর্ক ছিল। এ কারণে ভিকটিম স্বেচ্ছায় আসামির বাসায় আসেন। অসুস্থ হয়ে মারা গেছে না কিছুকিছু খাইয়ে তাকে হত্যা করা হয়েছে তা জানা যায়নি। তিনি বলেন, আসামি তার ভাবীর সঙ্গে একই বাসায় থাকতেন। ভাবী বাসায় না থাকায় পিন্টু স্বেচ্ছায় সাফিয়ার বাসায় আসেন। সেখানকার ভিডিও ফুটেজে তাকে দেখা গেছে। ময়নাতদন্ত রিপোর্ট এখনো পাওয়া যায়নি। রিপোর্ট পাওয়ার পর জানা যাবে এটা হত্যা না স্বাভাবিক মৃত্যু। মামলার বাদী পিন্টুর ভাই আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, এমন একটা দুর্ঘটনা সহ্য করা যায় না। তরতাজা একটা প্রাণ কেড়ে নিলো। ভাইকে হারিয়ে আমরা পাগল হয়ে গেছি। ও ছিল সবার আদরের। এটা মানতে পারছি না যে, আমার ভাই আর নেই। তিনি বলেন, আমার ভাই ছিল সহজ-সরল। বাবা শিক্ষক ছিলেন। আমরা সবাই সুন্দর পরিবেশে বড় হয়েছি। আমাদের সবার সঙ্গে সবার আন্তরিকতা ছিল খুবই ভালো। কিন্তু একটা অনাকাঙ্খিত ঘটনা পিন্টুকে কেড়ে নিলো। ওর জন্য মেয়ে দেখেছিলাম। ভেবেছিলাম বিয়ে দিয়ে দেবো। কিন্তু তার আগেই ওকে হত্যা করা হলো। এর প্রকৃত রহস্য উদঘাটন হওয়া উচিত। গ্রাম/এলাকার শত্রুতার পিন্টু বলি কি না সেটা খতিয়ে দেখা হোক। অন্য কারো যোগসাজস আছে কি না। ওই বাড়ির নিরাপত্তাপ্রহরী মো. মোমিন বলেন, আমি তিন চার মাস হলো এই বাসায় চাকরি নিয়েছি। আমি আসার আগেই তারা এ বাসা ভাড়া নেন। আমি ভোর থেকে রাত সাড়ে ১১ পর্যন্ত ডিউটিতে থাকি। এরপর ঘুমিয়ে যাই। সবার কাছে গেটের চাবি থাকে। এরপর যার যার ইচ্ছেমতো বাসা থেকে বের হতে বা ঢুকতে পারেন। ঘটনার দিন আমি রাত সাড়ে ১১টা পর্যন্ত ডিউটিতে ছিলাম। এরপর ঘুমিয়ে যাই। ভোরের দিকে ওই বাসার সাফিয়া ম্যাডাম আমাকে ডেকে তোলেন। এসে বলেন, আমার এক বন্ধু বাসায় আসছে। কিন্তু ও তো নড়েচড়ে না। একটু চলেন তো দেখবেন কি হয়েছে ওর। আমি ওঁর সঙ্গে বাসায় যাই। গিয়ে দেখি ওই লোক বিছানায় শুয়ে আছে। শরীরে কোনো কাপড় নেই। দেখেই বোঝা যায় উনি মারা গেছেন। আমি আর তার শরীরে হাত না দিয়ে চলে আসি। পরে তার ডাক-চিৎকারে আশপাশের লোকজন বাসায় এসে জড়ো হন। তিনি বলেন, পরে পুলিশ এসে লাশ উদ্ধার করে এবং ম্যাডামকে নিয়ে যান। পরিবারটির বিষয়ে মোমিন জানান, শুনেছি ম্যাডামের স্বামীর সঙ্গে ডিভোর্স হয়ে গেছে। তার একমাত্র সন্তান নানা-নানীর কাছে গ্রামের বাড়ি কুমিল্লা থাকে। সাফিয়া ম্যাডামও কুমিল্লা থাকেন। তবে ভাবী একা থাকায় তিনি মাঝে মধ্যে এখানে আসতেন। কিছুদিন থাকতেন। আর তার ভাই গ্রামে বালুর ব্যবসা করেন। দুই মেয়ের মধ্যে একজনকে ঢাকায় বিয়ে দিয়েছেন। আরেক জনের বিয়ে হয়েছে নারায়নগঞ্জের সোনারগাঁও। মেয়েরা মাঝে মধ্যে এখানে আসেন। মা না থাকলেও আসতেন। এসে থাকতেন। আর শুনেছি ভাবী ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নার্স ছিলেন। সকাল ৬টার দিকে বাসা থেকে বের হতেন। আর আসতেন বিকেলে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই এলাকার একজন চা দোকানী বলেন, মেয়েটি ছেলেটাকে বাঁচানোর জন্য চেষ্টা করেছিল। আশপাশের লোকজনকে ডাকাডাকি করেছিল। আল্লাহ জানে কি ঘটেছিল ওইদিন। তবে অপরাধ করলে যেন সাজা হয়। আর যদি নিরাপরাধ হয় তাহলে যেন মেয়েটা মুক্তি পায়। জানা যায়, ওই ঘটনার পর থেকে সাফিয়া বেগমের ভাবী আর বাসায় আসেননি। বাড়িওয়ালার কাছে দেওয়া মোবাইলে নম্বরে পুলিশ যোগাযোগের চেষ্টা করছে। তবে মোবাইল নম্বরটি বন্ধ বলে জানায় পুলিশ। পিন্টু হত্যা মামলায় অভিযোগ করা হয়, পিন্টু ইংরেজি দৈনিক পত্রিকা ‘দ্যা এশিয়ান এইজ’ পত্রিকায় সার্কুলেশন ব্যবস্থাপক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। সংবাদপত্রে কর্মরত থাকার কারণে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন লোকজনের সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ হতো তার। এরই সূত্র ধরে ৩/৪ মাস আগে পিন্টুর মোবাইল ফোন সংগ্রহ করে সাফিয়া বেগম। বিভিন্ন কৌশলে সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করে সে। সাফিয়া বেগম মাঝে মধ্যে পিন্টুর সঙ্গে মোবাইলে কথা বলতো। গত ৩ জুন রাত সাড়ে ১২টার দিকে সাফিয়া বেগম কৌশলে পিন্টুকে কদমতলীর মেডিকেল রোডের বাসায় আসতে বাধ্য করে। রাত ২টার দিকে পিন্টু সাফিয়ার বাসায় পৌঁছায়। বাসায় আসার পর রাত ৩টা থেকে সকাল পৌনে ৮টার মধ্যে যেকোনো সময় খাবারের সঙ্গে অথবা অন্যভাবে বিষাক্ত কোনো দ্রব্য খাইয়ে কিংবা অতিমাত্রায় নেশা জাতীয় কোনো ওষুধ প্রয়োগ করে পিন্টুকে হত্যা করা হয় বলে অভিযোগ করেন আরিফুল হক চৌধুরী।