• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ০৩:১৬ পূর্বাহ্ন

‘জাস্টিস ডিলেইড ইজ টু জাস্টিস ডিনাইড’ ভুল প্রমাণিত হলো

Reporter Name / ৩৩৫ Time View
Update : শনিবার, ৬ নভেম্বর, ২০২১

নিজস্ব প্রতিবেদক :
‘জাস্টিস ডিলেইড ইজ টু জাস্টিস ডিনাইড’ বলে একটি কথা আছে। অর্থাৎ ন্যায়বিচারে দেরি করা মানে ন্যায়বিচারকে অস্বীকার করা। ন্যায়বিচার দ্রুত হওয়াই কাম্য। কিন্তু বিচার তড়িঘড়ি করতে গিয়ে নিরপরাধকে শাস্তি দেওয়া কোনভাবেই কাম্য নয়। কিন্তু এমন অপ্রত্যাশিত ঘটনাই সম্প্রতি ঘটেছে আমাদের দেশে। বিচার শেষ হওয়ার আগেই যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে হত্যা মামলার দুই আসামির ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। ২০১৭ সালের ১৬ নভেম্বর চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা উপজেলার কুমারী ইউনিয়নের দুর্লভপুর গ্রামের মৃত মুরাদ আলীর ছেলে আবদুল মোকিম (৬০) ও মৃত আকছেদ সর্দারের ছেলে গোলাম রসুল ঝড়-র (৬২) ফাঁসি কার্যকর করে কারা কর্তৃপক্ষ। বিচারাধীন আপিল নিষ্পত্তির আগে আসামিদের এভাবে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ড কার্যকরের ঘটনাকে নজিরবিহীন হিসেবে উল্লেখকরেছেন সাবেক এক প্রধান বিচারপতি। এমনকি নিহত মনোয়ার হোসেনের ছেলেও এমন ঘটনায় হতভম্ব। বিস্মিত চুয়াডাঙ্গার অনেক মানুষ। তারা এই ব্যাপারটিতে দুঃখ প্রকাশ করেছেন।
সূত্র জানায়, ১৯৯৪ সালের ২৮ জুন চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা উপজেলার কুমারী ইউনিয়নের দুর্লভপুর গ্রামে চরমপন্থি ক্যাডারদের হাতে খুন হন মুক্তিযোদ্ধা ও তৎকালীন ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য মনোয়ার হোসেন। তিনি স্থানীয় কুমারী ইউনিয়ন পরিষদের দুই মেয়াদে সদস্য ও কৃতী খেলোয়াড় ছিলেন। খুনের ঘটনায় তার ভাই মুক্তিযোদ্ধা অহিম উদ্দীন বাদী হয়ে আলমডাঙ্গা থানায় ২১ জনকে আসামি করে হত্যা মামলা করেন। মামলা দায়েরের এক যুগের বেশি সময় পর ২০০৮ সালের ১৭ এপ্রিল তিনজনের মৃত্যুদন্ড, দুজনকে যাবজ্জীবন ও অপর আসামিদের খালাস দেন চুয়াডাঙ্গার অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালত।
মৃত্যুদন্ডাদেশপ্রাপ্তরা হলেন- একই ইউনিয়নের তৎকালীন ইউপি চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ, আবদুল মোকিম ও গোলাম রসুল ঝড়ু। বিচারিক আদালতের রায়ের পর নিয়ম অনুসারে আসামিদের মৃত্যুদন্ডাদেশ অনুমোদনের জন্য মামলাটি ‘ডেথরেফারেন্স’ (মৃত্যুদন্ড অনুমোদনের মামলা) হিসেবে হাইকোর্টে আসে। শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট মোকিম ও ঝড়ুর মৃত্যুদন্ডাদেশ বহাল রেখে ২০১৩ সালের ৭ জুলাই ও ৮ জুলাই রায় ঘোষণা করেন। বাকি আসামিদের খালাস দেন। পরে মোকিম (আপিল নং-১১১/২০১৩) ও ঝড়ু (আপিল নং-১০৭//২০১৩) সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগে আপিল করেন। আপিল শুনানি নিষ্পত্তি হওয়ার আগেই ২০১৭ সালের ১৬ নভেম্বর রাতে এ দুই আসামির ফাঁসি কার্যকর করা হয়। বিচারিক আদালতে কোনো আসামিকে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হলে তা কার্যকরে হাইকোর্টের অনুমতির প্রয়োজন হয় বলে মন্তব্য করেছেন বিচারসংশ্লিষ্টরা।
তাদের ভাষ্য, এ দুই আসামির ক্ষেত্রে হাইকোর্ট মৃত্যুদন্ড কার্যকরের অনুমোদন দেওয়ার পর ওই রায়ের বিরুদ্ধে আসামিপক্ষ আপিল করায় স্বাভাবিক নিয়মেই তাদের ফাঁসি কার্যকরের আদেশ স্থগিত হয়ে যাবে। আপিল নিষ্পত্তির পরও সাজা বহাল থাকলে আসামিরা রিভিউ আবেদন করতে পারবেন একই আদালতের কাছে। এমনকি রিভিউ আবেদন খারিজ হওয়ার পর রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদনও করতে পারবেন- এটিই হলো আইন ও সাংবিধানিক বিধান। কিন্তু বিচারের দুটি ধাপ ও একটি প্রশাসনিক ধাপ বাকি থাকার পরও দুই আসামির ফাঁসি কার্যকর করা আইনের শাসনের ব্যর্থতা, মানবাধিকারের লঙ্ঘন ও ন্যায়বিচারের পরিপন্থী। এ ঘটনাকে বাংলাদেশের বিচার বিভাগের ইতিহাসে এক নজিরবিহীন, অবিশ্বাস্য ও হৃদয়বিদারক বলে দাবি করছেন বিচারসংশ্লিষ্টরা।
ঘটনাটিকে অত্যন্ত হৃদয়বিদারক উল্লেখ করে সাবেক প্রধান বিচারপতি ও বর্তমানে আইন কমিশনের চেয়ারম্যান এবিএম খায়রুল হক বলেন, ‘ঘটনা যদি সত্য হয় তা হলে এটি তো একেবারেই আইনের শাসনের পরিপন্থী হয়ে গেল। এটি তো হয় না, হতে পারে না।’ তিনি আরও বলেন, ‘কোনো ফাঁসির আসামি আপিল বিভাগে আপিল দায়ের করলে তার ফাঁসি কার্যকরের ওপর স্থগিতাদেশ দেওয়া লাগে না। অটোমেটিক্যালি (স্বাভাবিকভাবেই) ফাঁসির আদেশ স্থগিত হয়ে যায়। কিন্তু আপিল বিচারাধীন থাকাবস্থায় ফাঁসি কার্যকর এটি খুবই দুর্ভাগ্যজনক। আইনের শাসন ও প্রশাসনিক ব্যর্থতা।’
নিহতের ছেলে জাহাঙ্গীর আলম কুমারী ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য। পিতার এমন মর্মান্তিক ফাঁসির ব্যাপারে তাঁর ভাষ্য, কীভাবে আপিল বিচারাধীন থাকাবস্থায় দুই আসামির ফাঁসি কার্যকর করা হলো তা আমরা জানতাম না। এটি বিচার কর্তৃপক্ষ ও কারাকর্তৃপক্ষ ভালো জানে। তবে এটি জানি, ২০১৭ সালে তাদের ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। আপিল বিচারাধীন অবস্থায় ফাঁসি কার্যকর হওয়া নিয়ে এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িতরা আরও বিস্তারিত বলতে পারবেন- কেন তারা ফাঁসি কার্যকর করলেন? আমি মনে করি এভাবে আপিলের নিষ্পত্তির আগেই ফাঁসি কার্যকর সঠিক হয়নি।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমানও এই ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, একটি দেশে ন্যায়বিচার, প্রশাসন থাকলে এ ধরনের ঘটনা ঘটে কী করে? এ ঘটনার মাধ্যমে আাইনের শাসনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে জনগণের মাঝে একটি ভিন্ন ধরনের বার্তা দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, আপিল নিষ্পত্তির আগে বিচার সম্পন্ন হয়েছে বলে ধরা যাবে না। সর্বোচ্চ আদালতে বিচারাধীন থাকলে তো ফাঁসির রায় কার্যকর করা যায় না। পুরো বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়াটা বিচারপ্রার্থীর শুধু নাগরিক অধিকারই নয়, এটি মৌলিক মানবাধিকার বলেও উল্লেখ করেন তিনি। হয় বিচার প্রশাসনের অথবা কারাকর্তৃপক্ষের চরম অবহেলায় এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে উল্লেখ করে অধ্যাপক মিজানুর রহমান আরও বলেন, সুপ্রিমকোর্টের উচিত দ্রুততার সঙ্গে এ ঘটনায় ব্যবস্থা নেওয়া। যারা যারা এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত, যেভাবে এ ঘটনা ঘটেছে তা খুঁজে বের করা উচিত, তা না হলে বিচার বিভাগ সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণার সৃষ্টি হবে।
সূত্র জানায়, সম্প্রতি ওই দুই আসামির করা আপিল আবেদন সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের কার্যতালিকায় শুনানির জন্য ওঠে। মামলাটি শুনানির জন্য তালিকায় ওঠার পর দরিদ্র ঝড়-র পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেন আইনজীবী হুমায়ুন কবির। তিনি জানতে পারেন, ২০১৭ সালে মোকিম ও ঝড়-র ফাঁসি কার্যকর করেছে কারাকর্তৃপক্ষ। এরপর তিনি বিষয়টি মোকিমের আইনজীবী মো. আসিফ হাসানকেও জানান।
এলাকাবাসী জানায়, দুটি পরিবারই অত্যন্ত গরিব ও অসহায়। তারা মামলার ব্যাপারে কোনো খোঁজখবর রাখতে পারতেন না। প্রশাসনের কাছে দৌড়ঝাঁপ করার মতো কোনো লোক তাদের ছিল না। এ কারণে আপিল বিচারাধীন থাকাবস্থায় ফাঁসি কার্যকর হলেও তা ঠেকাতে কোনো উদ্যোগ তারা নিতে পারেননি। ওই দুই পরিবারের সবাই এখন গ্রাম ছেড়ে দিয়েছেন। তারা কোথায় আছেন কেউ বলতে পারছেন না।
কারাগারসংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র থেকে জানা যায়, আইনগত সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার পর মোকিম ও ঝড়-র ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। আপিল বিভাগে মৃত্যুদন্ড বহাল থাকার পর এ দুই আসামি রাষ্ট্রপতির কাছে ‘মৃত্যুদন্ড মওকুফের আবেদন’ করেন। রাষ্ট্রপতি এই আবেদন নামঞ্জুর করেন। ২০১৭ সালের ২২ অক্টোবর রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে সহকারী সচিব মোহাম্মদ আলী স্বাক্ষরিত এক পত্রে আবেদন নামঞ্জুরের বিষয়টি কারাকর্তৃপক্ষকে জানানো হয়। এরপর আইনগত প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে ১৬ নভেম্বর ফাঁসি কার্যকর করা হয়। উল্লেখ্য, এই মর্মান্তিক ঘটনায় অনেক আইনজীবী দুঃখ প্রকাশ করেছেন। তাদের ভাষ্য, ‘এ ধরনের নজির দেশে কখনই দেখা যায়নি। তবে বিগত ১০০ বছরের ইতিহাসে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসনামলে এমন একটি নজির পাওয়া যায়। ব্রিটিশ আমলে নন্দ কুমারের বেলায় এমন ঘটনা ঘটেছিল। ওয়ারেন হেস্টিংসের শাসনামলে প্রতারণার অপরাধে সর্বোচ্চ সাজা ছিল সাত বছরের কারাদন্ড। তবে সে সাজার বিধান থাকলেও ব্রিটেনের আইন প্রয়োগ করে প্রতারণার মামলায় নন্দ কুমারকে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়েছিল। তাকে আপিল আবেদন করার সুযোগ দেওয়ার আগেই ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছিল। তখন থেকেই ‘জুডিশিয়াল মার্ডার’ শব্দটির ব্যবহার শুরু হয়। তবে মোকিম ও ঝড়ুর বিষয়টি জুডিশিয়াল মার্ডার না হলেও হেফাজতে মৃত্যুর মতো একটি বিষয়।’


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category