নিজস্ব প্রতিবেদক:
ধারাবাহিকভাবে কমে যাচ্ছে দেশ থেকে হিমায়িত চিংড়ি রফতানির পরিমাণ। এক যুগ আগেও বিশ্ববাজারে বাংলাদেশ থেকে বছরে ৫০ হাজার টন চিংড়ি রফতানি হতো। কিন্তু সমাপ্ত অর্থবছরে তা অর্ধেকেরও কম নেমে এসেছে। যার পরিমাণ প্রায় ২৪ হাজার টনে,। একই সময়ে হিমায়িত চিংড়ি থেকে রফতানি আয় ৫৭ কোটি থেকে কমে প্রায় ২৪ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে। যদিও বিশ্ববাজারে চিংড়ির চাহিদা ক্রমান্বয়ে কমতে থাকায় সমাপ্ত অর্থবছরের শুরুতে রফতানির লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে আনা হয়। কিন্তু তারপরও অর্থবছরের শেষে ওই লক্ষ্য অর্জিত হয়নি। বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএফএফইএ) এবং রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বাংলাদেশী উদ্যোক্তারা বিশ্ববাজারে হিমায়িত চিংড়ির চাহিদার কারণে প্রায় দুই যুগ আগে পণ্যটি রফতানিতে আগ্রহী হয়। তখন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে চিংড়ি প্রক্রিয়াকরণ কারখানা স্থাপন করা হয়। কিন্তু ২০০৮ সাল-পরবর্তী অর্থনৈতিক মন্দার কারণে হিমায়িত চিংড়ির দাম কমে যায়। পাশাপাশি বিশ্ববাজারে বাড়তে থাকে ভেনামি চিংড়ির চাহিদা আর কমতে শুরু করে দেশে উৎপাদিত বাগদা বা গলদা চিংড়ির চাহিদা। মূলত ভেনামি চিংড়ির উৎপাদন ও বাজারজাত শুরু না করা, চাষের জমি কমে যাওয়া এবং কাঁচামালের সংকটের কারণে বিশ্ববাজারে চিংড়ি রফতানি কমে যাচ্ছে। ওই প্রেক্ষিতে ইতোমধ্যে চিংড়ি প্রক্রিয়াকরণ অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। সূত্র জানায়, বিগত ২০১২-১৩ অর্থবছরে প্রায় ৫০ হাজার টন চিংড়ি রফতানি হয়েছিল। যার বাজারমূল্য ছিল আনুমানিক ৫৭ কোটি ডলার। আর ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এসে রফতানি হয়েছে মাত্র ২৪ হাজার টন, আর্থিক অংকে যা প্রায় ২৪ কোটি ডলার। এক যুগের ব্যবধানে চিংড়ি রফতানি কমেছে প্রায় ২৭ হাজার টন বা ৫২ শতাংশ। আর্থিক অংকে যার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩৩ কোটি ডলার বা ৫৭ শতাংশ। বিগত এক যুগ ধরে হিমায়িত চিংড়ি রফতানির পরিমাণ ধারাবাহিকভাবে প্রতি বছরই কমেছে। যদিও ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রায় ৫০ কোটি ডলারের চিংড়ি রফতানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু অর্থবছর শেষে মাত্র ৩০ কোটি ডলারের চিংড়ি রফতানি করা সম্ভব হয়। আর ২০২৩-২৪ অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ২৯ কোটি ৭৯ লাখ ডলারের। বছর শেষে সেটা নেমে আসে মাত্র ২৪ কোটি ডলারে। অর্থাৎ বছরের ব্যবধানে চিংড়ি রফতানি লক্ষ্যমাত্রা ৪০ শতাংশ কমিয়ে আনলেও ওই পরিমাণ অর্থের চিংড়ি রফতানি করা সম্ভব হয়নি। সূত্র আরো জানায়, বিগত পাঁচ বছরে চিংড়ি রফতানির লক্ষ্যমাত্রা ছিল যথাক্রমে ৩৬ কোটি ১০ লাখ ডলার, ৪১ কোটি ৫০ লাখ, ৩৩ কোটি, ৫০ কোটি এবং ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ২৯ কোটি ৭৯ লাখ ডলার। আর গত এক যুগের মধ্যে শুধু ২০২১-২২ অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি চিংড়ি রফতানি সম্ভব হয়েছে। ওই সময়ে ৩৩ কোটি ডলারের লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও ৪০ কোটি ৭২ লাখ ৫০ হাজার ডলারে ৩০ হাজার ৫৭১ টন চিংড়ি রফতানি হয়। মূলত কভিড মহামারীকালে বিশ্ববাজারে চিংড়ির সরবরাহ কমে যাওয়ায় এবং মূল্যবৃদ্ধির কারণে তখন লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি রফতানি সম্ভব হয়েছিল। এদিকে হিমায়িত চিংড়ি রফতানিকারকরা বলছেন, হিমায়িত চিংড়ির রফতানি কমে যাওয়ায় ব্যবসায়ীদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। প্রতি বছর বিশ্ববাজারের চাহিদা বাড়লেও বাংলাদেশে ভেনামি জাতের চিংড়ি উৎপাদন না হওয়ায় এদেশের ব্যবসায়ীরা বাজার হারাচ্ছে। প্রক্রিয়াকরণ কারখানাগুলো কাঁচামালের অভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। এমনকি অনেকে কারখানাও বিক্রি করে দিয়েছেন। দেশে চিংড়ি চাষের উপযোগী প্রায় আড়াই লাখ হেক্টর জমির মধ্যে ২ লাখ হেক্টরে বাগদা চিংড়ি চাষ হয়। তাছাড়া মৎস্য অধিদপ্তরের আওতাধীন কক্সবাজার জেলার চকরিয়া-রামপুরা মৌজায় চিংড়ি চাষের উপযোগী সাত হাজার একর জমি অনাবাদি পড়ে রয়েছে। এ এলাকাটিকে চিংড়ি চাষের জোন হিসেবে ঘোষণা করা হলে এখান থেকে প্রক্রিয়াকরণ কারখানাগুলোর চাহিদার ৮০ শতাংশ কাঁচামাল সরবরাহ করা সম্ভব হবে। চকরিয়া-রামপুরা এলাকায় যে চিংড়ি এলাকা আছে তাতে বড় পরিসরে চিংড়ি উৎপাদন সম্ভব। বর্তমানে দেশে হিমায়িত মাছ রফতানি খাতে সম্পৃক্ত প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ১১০। ওসব কারখানার বার্ষিক উৎপাদনক্ষমতা সাড়ে ৩ লাখ টন। এ প্রসঙ্গে এমইউ সি ফুডস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শ্যামল দাস জানান, সারা বিশ্বে যেখানে চিংড়ি রফতানির প্রায় ৮০-৮২ শতাংশই হয় ভেনামি চিংড়ি, সেখানে এদেশের ব্যবসায়ীরা ২০ শতাংশের বাগদা বা গলদা চিংড়ি নিয়ে কাজ করছে। প্রতি বছর এ রফতানি কমে আসছে। হেক্টরপ্রতি আট হাজার কেজি ভেনামি চিংড়ি উৎপাদন হয়, সেখানে বাগদার উৎপাদন হেক্টরপ্রতি ৬০০-৮০০ কেজি। তবে বিশ্ববাজারে এ চিংড়ির চাহিদা বেশি। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে বৃহৎ উদ্যোক্তারা চিংড়ি চাষে না এলে মাঠ পর্যায়ের চাষীদের দিয়ে বড় পরিসরে উৎপাদন সম্ভব নয়। তাছাড়া চিংড়ি উৎপাদনে কোনো বৃহৎ দিকনির্দেশনাও বিগত সরকারের পক্ষ থেকে আসেনি।
https://slotbet.online/