নিজস্ব প্রতিবেদক:
গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেড (জিটিসিএল) গ্যাস পাইপলাইন নির্মানে হাজার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করে এখন লোকসানে হাবুডুবু খাচ্ছে। সংস্থাটি দেশের মোট গ্যাস সরবরাহের ৭৫ শতাংশ সঞ্চালন করে। পাইপলাইনে গ্যাস সরবরাহ হলে সংস্থাটি সঞ্চালন চার্জ পায় আর এটিই এর আয়ের একমাত্র উৎস। লাইনে গ্যাস সরবরাহ কমলে সংস্থাটির আয়ও কমে যায়। দিনে জিটিসিএলের গ্যাস সঞ্চালন সক্ষমতা ৫০০ কোটি ঘনফুট। কিন্তু সরবরাহ করে ২০০ কোটি ঘনফুট। অর্ধেকের বেশি সক্ষমতাই অব্যবহৃত থেকে যায়। বিগত সরকারের আমলে একের পর এক পাইপলাইন নির্মাণ করে সংস্থাটি এখন লোকসানি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। জিটিসিএল সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, গ্যাস পাইপলাইন প্রকল্পে দাতা সংস্থা ও সরকারের পাশাপাশি জিটিসিএলের নিজস্ব অর্থায়ন রয়েছে। ওসব বিনিয়োগ করে এখন আর্থিক চাপে পড়েছে সংস্থাটি। ঋণের কিস্তি শোধের চাপের মধ্যে সংস্থাটির আয় কমছে। আর প্রকল্পসমূহ মূলধনীকরণের ফলে ঋণের সুদ ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাছাড়া অবচয় বৃদ্ধি এবং সিস্টেম লস অন্তর্ভুক্ত করার কারণেও কোম্পানির ক্ষতির পরিমাণ বাড়ছে। ১৯৯৩ সালে কোম্পানি নিবন্ধন নিয়ে যাত্রা শুরু করা জিটিসিএলের ওই সময় সঞ্চালন লাইন ছিল ৫৪৪ কিলোমিটার। ২০২২-২৩ অর্থবছর শেষে তা ২ হাজার ১৬৭ কিলোমিটারে দাঁড়ায়। ২০২০-২১ অর্থবছরেও ৭৪ কোটি টাকা মুনাফা করে সংস্থাটি। এরপর ২০২১-২২ অর্থবছরে ২১৭ কোটি টাকা লোকসান গোনে। আগের বছরের তুলনায় ২০২২-২৩ অর্থবছরে সংস্থাটির ১১ শতাংশ গ্যাস সঞ্চালন কমেছে। ওই অর্থবছরে সংস্থাটি লোকসান করেছে ১ হাজার ২১২ কোটি টাকা। সূত্র জানায়, দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে গ্যাস সরবরাহের জন্য দুটি সঞ্চালন লাইন তৈরি করতে জিটিসিএলের দেড় হাজার কোটি টাকার বেশি খরচ হয়েছে। সিরাজগঞ্জের হাটিকুমরুল থেকে পাবনার ঈশ্বরদী হয়ে কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা গেছে পাইপলাইন। আরেকটি প্রকল্পের অধীনে ভেড়ামারা থেকে খুলনায় নেয়া হয়েছে গ্যাসলাইন। এরপর গ্রাহকের কাছে পৌঁছাতে আলাদা করে আবার বিতরণ পাইপলাইন করেছে সুন্দরবন গ্যাস কোম্পানি। গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত না করেই খুলনায় ৮০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার গ্যাসচালিত একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে। যার কাজ প্রায় শেষের দিকে। ওসব পাইপলাইন প্রকল্প অনেক আগেই করা হয়েছে। ওই সময় গ্যাস উৎপাদন বাড়ানোর যে পরিকল্পনা করা হয়েছিল, তা এগোয়নি। কূপ খনন করে উৎপাদন বাড়ানো গেলে গ্যাস সরবরাহ দেয়া সম্ভব হতো। যদিও দেশে কয়েক বছর ধরে গ্যাস সরবরাহের সংকট বাড়ছে। তবু খুলনা ও রাজশাহীতে নেয়া হয়েছে গ্যাসের পাইপলাইন। তবে নতুন সংযোগ হয়েছে হাতেগোনা। রংপুরে নেয়া হচ্ছে নতুন লাইন। যদিও গ্যাস কবে যাবে, তার নিশ্চয়তা নেই। সূত্র আরো জানায়, খুলনা, বরিশাল ও ঢাকা বিভাগের কয়েকটি জেলা নিয়ে ২০০৯ সালে গঠন করা হয় সুন্দরবন গ্যাস কোম্পানি। প্রতিষ্ঠানটির ১৪৪ কিলোমিটার বিতরণ পাইপলাইন আছে। ২০১২-১৩ থেকে শুরু করে গত বছর পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি সংযোগ দিয়েছে ২ হাজার ৩৯৩টি, যার মধ্যে আবাসিক সংযোগ ২ হাজার ৩৭৬টি। ১১ বছরে শিল্প সংযোগ হয়েছে মাত্র ৮টি। কুষ্টিয়ার তিনটি কারখানা ছাড়া সব সংযোগ হয়েছে ভোলায়। খুলনা ও বরিশালে কোনো সংযোগ হয়নি। যদিও আবাসিকে প্রায় এক দশক ধরে গ্যাস সংযোগ বন্ধ। শিল্পেও সংযোগ হয় বিশেষ বিবেচনায়। গ্যাসের অভাবে ধুঁকছে শিল্পকারখানা। তবু অর্থনৈতিক উন্নয়নের নামে করা হয়েছে গ্যাস সরবরাহের পাইপলাইন। এদিকে উত্তরের জনপদে ২০১৮ সালে নেওয়া হয় বগুড়া-রংপুর-সৈয়দপুর গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইন প্রকল্প। ২০২৩ সালের জুনে এটি শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়েছে। প্রকল্পের খরচ ১ হাজার ৩৭৮ কোটি টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ১ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা। সৈয়দপুর পর্যন্ত গ্যাস সরবরাহ করার জন্য ওই পাইপলাইন এখন তৈরি আছে। এখন মিটারিং স্টেশনের কাজ চলছে। এর আগে রাজশাহী পর্যন্ত নেয়া হয়েছে গ্যাসলাইন। রাজশাহী ও রংপুর বিভাগে গ্রাহকের কাছে গ্যাস সরবরাহের দায়িত্বে পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস কোম্পানি। প্রতিষ্ঠানটি গত ৮ বছরে মাত্র ১০৮টি গ্যাস সংযোগ দিয়েছে। এর মধ্যে বিশেষ বিবেচনায় ৩৪টি আবাসিক সংযোগ দেয়া হয়েছে। ২০০০ সাল থেকে এখন পর্যন্ত তাদের মোট সংযোগ ১ লাখ ২৯ হাজার ৪১১টি। এর মধ্যে ১ লাখ ২৮ হাজার ৮৫২টি আবাসিক সংযোগ। মোট পাইপলাইন আছে ১ হাজার ৬৮৫ কিলোমিটার। আর খুলনা ও রাজশাহীতে যখন পাইপলাইন নেয়া হয়, তখন থেকেই গ্যাস-সংকট ছিল। অন্যদিকে বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশে দিনে গ্যাসের চাহিদা ৩৮০ কোটি ঘনফুট হলেও সরবরাহ করা হয় সর্বোচ্চ ৩০০ থেকে ৩১০ কোটি ঘনফুট। এর মধ্যে দেশীয় উৎস থেকে আসে ২০০ কোটি ঘনফুট। আর তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস থেকে আসে ১১০ কোটি ঘনফুট। শিগগিরই দেশীয় উৎস থেকে উৎপাদন বাড়ার সম্ভাবনা কম। তাই এলএনজি আমদানি বাড়াতে নানা পরিকল্পনা নিয়েছিল বিগত সরকার। আমদানি চুক্তির পাশাপাশি নতুন টার্মিনাল নির্মাণেও চুক্তির উদ্যোগ নেয়া হয়। নতুন প্রকল্পের মধ্যে পায়রা-বরিশাল-গোপালগঞ্জ পাইপলাইন নির্মাণ প্রকল্পে ব্যয় হতে পারে প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা। পায়রায় নির্মিত হতে যাওয়া এলএনজি টার্মিনাল থেকে গ্যাস সরবরাহ করতে এ পাইপলাইন নির্মাণ করার কথা। এছাড়া দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে গ্যাস সরবরাহের জন্য নারায়ণগঞ্জের লাঙ্গলবন্দ থেকে মাওয়া হয়ে জাজিরা-টেকেরহাট-গোপালগঞ্জ পাইপলাইনে খরচ ধরা হয়েছে ২ হাজার ৩৬০ কোটি টাকা। এসব প্রকল্পের বিষয়ে নতুন করে ভাবছে সরকার। গ্যাস পাইপলাইন অব্যবহৃত থাকার কথা স্বীকার করে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্রনাথ সরকার জানান, অনেক আগে এসব পাইপলাইন প্রকল্প করা হয়েছে। ওই সময় গ্যাস উৎপাদন বাড়ানোর যে পরিকল্পনা করা হয়েছিল, তবে তা এগোয়নি। কূপ খনন করে উৎপাদন বাড়ানো গেলে গ্যাস সরবরাহ দেয়া যেত।
https://slotbet.online/