নিজস্ব প্রতিবেদক :
প্রত্যেক প্রাণীর প্রকৃতির সাথে খাপ খেয়ে চলার এক অদম্য শক্তি আছে। এই শক্তি সৃষ্টিকর্তা প্রত্যেক প্রাণীর মধ্যে দিয়ে দিয়েছেন। প্রকৃতি ও পরিবেশ যেমনই হোক না কেন একসময় না একসময় তার সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে প্রত্যেক প্রাণী। মানুষ হলো সবচেয়ে উৎকৃষ্ট প্রাণী। মানুষের মধ্যেও এই মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা অসাধারণ। এই ক্ষমতার বলেই মানুষ ধীরে ধীরে করোনা মহামারীকেও স্বাভাবিক হিসেবে গ্রহণ করছে। বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে এই মানিয়ে নেওয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে প্রবলভাবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশেও ভাইরাসটি নিয়ন্ত্রণে দেওয়া বিধিনিষেধ গুটিয়ে নেওয়া হচ্ছে।
এই যে দেশের মানুষের মধ্যে ভয়ানক মহামারী রোগকে সাধারণ রোগ হিসেবে মানিয়ে নেওয়ার প্রবণতা—এই প্রবণতাটাকে বলা আছে অ্যান্ডেমিক। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে এখন করোনা প্যান্ডেমিক ক্রমাগত অ্যান্ডেমিকের রূপ নিচ্ছে। তবে এ ব্যাপারে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক ‘অ্যান্ডেমিক’ ঘোষণা না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে বলে মনে করছেন তাঁরা।
দীর্ঘ দুই বছরের অধিক সময় ধরে চলমান এই মহামারী রোগ বিশ্ব-অর্থনীতিতে নামিয়েছে ধস। এই মন্দাবস্থা কাটিয়ে উঠতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মধ্যে এটিকে এখন অ্যান্ডেমিক হিসেবে গ্রহণের প্রবণতা দেখা যাচ্ছে বলে জানা গেছে। করোনা নিয়ন্ত্রণে বিধিনিষেধগুলোতে তারা এখন শিথিলতা নিয়ে আসছে। বাংলাদেশেও সরকারিভাবে বিধিনিষেধ জারি করা হয়েছে। তবে সরকারের পক্ষ থেকে আরোপিত বিধিনিষেধ পালনের প্রবণতা সাধারণ মানুষের মধ্যে খুব একটা দেখা যাচ্ছে না। সাধারণ মানুষ করোনাকে ‘অ্যান্ডেমিক’ ধরেই জীবন-যাপন করছে।
শুরুর দিকে করোনা মহামারী মানুষের ভেতর যে ভীতি সঞ্চার করেছিল তার সিকি পরিমাণও আর মানুষের ভেতর পরিলক্ষিত হচ্ছে না। তারা নির্ভয়ে চলাফেরা করছে। এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা সংক্রমণের প্রথমদিকে মানুষের মধ্যে ভাইরাসটি নিয়ে যে ভয় ছিল, এখন আর তা নেই। এটাকে স্বাভাবিক রোগ মনে করছে তারা।
করোনাকে স্বাভাবিক রোগ হিসেবে গ্রহণ করার পেছনে আরও একটি কারণ হলো যে সাধারণ মানুষ এই মহামারীর স্থায়িত্ব নিয়ে দোদুল্যমান অবস্থায় আছে। এই মহামারী কবে বিদায় নেবে সে ব্যাপারে তারা অন্ধকারে অবস্থান করছে। জীবনের তাগিদে তাঁদের ছুটতে হচ্ছে। জীবন তো আর থেমে থাকবে না। নিজের অস্বিত্বকে টিকিয়ে রাখতেই ভেতরের ভয়টাকে একপ্রকার বিসর্জন দিয়েছে তারা। তাছাড়া এখন শীতকাল, স্বাভাবিকভাবেই ঠান্ডা-জ¦র হয়। করোনার বর্তমান উপসর্গও এমন। মানুষ মনে করছে করোনা সাধারণ রোগ হিসাবেই থাকবে। তবে এটা সত্য যে, বাংলাদেশসহ বিশ্বে যেভাবে আক্রান্ত হচ্ছে, এটা একপর্যায়ে মানুষের শরীরে ‘ন্যাচারাল ইমিউনিটি’ তৈরি করবে। পাশাপাশি মানুষকে টিকা দেওয়া হচ্ছে। এই দুইয়ের সমন্বয়ে একসময় করোনা একেবারেই চলে যাবে। তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ঘোষণা না দেওয়া পর্যন্ত অ্যান্ডেমিক হিসেবে ঘোষণা দেওয়ার কোন সুযোগ নেই।
অনেক চিকিৎসা বিজ্ঞানীর কণ্ঠেও এই সুর শোনা যাচ্ছে। তাঁরা বলছেন, করোনাকে সঙ্গে নিয়েই আমাদের চলতে হবে। তবে এটি কোন কোন জায়গায় কী ধরনের গুচ্ছ সংক্রমণ, কত মৃত্যু হয় সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। দেখা যাবে কোন কোন জায়গায় সংক্রমণের পিকে (সর্বোচ্চ চূড়ায় গিয়ে কিছুদিন স্থিতিশীল থাকা) পৌঁছেছে। টিকাদানের জন্য তা নামতে শুরু করবে। আবার কোনো জায়গায় প্রাকৃতিকভাবে কমতে শুরু করবে। এটা নিয়েই সবাইকে বাঁচতে হবে। যাকে অ্যান্ডেমিক সাধারণ রোগ হিসাবে গণ্য করা হয়।
এটি স্পষ্ট যে, করোনা মহামারীকে পরিপূর্ণভাবে নিশ্চিহ্ন করা সম্ভব নয়। অর্থাৎ কোভিড-শূন্য দশা সৃষ্টি করা অসম্ভব। কিছু না কিছু আক্রান্ত অবস্থা থেকে যাবে সময়ে সময়ে। এটি হয়তো পরবর্তীতে দুর্বল রোগ হিসেবে পরিগণিত হবে। এই বিষয়টি উপলব্ধি বিশ্বের অনেক দেশ কোভিড শুন্য দশা প্রাপ্তির আশা ছেড়ে দিয়েছে। জানা যায়, নিউজিল্যান্ড জিরোভ্যাক্স কোভিড বা শূন্য কোভিড আইডিয়া বাদ দিয়েছে। চীন অলিম্পিক গেমস পর্যন্ত দেখবে বলছে। ইংল্যান্ড ঘোষণা দিয়েছে, সেদেশে আর বাধ্যতামূলক মাস্ক পরতে হবে না। জনসমাবেশস্থলে যেতেও আর কোভিড পাশ লাগবে না। স্কটল্যান্ড, ওয়েলস ও উত্তর আয়ারল্যান্ড একই ধরনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কারণ জিরো কোভিড আইডিয়া টিকা দিয়ে শেষ হবে না বলে উন্নত বিশ্বগুলো বুঝে গেছে।
বাংলাদেশে করোনার ভয়াবহতা অনেকটা স্থিমিত হয়তে এসেছে। যদিও মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে কিন্তু মৃত্যুহার হ্রাস পেয়েছে। এটিকে সাধারণ জ¦র হিসেবেই গ্রহণ করেছে মানুষ। জানা যায়, দেশে ভাইরাসটিতে এ পর্যন্ত ১৮ লাখ ৪৪ হাজার ৮২৮ জন আক্রান্ত ও ২৮ হাজার ৫২৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। সরকারি হিসাবে করোনা শনাক্ত-পরবর্তী ১৫ লাখ ৮৭ হাজার ৩৭৪ জন সুস্থ হয়ে উঠেছেন।
করোনা ভাইরাস শনাক্তে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের র?্যাপিড টেস্টিং কিট উদ্ভাবক দলের প্রধান অণুজীব বিজ্ঞানী ড. বিজন কুমার শীল মনে করছেন বাংলাদেশ এখন করোনা মহামারী থেকে উত্তরণের পথে। সম্প্রতি ফেসবুকে দেওয়া একটি স্ট্যাটাসে তিনি লিখেছেন, ‘এটি আমার আনন্দের বিষয়, ছয় মাস পূর্বে আমি যে পূর্বাভাস দিয়েছিলাম তার প্রতিফলন ঘটেছে। দেশের মানুষ যখন করোনা রোগের ভবিষ্যৎ নিয়ে বিশেষ করে শীতকালের জন্য আতঙ্কিত ছিল তখন আমি সবাইকে আশ্বস্ত করেছিলাম যে, জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশে করোনার প্রাদুর্ভাব শতকরা ৮০ শতাংশ কমে যাবে। আমি ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত ডাটা নিয়ে একটি প্লট করে দেখলাম বিষয়টি তেমনটিই হয়েছে।’
উল্লেখ্য, গত ১৩ আগস্ট ২০২০ একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন,‘ আগামী শীত মৌসুমে অর্থাৎ জানুয়ারির মধ্যেই বাংলাদেশে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ৮০ ভাগ কমে আসবে।’
করোনায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শিক্ষা ব্যবস্থা। দীর্ঘ দিন ধরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে আছে। সাধারণ মানুষ যখন করোনাকে স্বাভাবিক হিসেবে গ্রহণ করতে শুরু করেছে তাই বিভিন্ন মহল থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার আহ্বান আসছে। ২৮ জানুয়ারি স্কুল খুলে দেওয়ার আহ্বান জানায় ইউনিসেফ। এ ধারাবাহিকতায় ভারতের দিল্লিতে বন্ধ থাকা স্কুল, কলেজ, কোচিং ইনস্টিটিউটসহ সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সোমবার (৭ ফেব্রুয়ারি) থেকে খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। শুক্রবার দিল্লিতে সরকারের এক বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত হয়।
বাংলাদেশে অবশ্য এখনো এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়নি। চলতি মাসের ৬ তারিখে শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান খোলার কথা থাকলেও আরও দুই সপ্তাহ বন্ধ দীর্ঘায়িত করা হয়েছে।