নিজস্ব প্রতিবেদক :
সরকার প্রচুর অর্থ ব্যয় করলেও নদীভাঙন ঠেকানো যাচ্ছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) মাধ্যমে নদীর তীর রক্ষায় ও বিভিন্ন স্থানে বাঁধ নির্মাণে প্রচুর অবকাঠামো গড়ে তোলা হয়েছে এবং হচ্ছে। কিন্তু ওই অনুপাতে সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। মূলত সমন্বিত পরিকল্পনার অভাব এবং অনিয়ম দুর্নীতির ফলে নদী রক্ষায় নির্মিত বাঁধ কিছুদিনের মধ্যেই ভেঙে যায়। প্রতি বছরই বাঁধ ভাঙছে এবং আবার তা মেরামত করা হয়। এমন পরিস্থিতিতে ভাঙন রোধে দেশে আজও টেকসই বাঁধ নির্মাণ সম্ভব হয়নি। পরিবেশবিদ এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, নদীভাঙন হচ্ছে সবচেয়ে ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ। বছরজুড়েই তা নানা গতিতে চলে। আর প্রতি বছরই নদী ভাঙনে বসতভিটা জায়গা-জমি সব হারিয়ে নিঃস্ব হচ্ছে বিপুলসংখ্যক মানুষ। প্রতিনিয়ত নদীগর্ভে বিলীন হচ্ছে রাস্তা-ঘাট, হাট-বাজার, স্কুল-কলেজ, মসজিদ-মাদ্রাসা, কবরস্থানসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের এক জরিপের তথ্যানুযায়ী নদী ভাঙনে প্রতিবছর প্রায় ৬ হাজার হেক্টর জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়। আর চলতি বছরই দেশের উত্তর ও মধ্যাঞ্চলের ১২ জেলার ১ হাজার ৮০০ হেক্টর জমি নদীতে বিলীন হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। তাতে ফসলি জমির পাশাপাশি প্রায় ১৮ হাজার মানুষ ঘরবাড়ি হারাতে পারে। এ দেশের আর্থসামাজিক ব্যবস্থাকে অন্য দুর্যোগের চেয়ে নদীভাঙনই বেশি মাত্রায় ধ্বংস করছে। কিন্তু ভাঙন মোকাবিলায় প্রস্তুতি ও উদ্যোগের ঘাটতি রয়েছে। মূলত নদীভাঙন রোধে সমন্বিত ও পরিকল্পিত উদ্যোগের বদলে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে।
সূত্র জানায়, দেশে চলতি বছর ভরা বর্ষায় তেমন কোনো বন্যা হয়নি। ফলে অন্যান্য বছরের মতো এবার জুলাই-আগস্টে দেশের উত্তর ও মধ্যাঞ্চলের জেলাগুলোতে নদীভাঙন ভয়াবহ রূপে দেখা যায়নি। তারপরও ওসব অঞ্চল ভাঙনের ঝুঁকিতে রয়েছে। গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড জিওগ্রাফিক্যাল ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (সিইজিআইএস) পূর্বাভাস বলছে, এ বছর দেশের উত্তর ও মধ্যাঞ্চলের ১২ জেলার ১ হাজার ৮০০ হেক্টর জমি নদীতে বিলীন হতে পারে। তাতে ফসলি জমির পাশাপাশি প্রায় ১৮ হাজার মানুষ ঘরবাড়ি হারাতে পারে। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন সংস্থা সিইজিআইএস মূলত যমুনা, গঙ্গা ও পদ্মা অববাহিকার সম্ভাব্য ভাঙনপ্রবণ এলাকাগুলো চিহ্নিত করে থাকে। অনুমান করা হচ্ছে এবার যমুনায় ১৪টি স্থানে, গঙ্গার ৭টি ও পদ্মার ১টি স্থানে ভাঙন বেশি হতে পারে বলে। সিইজিআইএসের পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, এবার দেশের উত্তর ও মধ্যাঞ্চলের জেলাগুলোতে ভাঙন বেশি হবে। জেলাগুলো হলো- কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, জামালপুর, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ, পাবনা, কুষ্টিয়া, রাজবাড়ী, রাজশাহী, ফরিদপুর ও মাদারীপুর। ওসব জেলার ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার মধ্যে ১৬৫ হেক্টরে মানুষের বসতি আছে। তাছাড়া ২ হাজার ৭৯০ মিটার বেড়িবাঁধ, ২ হাজার ২৬৫ মিটার সড়কপথ ভাঙনের কবলে পড়তে পারে। তার মধ্যে জেলা, উপজেলা ও গ্রামীণ সড়ক রয়েছে। আর ভাঙনের ঝুঁকিতে থাকা অবকাঠামোর মধ্যে রয়েছে ২৭টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভবন, ১৬টি মসজিদ ও ৫টি হাটবাজার, ২টি কবরস্থান, ২টি বেসরকারি সংস্থার কার্যালয়, এতিমখানা, বাসস্ট্যান্ড ও স্বাস্থ্যকেন্দ্র। তার মধ্যে মাদারীপুরের ৫১৫ হেক্টর, কুষ্টিয়ার ২১৫ হেক্টর এবং টাঙ্গাইল ও সিরাজগঞ্জের প্রায় ২০০ হেক্টর এলাকায় সবচেয়ে বেশি ভাঙনের ঝুঁকিতে রয়েছে।
সূত্র আরো জানায়, নদী ভাঙনের জন্য বন্যার পানির ¯্রােত ও নদী থেকে অপরিকল্পিতভাবে বালু তোলা দায়ি। মূলত বন্যার পানি নেমে যাওয়ার সময় নদী তীরবর্তী যেসব এলাকার মাটিতে বালুর পরিমাণ বেশি থাকে, সেসব এলাকায় ভাঙন বেশি হয়। পদ্মা ও যমুনার তীরে ওই ধরনের মাটি বেশি থাকায় ভাঙনও বেশি হচ্ছে।
এদিকে নদী ভাঙন প্রসঙ্গে সিইজিআইএসের নির্বাহী পরিচালক মালিক ফিদা আবদুল্লাহ খান জানান, সিইজিআইএসের পক্ষ থেকে নিয়মিত ভাঙনের সম্ভাব্য শিকার এলাকাগুলো চিহ্নিত করে সরকারকে তথ্য দেয়া হয়। আর সরকার থেকে অগ্রাধিকার বিবেচনায় গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলোর ভাঙন রোধে ব্যবস্থা নেয়া হয়। কিন্তু দেশের অনেক এলাকায় অপরিকল্পিত বালু উত্তোলনের কারণে হঠাৎ ভাঙন বেড়ে যায়। সেজন্য যথাযথ বৈজ্ঞানিক সমীক্ষার ভিত্তিতে কোনো এলাকা থেকে কী পরিমাণে বালু উত্তোলন করা যাবে তার একটি কঠোর নিয়ম থাকা প্রয়োজন।