নিজস্ব প্রতিবেদক :
বন্ড সুবিধার অপব্যবহার করে রাজধানীর লালবাগের নাহিদ এন্টারপ্রাইজ নামের একটি প্রতিষ্ঠান খোলা বাজারে মালামাল বিক্রি করে ২৭৫ কোটি টাকা ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে বলে তথ্য পেয়েছে ভ্যাট গোয়েন্দা অধিদপ্তর। এ ঘটনায় প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে ভ্যাট ফাঁকির মামলা করা হয়েছে। পাশাপাশি চোরাচালান ও শুল্ক ফাঁকি সংক্রান্ত মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ও আয়কর ফাঁকির অভিযোগ তদন্তের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সোমবার দুপুরে নিরীক্ষা, গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের (মূল্য সংযোজন কর) মহাপরিচালক ড. মইনুল খান এ তথ্য জানিয়েছেন। তিনি জানান, ভ্যাট গোয়েন্দা অধিদপ্তর লালবাগের নাহিদ এন্টারপ্রাইজের ব্যবসায়িক কার্যক্রম তদন্ত করে বন্ড সুবিধার অপব্যবহার করে ২৭৫ কোটি ৩২ লাখ টাকা ভ্যাট ফাঁকির তথ্য উদঘাটন করেছে। একইসঙ্গে চোরাচালান ও শুল্ক ফাঁকি সংক্রান্ত মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ও আয়কর ফাঁকির অভিযোগ তদন্তের জন্য উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ভ্যাট ফাঁকির প্রমাণ পাওয়ায় প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে ভ্যাট আইনে মামলা দায়ের করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, নাহিদ এন্টারপ্রাইজের বিরুদ্ধে ভ্যাট ফাঁকির একটি গোপন সংবাদের ভিত্তিতে ভ্যাট গোয়েন্দা দপ্তরের অনুসন্ধান কার্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। পরবর্তীতে এ অনুসন্ধানের প্রয়োজনে প্রতিষ্ঠানটির ২০১৫ সালের জুলাই থেকে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত সময়ের ভ্যাট সংক্রান্ত দলিলাদি চেয়ে কয়েক বার চিঠি দেওয়া হয়। কিন্তু প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ এ অনুসন্ধানের জন্য দলিলাদি না পাঠিয়ে চিঠি দিয়ে বারবার সময় চেয়ে কালক্ষেপণ করে। দলিলাদি দাখিল করে তদন্তকাজে সহযোগিতা না করায় প্রতিষ্ঠানটিতে চলতি বছরের ১৭ জুন মাসে ভ্যাট গোয়ন্দা দপ্তরের উপ-পরিচালক তানভীর আহমেদের নেতৃত্বে নিবারক কার্যক্রম চালিয়ে ভ্যাট সংক্রান্ত বাণিজ্যিক দলিলাদি জব্দ করা হয়। অনুসন্ধানে ভ্যাট গোয়েন্দা দল দেখতে পায়, নাহিদ এন্টারপ্রাইজ অন্যান্য বন্ডেড প্রতিষ্ঠান থেকেও বন্ড সুবিধার অপব্যবহারের পণ্য ক্রয়-বিক্রয়ের সঙ্গে জড়িত ছিল। এর ফলে চোরাচালান ও শুল্ক ফাঁকি সংশ্লিষ্ট মানি লন্ডারিং অপরাধ সংঘটিত হয়েছে মর্মে অনুসন্ধান টিমের কাছে প্রতীয়মান হয়। এ প্রতিষ্ঠানে ভ্যাট গোয়েন্দার অভিযানে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানটি মূসক-৬.৩ চালান ব্যতীত সেবা দিয়ে যথাযথ রাজস্ব পরিশোধ না করে প্রকৃত বিক্রয় তথ্য অন্যত্র গোপন দলিলে সংরক্ষণ করে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে সরকারের আর্থিক ক্ষতিসাধন করেছে। তদন্ত মেয়াদে ২০১৬ সালের জুলাই থেকে ২০২১ সালের মে পর্যন্ত প্রায় পাঁচ বছরে প্রতিষ্ঠানটি দাখিলপত্রে বিক্রয়মূল্য প্রদর্শন করেছে ২৯১ কোটি ৮৯ লাখ ৬৬ টাকা। কিন্তু জব্দ করা দলিলাদির ভিত্তিতে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানটির প্রকৃত বিক্রয়মূল্য এক হাজার ৫৪০ কোটি ২৬ লাখ ৬৩ হাজার ২২ টাকা। যার মধ্যে মূসক আরোপযোগ্য বিক্রয়মূল্য ছিল এক হাজার ৩৩৯ কোটি ৩৬ লাখ ২০ হাজার ১৯ টাকা। এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটি এক হাজার ৪৭ কোটি ৪৭ লাখ ১৯ হাজার ৯৫৪ টাকার প্রকৃত বিক্রয়মূল্য গোপন করেছে। বিক্রয়মূল্য কম প্রদর্শন করায় অপরিশোধিত ভ্যাট বাবদ ১৫৭ কোটি ১২ লাখ ৭ হাজার ৯৯৩ টাকা উদঘাটন করা হয়। যার ওপর মাসভিত্তিক ২ শতাংশ হারে ১১৮ কোটি ১৯ লাখ ৯৪ হাজার ২৪২ টাকা সুদসহ মোট ভ্যাট ফাঁকির পরিমাণ ২৭৫ কোটি ৩২ লাখ ২ হাজার ২৩৫ টাকা। প্রতিষ্ঠানটি এই পাঁচ বছরে দাখিলপত্রের মাধ্যমে মোট ভ্যাট পরিশোধ করেছে ৪৩ কোটি ৭৮ লাখ ৩৫ হাজার ১০ টাকা। কিন্তু ভ্যাট গোয়েন্দার তদন্তে একই সময়ে ভ্যাট ফাঁকির পরিমাণ পাওয়া যায় ১৫৭ কোটি ১২ লাখ টাকা। এই বিপুল পরিমাণ রাজস্ব ফাঁকি দেওয়ায় স্পষ্ট হয় যে, প্রতিষ্ঠানটি নানা ধরনের অবৈধ লেনদেনের সঙ্গে জড়িত হয়েছে- এমটাই মনে করছে ভ্যাট গোয়েন্দারা। ভ্যাট গোয়েন্দারা তদন্তে প্রতিষ্ঠানের দুটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে মোট এক হাজার ৫৪০ কোটি ২৬ লাখ ৬৩ হাজার ২২ টাকার লেনদেনের তথ্য পেয়েছে। অবৈধ বন্ডেড পণ্য ক্রয়-বিক্রয়ের অর্থ এসব লেনদেনে সংঘটিত হয়েছে মর্মে তদন্তে উঠে এসেছে। প্রতিষ্ঠানের নামে প্রাইম ব্যাংকের মৌলভীবাজার শাখা ও উত্তরা ব্যাংকের চকবাজার শাখায় দুটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট রয়েছে। নিরীক্ষা, গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. মইনুল খান জানান, বন্ড সুবিধার অপব্যবহারের পণ্য যথাযথভাবে ঘোষণা না দিয়ে খোলাবাজারে ক্রয়-বিক্রয় করা ভ্যাট ও কাস্টমস আইন অনুসারে অপরাধ। ভ্যাট আইনের পাশাপাশি কাস্টমস আইনের অপরাধ যথাযথভাবে তদন্ত ও প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নিতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের এখতিয়ার সম্পন্ন হওয়ায় শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরকে এ বিষয়ে অনুরোধ করা হয়েছে। অন্যদিকে, ভ্যাট গোয়েন্দার অনুসন্ধানে প্রাপ্ত ভ্যাট ফাঁকির সংশ্লেষে আয়কর ফাঁকির অভিযোগটি আরও গভীরভাবে তদন্ত ও ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স সেলকে (সিআইসি) অনুরোধ করা হয়েছে। ড. মইনুল খান জানান, তদন্তে উদঘাটন হওয়া পরিহার করা ভ্যাট আদায়ের আইনানুগ পরবর্তী কার্যক্রম গ্রহণের লক্ষ্যে মামলাটি সংশ্লিষ্ট ভ্যাট কমিশনারেটে পাঠানো হয়েছে। একইসঙ্গে প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম আরও মনিটরিং করার জন্যও সংশ্লিষ্ট ভ্যাট কমিশনারকে অনুরোধ করা হয়েছে। এ ছাড়া বন্ড সুবিধার অপব্যবহার রোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য ঢাকা বন্ড কমিশনারকেও অনুরোধ করা হয়েছে।