নিজস্ব প্রতিবেদক :
দ্রব্যমূল্যের টানা ঊর্ধ্বগতিতে ক্রেতার মাথায় হাত বিগত কয়েকমাস ধরে। চাল, আটা, পেঁয়াজ, চিনি, সয়াবিন তেল, আলুসহ বিভিন্ন ভোগ্যপণ্য বাড়তি দামেই কিনতে হচ্ছে ক্রেতাদের। বাজার নিয়ন্ত্রণে ফলপ্রসূ হচ্ছে না সরকারের কোনো পলিসি। মন্ত্রণালয়ের ঠিক করা দামেও পণ্য পাওয়া অনেকটা সোনা হরিণ। নুন আনতে এখন পান্তা ফুরাচ্ছে মধ্যবিত্ত এমনকি উচ্চ মধ্যবিত্তদেরও। সূত্র জানায়, বেশ লম্বা সময় ঊর্ধ্বমুখী থাকার পর দুই সপ্তাহ ধরে বিশ্ববাজারে কমতে শুরু করেছে নানা ধরনের ভোগ্যপণ্যের দাম। সাধারণত বিশ্ববাজারে নিত্যপণ্যের দাম বাড়লে বাংলাদেশের বাজারেও দাম বেড়ে যায়। কিন্তু এখন নিম্নমুখী প্রবণতা শুরু হলেও তার রেশ পড়েনি দেশের বাজারে। এর কারণ হিসেবে আমদানিকারক ও ট্রেডিং পর্যায়ে সরবরাহ চেইনের দীর্ঘসূত্রতাকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা। জানা যায়, ব্যবসায়ীরা সাধারণত পণ্যবাজারের পাইকারিতে নিয়মিত ডিও (ডেলিভারি অর্ডার) সরবরাহ করে বাজার থেকে অর্থ তুলে নেন। পণ্য আমদানির পর বিভিন্ন তারিখে ইস্যু করা ডিওগুলোর বিপরীতে মিল বা কারখানা থেকে পণ্য সরবরাহ করেন তারা। এ সময়ের মধ্যে এসব ডিও পাইকারি পর্যায়ে ট্রেডিং প্রতিষ্ঠান ও ডিও ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে বিভিন্ন হাত ঘুরে প্রকৃত ক্রেতার কাছে পৌঁছে। ততদিনে নির্ধারিত পণ্যটির দাম মূল দামের চেয়ে অনেক বেড়ে যায়। সূত্র জানায়, এক বছর ধরে নিয়মিত ডিও সরবরাহ হলেও গত কয়েক সপ্তাহ পাইকারি বাজারে ডিও সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো। যার কারণে বর্তমানে বৈশ্বিক বুকিং মূল্য কমলেও বাংলাদেশে পণ্যের দামে প্রভাব পড়েনি। এ ছাড়া বিশ্ববাজারে দাম কমার কারণে দেশের মিল মালিকরা সরবরাহ কমিয়ে দেয়ায় ভোগ্যপণ্যের দামে কাক্সিক্ষত পরিবর্তন হয়নি বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকারের পক্ষ থেকে বাজার মনিটরিং থেকে শুরু করে পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে সঠিক কৌশল গ্রহণ করা না হলে দীর্ঘ মেয়াদে মূল্যস্ফীতির চাপ পড়বে অর্থনীতিতে। সরকারের পক্ষ থেকে চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি ৫.৩ শতাংশে ধরে রাখার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও প্রথম মাসেই লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করে গেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বুর্যোর (বিবিএস) দেওয়া তথ্য মতে, দেশে গত সেপ্টেম্বরে টানা তৃতীয় মাসের মতো মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে মূল্যস্ফীতি ছিল ৫.৩৬ শতাংশ। আগস্টে বেড়ে হয় ৫.৫৪ শতাংশ এবং সর্বশেষ সেপ্টেম্বর মাসে মূল্যস্ফীতি দাঁড়ায় ৫.৫৯ শতাংশ। অক্টোবর মাসের হিসাব এখন পর্যন্ত দিতে পারেনি বিবিএস। অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, সামনের দিনগুলোতে মূল্যস্ফীতি আরো বাড়বে। তার অন্যতম কারণ জ¦ালানি তেলের দাম বৃদ্ধি। গত ৩ নভেম্বর সরকার আন্তর্জাতিক বাজারে জ¦ালানি তেলের দাম বৃদ্ধির অজুহাতে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারে ১৫ টাকা বাড়ায়। এতে ভোক্তা পর্যায়ে এ দুই পণ্যের দাম ৬৫ থেকে বাড়িয়ে ৮০ টাকা পুনর্নির্ধারণ করা হয়। বিবিএসের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী গত সেপ্টেম্বর মাসে খাদ্য নয় এমন পণ্যের মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে ৬.১৯ শতাংশ হয়েছে। আগস্টে এটি ৬.১৩ শতাংশ ছিল। খাদ্য মূল্যস্ফীতি সেপ্টেম্বরে বেড়ে হয় ৫.২১ শতাংশ, যেটি আগস্টে ছিল ৫.১৬ শতাংশ। তারা বলছে, চাল, ডিম, গম, রসুন, পেঁয়াজ, আদা ও হলুদের দাম সেপ্টেম্বর মাসে বেড়েছে। তবে সূত্র জানায়, দুই সপ্তাহ ধরে দেশের প্রধান নিত্য ভোগ্যপণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী অবস্থায় স্থির রয়েছে। অর্থাৎ সরকারি পর্যায়ে ভোজ্যতেলের দাম নির্ধারণ করে দেয়ার পর যে দাম উঠেছে, এখনো সেই দামে বিক্রি হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভোজ্যতেল। সর্বশেষ শনিবার পাইকারি বাজারে মণপ্রতি সয়াবিন বিক্রি হয়েছে (ডিও) ৫ হাজার ৪৫০ টাকায়। তবে মিলগেট থেকে সংগ্রহযোগ্য পাম অয়েল বিক্রি হয়েছে ৫ হাজার ৪৩০ টাকায়। পাম অয়েল ডিও পর্যায়ে ৪ হাজার ৯৭০ টাকায় বিক্রি হলেও প্রস্তুত পাম অয়েল বিক্রি হয়েছে ৫ হাজার টাকায়। অন্যদিকে চিনি বিক্রি হয়েছে পাইকারিতে ২ হাজার ৬৫০ টাকায়। এ ছাড়া ইন্দোনেশিয়া-ভারত-রাশিয়ান গম বিক্রি হয়েছে ১ হাজার ২০ থেকে ১ হাজার ৩০ টাকায় এবং মণপ্রতি কানাডিয়ান ভালোমানের গম লেনদেন হয়েছে ১ হাজার ৪২০ টাকা দরে। মিলগেট থেকে সরবরাহযোগ্য ডিও নিয়ে ব্যবসায়ীরা বর্তমানে মিলগেটে গেলেও ভোজ্যতেল কিংবা গমের নির্ধারিত সময়ে সরবরাহ পাওয়া যাচ্ছে না। যার কারণে প্রতি মণ সরাসরি সরবরাহ নেয়া ভোজ্যতেল কিংবা গম নির্ধারিত দামের চেয়েও ৫০-৬০ টাকা বেশি দামে কিনছেন পাইকারি ব্যবসায়ীরা। ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিশ্ববাজারে জ¦ালানি তেলের দাম নিম্নমুখী। অপরিশোধিত জ¦ালানি তেলের দাম উল্লেখযোগ্য পরিমাণ কমে যাওয়ায় অন্যান্য পণ্যের দামেও এর প্রভাব পড়েছে। সর্বশেষ কার্যদিবসে মালয়েশিয়ান পাম অয়েলের দামও কমেছে। মূলত অপরিশোধিত জ¦ালানি তেলের ভবিষ্যৎ সরবরাহমূল্য কমে যাওয়ায় বায়োডিজেল হিসেবে আকর্ষণ হারিয়েছে পাম অয়েল। যার কারণে বিশ্বের সর্বাধিক ব্যবহূত ভোজ্যতেল পাম অয়েলের দাম দীর্ঘদিন পর নিম্নমুখী বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা। এ বিষয়ে পাইকারি ব্যবসায়ীদের ভাষ্য, বর্ধিত দামে দেশে বিপুল পরিমাণ ভোগ্যপণ্য আমদানি হয়েছে। সর্বশেষ তিন মাসে পূর্ববর্তী বছরের একই সময়ের তুলনায় বেশি ভোগ্যপণ্য আমদানি করেছেন ব্যবসায়ীরা। বর্তমানে বৈশ্বিক দাম কমে যাওয়ায় ভোগ্যপণ্যের দাম কমানো হলে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হবেন আমদানিকারকরা। যার কারণে সরবরাহ চেইনে সময়ক্ষেপণের মাধ্যমে বর্ধিত দাম ধরে রাখতে চাইছে তারা। বিশ্ববাজারে জ¦ালানিসহ বেশকিছু পণ্যের দাম কমতে শুরু করলেও সেভাবে ভোগ্যপণ্যের দাম এখনো কমেনি। জ¦ালানির দাম কমলে পরিবহন খরচও কমবে। তখন এর প্রভাব পড়বে আমদানি মূল্যে। এ ক্ষেত্রে দেশের বাজারে পণ্যের দাম কিছুটা কমে আসতে পারে। আমদানিকারকরা আগামী সপ্তাহ পর্যন্ত বিশ্ববাজারের দিকে তাকিয়ে আছেন। এ সময়ের মধ্যে দাম আরো কমলে দেশের বাজারেও এর প্রভাব পড়তে শুরু করবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধিতে তাঁরা ব্যবসায়ীদের চাতুর্যকে দায়ী করছেন। তাঁদের ভাষ্য, ‘বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সরকার কোনো কিছুর দাম বাড়ালে ব্যবসায়ীরা সেটিকে পুঁজি করে পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেন। ফলে মূল্যস্ফীতি সামনের দিনগুলোতে আরো বাড়বে।’ তিনি আরো বলেন, ‘জ¦ালানি তেলের দাম বাড়ার কারণে কৃষিসহ সব ধরনের পণ্যের উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পাবে, যার প্রভাব দীর্ঘ মেয়াদে পড়তে পারে।’
সর্বশেষঃ
বাজার নিয়ন্ত্রণহীনতায় দীর্ঘমেয়াদী মূল্যস্ফীতির শঙ্কা
-
দৈনিক আইন বার্তা
- আপডেট সময়ঃ ০৭:০৭:০৭ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৩ নভেম্বর ২০২১
- ৪৫৫ বার পড়া হয়েছে
ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ