নিজস্ব প্রতিবেদক :
দেশের ভোক্তা পর্যায়ে চালের মূল্যে কৃষকের চেয়ে মধ্যস্বত্বভোগীর ভাগ বেশি। দিন দিন আরো বঞ্চিত হয়েছে আসছে। বর্তমানে কৃষকের ভাগ্যে জুটছে ভোক্তামূল্যের মাত্র ৪১ শতাংশ। বাকি ৫৯ শতাংশই মধ্যস্বত্বভোগীদের কাছে যাচ্ছে। তার মধ্যে চালকল মালিকদের পকেটেই থাকছে বড় অংশ। অথচ দু’দশক আগেও চালের ভোক্তামূল্যের প্রায় ৬৫ শতাংশই কৃষক পেতো। বাংলাদেশ ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (ব্রি) কয়েকজন বিজ্ঞানী চালের ভোক্তামূল্যে কৃষকের অংশ নিয়ে সম্প্রতি এক গবেষণা চালিয়েছে। ওই গবেষণায় ভোক্তামূল্যে চালের সরবরাহ চেইনের সঙ্গে যুক্ত প্রতিটি পক্ষের যৌক্তিক বণ্টন সম্পর্কে একটি ধারণা দেয়া হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, ভোক্তামূল্যের কমপক্ষে ৫৫ শতাংশ কৃষক বা উৎপাদনকারীর পাওয়া উচিত। বাকি অংশের মধ্যে ধানের ফড়িয়া ৭ শতাংশ, মিলার ২৫ ও চালের ফড়িয়া ১৩ শতাংশ পেতে পারে বলে অভিমত দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠান (ব্রি) সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, নানা ধরনের মধ্যস্বত্বভোগীর উত্থানের কারণেই বঞ্চিত হচ্ছে কৃষক। গত দুই দশকে কৃষকের অবস্থান নাজুক হয়েছে আর চালকল মালিকদের অবস্থান আরো শক্তিশালী হয়েছে। ২০০০ সালেও ভোক্তামূল্যে চালকল মালিকের ভাগ ছিল ২০ শতাংশ। ২০১৯ সালের মধ্যেই তা ৩৫ শতাংশ ছাড়িয়েছে। ধান উৎপাদনের জন্য মৌসুমের শুরুতেই কৃখশকে বিভিন্ন ধরনের ঋণ ও বাকিতে উপকরণ সংগ্রহ করা হয়। কৃষকদের আর্থিক অসংগতি ও মজুদক্ষমতা না থাকায় বাধ্য হয়েই মৌসুমের শুরুতেই তারা স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কাছে ধান বিক্রি করে দেয়। মূলত দেনা পরিশোধের চাপ থাকায় মৌসুমের শুরুতেই কম দামে ধান বিক্রি করে দেয় কৃষক। আর চালকল মালিক ও ফড়িয়ারা তার সুযোগ নিচ্ছে। মিলারদের বড় সুবিধা হলো বাজার থেকে সবচেয়ে কম দামে ধান কেনার সক্ষমতা। পরবর্তী সময়ে ওই ধান প্রক্রিয়াজাত করে সরকারের কাছে বা বাজারে চালকল মালিকরা বিক্রি করছে। গত কয়েক দশকে দেশে হাইব্রিড ধান আবাদ ও উৎপাদন বেড়েছে। কিন্তু বাজারে ওই ধানের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ক্রেতা না থাকায় চালকল মালিকরা অনেক ক্ষেত্রেই তা কম দামে কিনতে পারে। পরবর্তী সময়ে ওই ধান প্রক্রিয়াজাত করে উচ্চমূল্যে সরকারের কাছে বিক্রির মাধ্যমে অপ্রত্যাশিত মুনাফা করছে চালকল মালিকরা। তাতে কৃষক যেমন বঞ্চিত হচ্ছে, তেমনি সাধারণ ভোক্তাদেরও ব্যয় বাড়ছে।
সূত্র জানায়, কৃষকের যৌক্তিক মূল্যপ্রাপ্তি নিশ্চিত করতে বাজার ব্যবস্থাপনা উন্নয়নের পাশাপাশি মৌসুমের শুরুতে ধানের দাম নির্ধারণ করা হলে ভালো হতো। আর মৌসুমের শুরুতেই কৃষকরা যাতে ধান মজুদ বা সংরক্ষণ করতে পারে সে ব্যবস্থাও নেয়া প্রয়োজন। একই সঙ্গে বাজার তদারকির দায়িত্বে থাকা বিপণন অধিদপ্তরকেও শক্তিশালী করা জরুরি। তাহলেই দাম নির্ধারণে একপক্ষীয় ভূমিকা কমে আসতে পারে। বর্তমান সরকারের নানা কার্যক্রম ইতিমধ্যে ডিজিটালাইজড হয়েছে। সরকারি সংগ্রহ প্রক্রিয়ায় ওই সুবিধা বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। মূলত কৃষক ও ভোক্তা উভয়ের স্বার্থকেই গুরুত্ব দেয়া জরুরি। আর এ দুয়ের মধ্যে সমন্বয় করেই নীতি সিদ্ধান্ত নিতে হবে। পাশাপাশি মধ্যস্বত্বভোগীদের যৌক্তিক আচরণ নিশ্চিতে তদারকি আরো বাড়াতে হবে।
সূত্র আরো জানায়, দীর্ঘদিন ধরেই সরকারের মজুদ সক্ষমতা বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আলোচনা চলছে। তাছাড়া কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি ধান কেনার প্রচলন ঘটানোরও দাবি উঠেছে। চিকন ও মোটা দানার চালের জন্য সরকারের পৃথক ন্যূনতম সহায়তা মূল্য (এমএসপি) ঘোষণা করা প্রয়োজন। তাছাড়া খাদ্য অধিদপ্তরেরও অন্তত মোট উৎপাদনের প্রায় ১০ শতাংশ সংগ্রহ করার সক্ষমতা অর্জনের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। কিন্তু অভিযোগ রয়েছে, চালকল মালিকরা তাদের মুনাফা দেখানোর সময় এক ধরনের চালাকির আশ্রয় নেয়। অনেক সময় উপজাত দ্রব্য ভালো দামে বিক্রি করলেও তার হিসাব না দেখিয়েই তারা দাবি করে, মুনাফা হচ্ছে না। আর ওই বক্তব্যের ভিত্তিতে তারা সরকারের কাছ থেকে বাড়তি সুবিধা আদায়েরও চেষ্টা করে। এমন অবস্থায় চালকল মালিক পর্যায়েও কার্যকর উৎপাদন খরচ ও মুনাফার যৌক্তিক হার নির্ধারণ করে দেয়া প্রয়োজন।
এদিকে বিশেষজ্ঞদের মতে, বিপণন ব্যবস্থায় কৃষক, ভোক্তা ও মধ্যস্বত্বভোগী সবার স্বার্থই রক্ষা করতে হবে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে চালের দাম নির্ধারণ ও বিপণন প্রক্রিয়ায় মধ্যস্বত্বভোগী, বিশেষ করে চালকল মালিকরা ভীষণ শক্তিশালী ও পারদর্শী। কারণ বাজার তৈরি ও নিয়ন্ত্রণে কৃষকের কোনো ধরনের সাংগঠনিক সক্ষমতা নেই। আবার সরকারের কর্তৃপক্ষ হিসেবে খাদ্য অধিদপ্তরের কাছে ওই দক্ষতা ও হাতিয়ার নেই। ফলে ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে উদ্যোগগুলো কার্যকর হচ্ছে না। সরকারের সংগ্রহ নিতান্তই কম। ফলে ওই সংগ্রহ বাজারে বড় ধরনের প্রভাব রাখতে পারছে না। সেজন্যই কৃষককে কীভাবে শক্তিশালী করা যায় সে বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সেক্ষেত্রে সাপ্লাই চেইনে আরো দক্ষতা বৃদ্ধি এবং কৃষকের মজুদক্ষমতা বাড়ানো ও তথ্য সরবরাহ করা প্রয়োজন। তাছাড়া সঠিক নীতির অভাবে সরকারের বিভিন্ন মাধ্যম চাল কেনার ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের দিয়ে প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রিত হতে দেখা যায়। বাজার থেকে ধান না কেনার কারণে চালকল মালিকদের কাছেই ধানের বাজারে একচ্ছত্র আধিপত্য তুলে দেয়া হয়। ফলে বাজার থেকে ধান সংগ্রহের কোনো বিকল্প নেই। ধানের এতো বড় বাজার এককভাবে চালকল মালিকদের কাছে রাখা মোটেও যৌক্তিক নয়। তাই কৃষকের যৌক্তিক দাম দেয়ার ক্ষেত্রে সরকারের সংগ্রহ কার্যক্রমে যেমন দক্ষতা আনা প্রয়োজন, তেমনি সামগ্রিক প্রক্রিয়ায় কৃষকের মর্যাদাকেও প্রাধান্য দেয়া জরুরি। পাশাপাশি ভোক্তাস্বার্থ যাতে রক্ষা পায় সেদিকেও নজর রাখতে হবে।
অন্যদিকে এ প্রসঙ্গে ব্রি’র মহাপরিচালক ড. মো. শাহজাহান কবীর জানান, বাজারে চাল সরবরাহে কোনো ধরনের সংকট তৈরি না হওয়া সত্ত্বেও দামের ক্ষেত্রে অস্থিতিশীলতা দেখা দেয়। মূলত বিভিন্ন মধ্যস্বত্বভোগীর অনিয়ন্ত্রিত উত্থানের কারণেই তা হচ্ছে। প্রথাগত চাহিদা ও জোগানের পরিবর্তে এখানে সরকারের বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের ভূমিকার প্রয়োজন রয়েছে। সেক্ষেত্রে কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি ধান কেনার কোনো বিকল্প নেই। ধান কেনায় আর্দ্রতা নিয়ে সমস্যা আসতে পারে। ওই প্রতিবন্ধকতা মেটাতে হলে আর্দ্রতা অনুসারে দাম নির্ধারণ করে কৃষকের কাছ থেকেই কিনতে হবে। আর্দ্রতা কমাতে একটি প্রক্রিয়া তৈরি করা প্রয়োজন।