• শুক্রবার, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:২৫ অপরাহ্ন
  • ই-পেপার

মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা প্রকল্পে নিয়োজিত থাকায় ব্যাহত হচ্ছে রেলপথের স্বাভাবিক কার্যক্রম

Reporter Name / ৫২৫ Time View
Update : সোমবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২১

নিজস্ব প্রতিবেদক :
রেলের বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকান্ড ব্যবস্থাপনার সঙ্গে মাঠপর্যায়ের বিপুলস্যংখক কর্মকর্তা জড়িত। ফলে রেলপথের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। ফলে প্রায় প্রতিদিনই দেশের কোনো না কোনো এলাকায় লাইনচ্যুত হয়ে রেলরুট আটকে যাচ্ছে। প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ছে যাত্রীসেবা আর নিরাপদ বাহনের দুর্ঘটনার ঝুঁকি নিয়ে যাত্রীরা আতঙ্কিত হয়েছে পড়ছে। রেল সংশ্লিষ্টদের মতে, রেলের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রকল্পের কাজেই বেশি মনোযোগী হওয়ায় রেলওয়ের দৈনন্দিন কার্যক্রমে তারা তেমন নজর দিচ্ছে না। মূলত রেলের গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তারা প্রকল্পমুখী হয়ে পড়ায় তাদের কার্যকরী সেবা পাচ্ছে না রেল। ফলে রেল পরিচালনায় তার প্রভাব পড়ছে। বাংলাদেশ রেলওয়ে সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বর্তমানে বাংলাদেশ রেলওয়ের চলমান ৩৯টি প্রকল্পে প্রকল্প পরিচালকসহ (পিডি) প্রায় সাড়ে ৪শ’ কর্মী বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকান্ড ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত। সারা দেশে রেলওয়ের সেবা বিস্তৃতির লক্ষ্যে বর্তমান সরকার রেলে ব্যাপক উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। প্রায় ৯৯ শতাংশ প্রকল্পেই প্রকল্প পরিচালক এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা হচ্ছে রেলের বিভিন্ন পর্যায়ের প্রকৌশলী ও কর্মকর্তা। অথচ বিভিন্ন প্রকল্পের পরিচালক এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা রেলপথ এবং ট্রেন পরিচালনার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত। তাদের কর্মদক্ষতার ওপরই রেলের অপারেশনাল সাফল্য নির্ভর করে। কিন্তু প্রকল্পে মনোযোগী হওয়ার কারণে ওসব কর্মকর্তা শতভাগ সময় প্রকল্পে, রেললাইন এবং ট্রেন পরিচালনায় দিতে পারছে না। যা রেলের সংকট আরো বাড়িয়ে তুলছে। সেজন্য রেলের বাইরে থেকে উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক নিয়োগ দেয়ার কথা উঠেছে। আবার অনেকের মতে, রেলের অভিজ্ঞ জনবল প্রকল্প তদারকিতে না থাকলে ঠিকাদারদের কাছ থেকে মানসম্পন্ন কাজ আদায় করাও কঠিন হবে। সেক্ষেত্রে রেলের অবসরে যাওয়া কর্মীদের একটা অংশকে প্রকল্পে যুক্ত করা যায় কিনা তা ভেবে দেখার কথাও বলা হচ্ছে।
সূত্র জানায়, রেলওয়ের চলমান বিভিন্ন প্রকল্পের পরিচালক এবং প্রকল্পের অন্যান্য দায়িত্বের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকতেই রেলওয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বেশি আগ্রহী। চলতি ২০২০-২০২১ অর্থবছরে মোট ৩৯টি প্রকল্পের সঙ্গে ৩৮ জন প্রকল্প পরিচালকসহ প্রায় সাড়ে ৪শ’ রেল কর্মকর্তা ও প্রকৌশলী কাজ করছে। তাদের মধ্যে রেলওয়ের অনেক গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাও রয়েছে। প্রতিটি প্রকল্পে রেলের প্রায় ১০ থেকে ১৫ জন কর্মকর্তা কাজ করছে। রেলপথ রক্ষণাবেক্ষণ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে রেলের দুই অঞ্চলের (পূর্ব ও পশ্চিম) প্রধান প্রকৌশলীর দায়িত্ব সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু পূর্ব ও পশ্চিম জোনের দুই প্রধান প্রকৌশলী দুটি প্রকল্পের পরিচালক। একইভাবে দুই জোনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলীগণও দুটি প্রকল্পের পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছে। এভাবে রেলওয়ের অনেক গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা ও প্রকৌশলী বিভিন্ন প্রকল্পের পরিচালক ও অন্যান্য পদে দায়িত্ব পালন করছে। ফলে সুষ্ঠু রক্ষণাবেক্ষণ ও মনোযোগের অভাবে রেলে দুর্ঘটনা, লাইনচ্যুতি, শিডিউল বিপর্যয় স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। দুর্ঘটনায় প্রাণহানির মতো ঘটনাও ঘটছে। অথচ রেলওয়ে কারিগরি উৎকর্ষতার মধ্য দিয়ে অ্যানালগ থেকে সম্পূর্ণ কম্পিউটারাইজড ও প্যানেল বোর্ড নিয়ন্ত্রিত হয়েছে। কিন্তু আধুনিক জনবলের অভাবে প্রযুক্তির সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। তাছাড়া রেল পরিচালনায় যুক্ত ব্যক্তিদের স্বার্থের দ্বন্দ্বেও রেলপথে প্রযুক্তির ব্যবহার করা যাচ্ছে না।
সূত্র আরো জানায়, বিভিন্ন প্রকল্পে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার সুযোগ থাকায় কর্মকর্তারা প্রকল্পের প্রতিই বেশি ঝুঁকছে। রেলপথ-ইঞ্জিন-কোচ যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ না হওয়ায় ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকান্ডের মধ্যেও রেলপথ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে। প্রায় নিয়মিত দুর্ঘটনা বাড়ছে। করোনা প্রতিরোধের লকডাউন শেষে গত ১১ আগস্ট রেল যোগাযোগ চালু হলে তার পরদিনই দুর্ঘটনায় পড়ে রেল। গাজীপুরের ধীরাশ্রম রেলওয়ে স্টেশন কমিউটার ট্রেনের ইঞ্জিন লাইনচ্যুত হওয়ার ৩ ঘণ্টা পর রেল যোগাযোগ স্বাভাবিক হয়। মূলত রেললাইনে পাথর না থাকায় লাইনচ্যুতির ঘটনা ঘটে। অথচ নিয়ম অনুযায়ী রেললাইন ছুঁই ছুঁই পর্যায়ে পাথর থাকার কথা। কিন্তু রেলপথে মাইলের পর মাইল পর্যাপ্ত পাথর নেই। আবার লাইনের অনেক জায়গায় নাট-বল্টু-ক্লিপ-ফিশপ্লেট খোলা রয়ে যাচ্ছে। রেলওয়ের মাঠপর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা কর্মকর্তাদের প্রায় ৮০ শতাংশই বিভিন্ন প্রকল্পের কাজে নিয়োজিত। ফলে প্রকল্পে সম্পৃক্ত ওসব কর্মকর্তাকে মাঠপর্যায়ে কাজে পাওয়া যায় না। তাতে ট্রেন পরিচালনা কিংবা রেলপথ রক্ষণাবেক্ষণে বিঘœ ঘটছে।
এদিকে বর্তমান সরকারের আমলে ২০০৯-২০১৯ সময়ের গত ১১ বছরে ১৩৮টি নতুন ট্রেন চালু হয়েছে। ওসব ট্রেন পুরাতন, আয়ুষ্কাল শেষ হয়ে যাওয়া ইঞ্জিন দিয়ে অপারেশনে আনা হয়। ফলে রেল পরিচালনায় কাক্সিক্ষত গতি পাওয়া যাচ্ছে না। বিশেষজ্ঞদের মতে, রেলের প্রকল্পে কাজ করার ব্যাপারেই কর্মকর্তাদের আগ্রহ বেশি। ফলে রেলের অপারেশনাল কার্যক্রমে তাদের মনোযোগ কম। এমন অবস্থায় প্রকল্প গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে প্রকল্প পরিচালক এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বাইরে থেকে আনার বিষয়ে উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। তার ফলে চলমান রেলপথ এবং ট্রেন পরিচালনার ক্ষেত্রে নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। রেলপথ মন্ত্রণালয় রেলের প্রকল্পে প্রকল্প পরিচালক (পিডি) সংস্থার বাইরে থেকে আনতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে লিখিতভাবে জানানো হয়েছিল। কিন্তু ওই অনুরোধ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের পিডি সেলে গুরুত্ব পায়নি। তবে পদ্মা রেলসেতু লিংক প্রকল্পে রেলওয়ের বাইরে থেকে পিডি নেয়া হয়েছে।
অন্যদিকে রেলওয়ের সাবেক কর্মকর্তাদের মতে, রেলে দুর্ঘটনা রোধ করতে হলে রেলপথ ও ট্রেনের রক্ষণাবেক্ষণে অগ্রাধিকার দিতে হবে। সেজন্য লোকবল নিয়োগ ও প্রশিক্ষণ দেয়া জরুরি। মাঠপর্যায়ে থাকা কর্মকর্তাদের প্রকল্পে সম্পৃক্ত করা থেকে বিরত থাকতে হবে। দেশে রেল যাতায়াতের জন্য নিরাপদ বাহন। তবে কার্যকর রক্ষণাবেক্ষণ না করা হলে বর্তমান উন্নয়নের সুফল পাওয়া যাবে না। সাধারণ মানুষের মধ্যে এ পথ নিয়ে যে আশা-ভরসা রয়েছে তা ধরে রাখতে মাঠপর্যায়ে থাকা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শতভাগ দায়িত্ব পালন নিশ্চিত করা জরুরি। প্রতিটি সেকশনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারলে দুর্ঘটনা একেবারেই কমে আসবে।
এ প্রসঙ্গে যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক শামসুল হক জানান, রেলওয়ের প্রকল্প বাস্তবায়ন নিশ্চয়ই জরুরি। কিন্তু ওই প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে রেলপথ এবং ট্রেন পরিচালনার ক্ষেত্রে অবহেলা-দায়িত্বহীনতা খুবই ভয়ানক। তাতে রেলপথ আরো ভয়ানক হয়ে উঠবে।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category