নিজস্ব প্রতিবেদক :
মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাতক্ষীরার সাবেক এমপি ও জেলা জামায়াতের আমির আব্দুল খালেক মণ্ডলসহ দুজনের মৃত্যুদণ্ডের রায় দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। গত ২৪ মার্চ এ রায় ঘোষণা করেন ট্রাইব্যুনাল। এ মামলার অন্য আসামি খান রোকনুজ্জামান পলাতক। মুক্তিযুদ্ধের সময় খালেক মণ্ডল ছিলেন সাতক্ষীরায় রাজাকার বাহিনীর সংগঠক আর রোকনুজ্জামান ছিলেন ওই বাহিনীর সদস্য। তাদের বিরুদ্ধে খুন, ধর্ষণ, অপহরণসহ মানবতাবিরোধী ছয়টি অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় সর্বোচ্চ এ দণ্ড দেওয়া হয়।
তবে ওই রায়ের বিরুদ্ধে খালাস চেয়ে আপিল করেছেন আব্দুল খালেক মণ্ডল। নিয়ম অনুযায়ী ট্রাইব্যুনালের রায় ঘোষণার ৩০ দিনের মধ্যে আপিল করতে হয়। এরই ধারাবাহিকতায় গত ২৪ এপ্রিল সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখায় এ আবেদন করা হয়।
এছাড়াও ২০২১ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ট্রাইব্যুনালের রায়ে ময়মনসিংহ জেলার গফরগাঁও উপজেলার পাগলা থানার নিগুয়ারি ইউনিয়নের সাধুয়ার আমৃত্যু কারাদণ্ডপ্রাপ্ত মো. সামসুজ্জামান ওরফে আবুল কালাম এবং ২০ বছর করে সাজাপ্রাপ্ত মো. খলিলুর রহমান ও মো. আব্দুল্লাহ এই তিনজন আপিল আবেদন করেছেন।
সব মিলিয়ে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের ৩৪টি মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের খালাস চেয়ে করা আপিল শুনানির অপেক্ষায়। এছাড়া চূড়ান্ত নিষ্পত্তির অপেক্ষায় আরও দুই আসামির করা রিভিউ (রায় পুনর্বিবেচনা) আবেদন।
করোনাকালীন লকডাউনের কারণে মৃত্যুদণ্ডের রায়ের বিরুদ্ধে জামায়াত নেতা এটিএম আজহারুল ইসলাম ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সারের পক্ষে করা রিভিউ আবেদন শুনানির অপেক্ষায়। যদিও এরই মধ্যে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত সাবেক প্রতিমন্ত্রী জাপা নেতা সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সার চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। গত ১১ ফেব্রুয়ারি ভোরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) মারা যান তিনি।
বৈশ্বিক মহামারি করোনা ও নানা কারণে এসব আপিল এবং রিভিউ আবেদনের ওপর শুনানি হচ্ছে না গত দুই বছর। তবে করোনা পরিস্থিতির জট কাটিয়ে আবার চাঙ্গা হতে যাচ্ছে এসব মামলা।
রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল এবং ট্রাইব্যুনালের অন্যতম প্রসিকিউটরসহ সংশ্লিষ্টরা জাগো নিউজকে জানান, এখন নিয়মিত কোর্ট চালু হয়েছে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় দণ্ডিত আসামিদের করা আপিল শুনানির উদ্যোগ নেওয়া হবে।
এদিকে ট্রাইব্যুনালের রায়ের পর এখন পর্যন্ত দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে ৯টি মামলায় রায় ঘোষণার মধ্যে দিয়ে চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়েছে। আরও দুটি মামলা সর্বোচ্চ আদালতে চূড়ান্ত নিষ্পত্তির অপেক্ষায়।
ট্রাইব্যুনালের ৪৫টি রায়ে যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত চারজন, আমৃত্যু কারাদণ্ডপ্রাপ্ত হলেন ২২ জন ও স্বশ্রম কারাদণ্ড প্রাপ্ত ছয়জন। তাদের মধ্য থেকে একজন আসামি খালাস পেয়েছেন। এই হলো মোট ১২৭ জন আসামির বিচার প্রক্রিয়া।
২০১০ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর ২০১৩ সাল থেকে রায় ঘোষণা শুরু হয়। এরপর প্রতি বছর কোনো না কোনো মামলার রায় হয়। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার শুরুর পর গত ১১ বছরে ৪৫ মামলায় মোট সাজা দেওয়া হয়েছে ১১২ জনকে। এর মধ্যে মৃত্যুদণ্ড হয়েছে ৮০ জনের। আমৃত্যু কারাদণ্ড হয়েছে ২২ জনের, অন্য আসামিদের বিভিন্ন মেয়াদে দণ্ড হয়। শিশু বয়স বিবেচনায় খালাস দেওয়া হয়েছে এক আসামিকে।
সুপ্রিম কোর্টে চূড়ান্ত নিষ্পত্তি ৯টি আপিল
ট্রাইব্যুনালে রায় ঘোষণার পর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়েছে ৯টি মামলার। এর মধ্যে ছয়জন আসামির ফাঁসির দণ্ড কার্যকর হয়েছে। মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে জামায়াত নেতা মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ, মো. কামারুজ্জামান, আব্দুল কাদের মোল্লা, বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও জামায়াতের মীর কাসেম আলীর। সবশেষ কার্যকর হয়েছে ২০১৬ সালের ৩ সেপ্টেম্বর জামায়াতের মীর কাসেম আলীর ফাঁসি।
ঘোষিত রায়ের মধ্যে আপিল বিভাগে বর্তমানে বিচারাধীন ৩৪টি মামলা। প্রায় দেড় বছর আপিল বিভাগে এ মামলাগুলোর কোনো শুনানি হয়নি। এসব মামলায় মৃত্যুদণ্ডের আসামি অন্তত ৩৩ জন। এছাড়া আমত্যু কারাদণ্ডপ্রাপ্ত একজন এবং ২০ বছরের দণ্ডপ্রাপ্ত দুজন রয়েছেন।
আপিল বিভাগে পর্যায়ক্রমে শুনানির অপেক্ষায়
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ার মোবারক হোসেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জের আফসার হোসেন চুটু ও মাহিদুর রহমান, পটুয়াখালীর ফোরকান মল্লিক, বাগেরহাটের সিরাজুল হক ও খান আকরাম হোসেন, নেত্রকোনার আতাউর রহমান ননী ও ওবায়দুল হক খান তাহের, কিশোরগঞ্জের শামসুদ্দিন আহমেদ, হবিগঞ্জের মহিবুর রহমান বড় মিয়া, মুজিবুর রহমান আঙ্গুর মিয়া ও আবদুর রাজ্জাক, জামালপুরের অ্যাডভোকেট সামসুল হক ওরফে বদর ভাই ও এসএম ইউসুফ আলী এবং যশোরের সাবেক এমপি জামায়াত নেতা সাখাওয়াত হোসেন ও বিল্লাল হোসেন, নোয়াখালীর সুধারামের আমীর আলী ও জয়নাল আবেদীন, মৌলভীবাজারের উজের আহমেদ ও ইউনুছ আহমেদ, ফুলবাড়িয়ার রিয়াজউদ্দিন ফকিরসহ আরও অনেকের আপিল।
সাতক্ষীরা জেলা জামায়াতের আমির ও সাবেক এমপি আব্দুল খালেক মণ্ডল এবং ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলার পাগলা থানার সাধুয়ার আমৃত্যু কারাদণ্ডপ্রাপ্ত মো. সামসুজ্জামান ওরফে আবুল কালাম এবং রায়ে ২০ বছর করে সাজাপ্রাপ্ত মো. খলিলুর রহমান এবং মো. আব্দুল্লাহ এই তিনজনের আপিল।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ের পর দণ্ডপ্রাপ্তদের মধ্য থেকে খালাস চেয়ে করা আপিল বিভাগের পেন্ডিং মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার শুনানির বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল আবু মোহাম্মদ (এএম) আমিন উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, করোনার পরে কোর্ট খোলা হয়েছে, লকডাউনের কারণে এতদিন আদালত সীমিত আকারে চলছিল। কিন্তু ওই সময় অনেক চাঞ্চল্যকর গুরুত্বপূর্ণ মামলার শুনানি করা যায়নি। এখন যেহেতু নিয়মিত আদালত খুলছে আমরা পর্যায়ক্রমে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের মানবতাবিরোধী অপরাধের দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের করা আপিল ও রিভিউ আবেদনসহ গুরুত্বপূর্ণ এবং আলোচিত মামলাগুলো শুনানির উদ্যোগ নেবো।
এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট মো. মোমতাজ উদ্দিন ফকির জাগো নিউজকে বলেন, মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের মামলার রায়ের পরে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আসামি ও রাষ্ট্রপক্ষের করা আপিল আবেদন পেন্ডিং থাকলেও করোনা মহামারির কারণে আমরা আপিলগুলো শুনানির জন্য ভালোভাবে পদক্ষেপ নিতে পারিনি। এখন আমরা ওইসব আপিল শুনানির চেষ্টা করবো। রাষ্ট্রপক্ষ এবং আসামিপক্ষ এ উদ্যোগ নেবে বলে আশা করছি।
এ বিষয়ে প্রসিকিউটির সৈয়দ হায়দার আলী জাগো নিউজকে বলেন, ট্রাইব্যুনালে রায় ঘোষণার পর দণ্ড থেকে খালাস চেয়ে আসামিদের করা আপিল ও দণ্ড বাড়াতে রাষ্ট্রপক্ষের করা আপিল সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে রয়েছে। এগুলো নিষ্পত্তি হওয়ার দরকার। আমরা সে ব্যাপারে উদ্যোগ নেব।
এ বিষয়ে প্রসিকিউটর রানা দাশগুপ্ত জাগো নিউজকে বলেন, হবিগঞ্জের সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সারের রিভিউ আপিল বিভাগে নিষ্পত্তির কথা ছিল। কিন্তু সেটি আর হলো না। অর্থাৎ মানবতাবিরোধী আসামির বিচার প্রক্রিয়া এই মুহূর্তে মোটামুটি একটা স্ট্যান্ড স্টিলের (স্থির অবস্থায়) জায়গায় আছে।
তিনি আরও বলেন, আপিল বিভাগের মামলা শুনানির জন্য সবাইকে অপেক্ষা করতে হবে। আইনজীবী হিসেবে আমাদের কোনো দাবি না থাকলেও যারা প্রতিকারপ্রার্থী তাদের আকাঙ্ক্ষা তো আছেই। সেই সঙ্গে জনগণের আকাঙ্ক্ষা বিচার শেষ হয়ে কবে রায় কার্যকর হবে।
সূত্র-জাগোনিউজ