নিজস্ব প্রতিবেদক :
কাঁচামাল আমদানিনির্ভর দেশের সব শিল্পই মারাত্মক বিপত্তির মুখে পড়েছে। কারণ বর্তমানে আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে শিল্প খাতের কাঁচামাল আমদানির ব্যয় বেশি। তাতে একদিকে শিল্পের উৎপাদন খরচ বাড়ছে, অন্যদিকে ভোক্তা চাহিদায় নেতিবাচক প্রভাবের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে দেশের শিল্পোদ্যোক্তারা বলছেন, পরিস্থিতি যেদিকে গড়াচ্ছে তাতে সামনের দিনগুলোয় বাজারে টিকে থাকাটাই বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে তৈরি পোশাক থেকে শুরু করে ইস্পাত, কেমিক্যাল, প্লাস্টিক ও সিমেন্টসহ কাঁচামালের জন্য আমদানিনির্ভর দেশের প্রায় সব শিল্পই এখন মারাত্মক বিপত্তির মুখে রয়েছে। শিল্পখাত সংশ্লিষ্টদের সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বর্তমানে পরিবহন থেকে শুরু করে সরবরাহ চেইনের প্রতিটি স্তরেই অত্যধিক ব্যয় বেড়েছে। জ্বালানি পণ্যের দাম সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিল অ্যাসোসিয়েশনভুক্ত (বিটিএমএ) বস্ত্রকলগুলো থেকে দেশের প্রধান রফতানি পণ্য তৈরি পোশাকের নিট ক্যাটাগরির ৯০ শতাংশের বেশি সুতা-কাপড় সরবরাহ হলেও ওভেন ক্যাটাগরিতে সরবরাহ হচ্ছে ৪০ শতাংশ। আমদানির মাধ্যমে বাকিটুকু পূরণ করতে হয়। আবার আমদানির মাধ্যমে সুতা-কাপড় তৈরির প্রধান কাঁচামাল তুলার প্রায় শতভাগ চাহিদা পূরণ করতে হয়। বর্তমান পরিস্থিতিতে তুলা থেকে শুরু করে সুতা-কাপড় পর্যন্ত বস্ত্র ও পোশাক খাতের প্রায় সব কাঁচামালেরই আমদানি ব্যয় বেড়েছে। তার ধারাবাহিকতায় উৎপাদন ব্যয় বাড়ায় উদ্যোক্তাদের মুনাফার মার্জিনও কমে আসছে। পাশাপাশি উদ্যোক্তাদের বাজার সংকোচনের মতো সমস্যা মোকাবেলা করতে হচ্ছে।
সূত্র জানায়, বাংলাদেশ যুদ্ধরত রাশিয়া ও ইউক্রেন উভয় দেশ থেকেই শিল্প কাঁচামাল আমদানি করে । জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্যানুযায়ী চলতি অর্থবছরের প্রথম ৭ মাসে ওই দেশ দুটি থেকে ৬ হাজার ৪৬৯ কোটি ৫০ লাখ ৬৭ হাজার ৮৬৯ টাকার পণ্য এসেছে। তার মধ্যে রাশিয়া থেকে আমদানি হয়েছে ৩ হাজার ৪৯৬ কোটি ৫৫ লাখ টাকার পণ্য আর ইউক্রেন থেকে আমদানি হয়েছে ২ হাজার ৯৭২ কোটি ৯৬ লাখ টাকার পণ্য। ওসব পণ্যের মোট পরিমাণ ১৫ লাখ ৭৮ হাজার ৪২৫ টন। খাদ্যশস্যের সরবরাহকারী হিসেবে দেশ দুটির পরিচিতি থাকলেও আমদানি পণ্যের মধ্যে ইস্পাত, কেমিক্যাল জাতীয় পণ্যের তালিকাই বড়। রাশিয়া থেকে সিলিকা বালি, গ্রিজ, ক্রোমিয়াম টক্সাইড, লিথিয়াম অক্সাইড, হাইড্রোক্সাইড, ক্লোরাইড, ডিসোডিয়াম কার্বোনেট, পটাশিয়াম ক্লোরাইড, পেইন্ট কেমিক্যাল অ্যান্ড বার্নিশ, এক্রেলিক পেইন্ট কেমিক্যাল, পলিইথাইলিনের কাঁচামাল, রাবারের কাঁচামাল, স্টিলনেস স্টিলের কাঁচামাল ইত্যাদিই প্রচুর পরিমাণ আমদানি হয়। ওসব কেমিক্যাল ও কাঁচামাল মূলত ইস্পাত শিল্প, ভারী শিল্প ও টেক্সটাইল খাতে ব্যবহার হয়ে থাকে। দেশের বৃহৎ শিল্প খাত বিশেষত ইস্পাত খাতের জন্য ১০-১৫ ধরনের কেমিক্যালের ব্যবহার রয়েছে। স্ক্র্যাপের দাম বৃদ্ধি ছাড়াও কেমিক্যাল কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়ায় বর্তমানে দেশের বাজারে পণ্য উৎপাদনে খরচও বেড়েছে। কাচ, প্লাস্টিক পণ্য, ইস্পাত পণ্য ছাড়াও খাদ্য আনুষঙ্গিক খাতের জন্য বিভিন্ন ধরনের কেমিক্যালের প্রয়োজন হয়। কেমিক্যাল জাতীয় কাঁচামালের জন্য নির্ভরশীলতা থাকায় রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে চলমান যুদ্ধ দেশের উৎপাদনমুখী খাতে এখন প্রত্যক্ষভাবেই প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে।
সূত্র আরো জানায়, দেশের প্লাস্টিক শিল্পেও বিশ্ববাজারের অস্থিতিশীল পরিস্থিতির প্রভাব দেখা যাচ্ছে। ওই খাতের কাঁচামালের দাম ৫০ থেকে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে প্লাস্টিকের কাঁচামাল আগে যেখানে টনপ্রতি মূল্য ছিল ১ হাজার ২০০ ডলার, তা এখন ১ হাজার ৯০০ ডলারে গিয়ে ঠেকেছে। আর নির্মাণ খাতের অব্যাহত প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিকতায় দেশে বছরে ৫৫-৬০ লাখ টন রড উৎপাদন হচ্ছে। অবকাঠামো নির্মাণের গুরুত্বপূর্ণ ওই উপকরণ তৈরির কাঁচামালের প্রায় ৯৫ শতাংশই আমদানিনির্ভর। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে নির্মাণ উপকরণে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির আঁচ লেগেছে। চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ কমে গেছে। দেশের বাজারে মাত্র দুদিনের ব্যবধানে টনপ্রতি ১ হাজার টাকা বেড়ে ভালোমানের রডের দাম উন্নীত হয়েছে রেকর্ড ৮৭ হাজার টাকায়। মূলত দেশে রডের প্রাথমিক কাঁচামাল পুরনো লোহার টুকরো ব্যবহার করে ইস্পাত পণ্য উৎপাদিত হয়। বছরে মেল্টিং স্ক্র্যাপের চাহিদা ৬০ লাখ টন। তার মধ্যে ৫০ লাখ টন মেল্টিং স্ক্র্যাপই বিদেশ থেকে আমদানি করতে হচ্ছে। বিশ্ববাজারে বর্তমানে ৭০০ থেকে ৭১৫ ডলারে মেল্টিং স্ক্র্যাপ বিক্রি হচ্ছে। অথচ ও সপ্তাহ আগেও তা ছিল প্রতি টন ৫৫০ ডলার। একইভাবে ইস্পাতপণ্য তৈরিতে ব্যবহৃত প্রধান রাসায়নিক কাঁচামাল ফেরো অ্যালয়স যুদ্ধ পরিস্থিতির আগে প্রতি টন ১ হাজার ২৬০ ডলারে বিক্রি হলেও তা বেড়ে ১ হাজার ৮০০ ডলারে উন্নীত হয়েছে। তাছাড়া নির্মাণকাজে প্রয়োজনীয় আরেক গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ সিমেন্টের দামও বাড়তে শুরু করেছে। এক সপ্তাহের ব্যবধানে সিমেন্টের দাম প্রায় ৫০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। মূলত ক্লিংকার তৈরির খরচ বাড়ায় রফতানিকারক পর্যায়ে দাম বেড়েছে। আবার জাহাজ ভাড়া বাড়ায় তা আমদানি মূল্যের সঙ্গে যোগ হচ্ছে। সিমেন্ট উৎপাদনে প্রধান কাঁচামালের সবগুলোই আমদানিনির্ভর।
এদিকে বিদ্যমান পরিস্থিতি প্রসঙ্গে বিটিএমএর সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন জানান, বিশ্ববাজারে তুলার দাম কেজিতে গড়ে ২৬-২৭ সেন্ট বেড়ে গেছে। ক্রেতারা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। ওই কারণে এদিকে অর্ডারগুলোও স্থবির হয়ে আছে। এখন আমদানি খরচ বেড়ে মুনাফার মার্জিন কমে আসবে। আন্তর্জাতিক বাজারের চাহিদা ও সরবরাহের ওপর পোশাক পণ্যের মূল্য নির্ধারণ হয়। রাশিয়ায় অনেক চেইন স্টোর বন্ধ করে দেয়ায় স্বাভাবিকভাবেই সরবরাহ কমে যাবে। বিশ্ববাজারে রাশিয়া একটি বড় অংশ। পরিস্থিতির আরো অবনতি হবে যদি রাশিয়া ইউরোপে জ্বালানি তেল ও গ্যাসের সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। জ্বালানি তেলের দাম এখন ১৪ বছরে সর্বোচ্চে। আগে থেকেই পরিবহন খরচ বাড়তির দিকে। পরিস্থিতি যেদিকে গড়াচ্ছে, তাতে তা সামনে আরো বেড়ে যাবে।
অন্যদিকে এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ প্লাস্টিক গুডস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শামীম আহমেদ জানান, প্লাস্টিক শিল্পোক্তারা স্থানীয় বাজারে সরবরাহের পাশাপাশি রফতানিতেও যুক্ত। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতিতে বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম বাড়ছে। কাঁচামালের আমদানি খরচ বেড়ে যাওয়ায় সামনের দিনগুলোয় তৈরি পণ্যের দাম বাড়বে। যুদ্ধ পরিস্থিতির সহসা উন্নতি না হলে বাজারেও স্থিতিশীলতা ফেরার কোনো সম্ভাবনা নেই।