নিজস্ব প্রতিবেদক :
আজ থেকে ৯ বছর আগে ধসে পড়েছিল সাভারের রানা প্লাজা। কয়েকটি পোশাক কারখানা নিয়ে গড়ে ওঠা ভবনটিতে ভয়াবহ সেই দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান এক হাজার ১৩৬ জন। আহত হন আরও প্রায় দেড় হাজার মানুষ। এত প্রাণহানির পেছনে দায় যাদের, তাদের বিচার শেষ হয়নি ৯ বছরেও। ভবন ধসে বিপুলসংখ্যক মানুষ মারা যাওয়ার ঘটনায় ওই সময় মোট চারটি মামলা করা হয়। এর মধ্যে অবহেলার কারণে মৃত্যু উল্লেখ করে হত্যা মামলা দায়ের করে পুলিশ, ইমারত নির্মাণ আইন না মেনে ভবন নির্মাণ করায় একটি মামলা করে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) এবং ভবন নির্মাণে দুর্নীতি ও সম্পদের তথ্য গোপন সংক্রান্ত দু’টি মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এর মধ্যে কেবল দুদকের দায়ের করা সম্পদের তথ্য গোপনের মামলাটি নিষ্পত্তি হয়েছে। এর বাইরে ভবন নির্মাণে দুর্নীতির মামলাটির বিচার কার্যক্রম চলমান রয়েছে বলে আদালত সূত্রে জানা গেছে। বাকি দুটি মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন। রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় দায়ের করা হত্যা ও ইমারত আইনের মামলা দুটি বিচারের জন্য প্রস্তুত হয় ২০১৬ সালে। একই বছরের ১৫ মার্চ মামলা দুটি বিচার ও নিষ্পত্তির জন্য ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ এবং বিচারিক আদালতে পাঠানো হয়। একই বছরের ১৬ জুন ইমারত নির্মাণ আইনের মামলায় ভবন মালিক সোহেল রানাসহ ১৮ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন ঢাকার অতিরিক্ত মুখ্য বিচারিক হাকিম মুস্তাফিজুর রহমান। এরপর ১৮ জুলাই হত্যা মামলায় ভবন মালিক সোহেল রানাসহ ৪১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন তৎকালীন ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ এসএম কুদ্দুস জামান। তবে অভিযোগ গঠনের আদেশের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে আট আসামি হাইকোর্টে আবেদন করেন। শুনানি শেষে প্রথমে আট জনের পক্ষেই স্থগিতাদেশ দেন আদালত। পরে ছয় জনের স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। বহাল থাকে সাভার পৌরসভার ওই সময়কার মেয়র রেফায়েত উল্লাহ এবং কাউন্সিলর মোহাম্মদ আলী খানের পক্ষের স্থগিতাদেশ। রানা প্লাজার হত্যা মামলা: রানা প্লাজা ধসের পরদিন অবহেলাজনিত মৃত্যুর অভিযোগে একটি মামলা করেন সাভার থানার এসআই আলী আশরাফ। ওই মামলায় সোহেল রানাসহ ২১ জনকে আসামি করা হয়। এ ছাড়া রানা প্লাজা ধসে নিহত হওয়ার ঘটনাকে হত্যাকারী আখ্যায়িত করে আদালতে আরেকটি মামলা করেন গার্মেন্ট শ্রমিক জাহাঙ্গীর আলমের স্ত্রী শিউলি আক্তার। আদালতের নির্দেশে একে অবহেলাজনিত মৃত্যু মামলার সঙ্গে একীভূত করে তদন্ত করে সিআইডি। আদালতে দায়ের করা হত্যা মামলার বাদী শিউলি আক্তার এখন পুলিশের মামলার সাক্ষী। এ মামলায় মোট ৫৯৪ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে। ২০১৬ সালের ১৮ জুলাই এ মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করেন আদালত। চার্জশিটভুক্ত ৪১ আসামিদের মধ্যে সোহেল রানা কারাগারে। রানার বাবা আবদুল খালেক, আবু বকর সিদ্দিক ও আসামি আবুল হোসেন জামিনে থাকা অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছেন। বর্তমানে ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ হাবিবুর রহমান ভূইয়ার আদালতে মামলাটি বিচারাধীন রয়েছে। প্রায় ৬ বছর পর এ মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়েছে। গত (৩১ জানুয়ারি) মামলার বাদী এসআই আলী আশরাফ সাক্ষ্য দেয়া শুরু করেন। গত শনিবার তার সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়। আগামী (২৯ মে) মামলাটির পরবর্তী সাক্ষ্য গ্রহণের তারিখ ধার্য রয়েছে। হত্যা মামলাটির সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী বিমল সমদ্দার জানান, অভিযোগ গঠনের পর আটজন আসামি উচ্চ আদালতে গিয়ে মামলাটি স্থগিতের আবেদন করেন। তাদের মধ্যে সাতজনের আবেদন নিষ্পত্তি হয়েছে। সাভার পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কমিশনার হাজি মোহাম্মদ আলীর পক্ষে মামলাটির বিচারিক কার্যক্রম এখনো স্থগিত রয়েছে। তাকে বাদ দিয়ে অন্য আসামিদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়েছে। আগে সাক্ষীরা আদালতে আসলেও সাক্ষ্য গ্রহণ করা যায়নি। এতবে খন সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়েছে। আশা করছি, সাক্ষ্য গ্রহণ চলবে। মামলাটির বিচার দ্রুত শেষ হবে। ইমারত আইনের মামলা: ইমারত বিধিমালা না মেনে ভবন নির্মাণের অভিযোগে ওই সময় সোহেল রানাসহ ১৩ জনকে আসামি করে সাভার মডেল থানায় আরেকটি মামলা করেন রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. হেলাল আহমেদ। সিআইডি তদন্ত শেষে এ মামলায় সোহেল রানা ও তার বাবা-মা সহ ১৮ জনকে আসামি করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করে। ১৯৫২ সালের ইমারত নির্মাণ আইনের ১২ ধারায় এ চার্জশিট দাখিল করে। এ মামলায় ১৩৫ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে। ঢাকার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলাটি সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য রয়েছে। চার্জগঠনের আদেশের বিরুদ্ধে কয়েকজন আসামি রিভিশন করায় মামলাটির সাক্ষ্য গ্রহণ হচ্ছে না। ইমারত নির্মাণ আইনের মামলা সম্পর্কে ঢাকার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটরই আনোয়ারুল কবীর বাবুল জানান, ঢাকার অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াশাল ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে রানা প্লাজা ইমারত নির্মাণের আইনের মামলাটি বিচারাধীন রয়েছে। এই মামলার আসামি সাভার পৌরসভার সাবেক মেয়র রেফাত উল্লাহ মামলাটির বৈধতা চ্যানেঞ্জ করে হাইকোর্টে একটা আবেদন করে। সেই আবেদনের প্রেক্ষিতে মামলাটি স্থগিত হয়ে যায়। হাইকোর্ট ডিভিশন গত বছরের ৮ নভেম্বর থেকে চলতি বছরের ৭ নভেম্বর পর্যন্ত স্থগিতাদেশ এক বছরের জন্য বৃদ্ধি করেন। বর্তমানে মামলাটি হাইকোর্টে স্থগিত রয়েছে। তিনি আরও বলেন, ২০১৬ সালের ১৪ জুন মামলাটির চার্জগঠন হয়। চার্জগঠনের পর পরেই মামলাটি হাইকোর্টে চলে গেছে। এজন্য একজনেরও সাক্ষ্যগ্রহণ নেওয়া সম্ভব হয়নি। এই মামলায় আসামির সংখ্যা ১৬ জন। এই মামলায় সকলেই জামিনে রয়েছে। এদিকে রানার আইনজীবী ফারুক আহাম্মদ বলেন, এটা একটা দুর্ঘটনার মামলা। সেই মামলায় রানা গত ৯ বছর ধরে জেল হাজতে রয়েছে। জামিন পাচ্ছে না। বাকি সবাই জামিনে আছে। মামলার রায়ে যা হওয়ার তাই হবে। এভাবে বিনা বিচারের ৮ বছর জেলে থাকা মানবিক দিক থেকে অন্যায়। তাই আদালতের উচিত হয়তো মামলাটির বিচার দ্রুত শেষ করা, নয়তো আসামিকে জামিন দেয়া। এটা দূর্ঘটনা মাত্র। আশা করি রানাসহ অন্যান্য খালাস পাবেন। ইমারত নির্মাণ আইনের অভিযুক্ত আসামিরা হলেনÑ ভবন মালিক সোহেল রানা, তার বাবা আবদুল খালেক ওরফে কুলু খালেক, মা মর্জিনা বেগম, সাভার পৌরসভার মেয়র রেফায়েত উল্লাহ, কাউন্সিলর মোহাম্মাদ আলী খান, উপ-সহকারী প্রকৌশলী রাকিবুল হাসান রাসেল, নিউওয়েব বাটন লিমিটেডের চেয়ারম্যান বজলুস সামাদ আদনান, সাইট ইঞ্জিনিয়ার মো. সারোয়ার কামাল, আমিনুল ইসলাম, নিউওয়েব স্টাইলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহমুদুর রহমান তাপস, ইথার টেক্সটাইলের চেয়ারম্যান আনিসুর রহমান ওরফে আনিসুজ্জামান, সাভার পৌরসভার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা উত্তম কুমার রায়, প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম, গার্মেন্টস ব্যবসায়ী মাহবুবুল আলম, সাবেক সহকারী প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমান, নগর পরিকল্পনাবিদ ফারজানা ইসলাম, নান্টু কন্ট্রাকটার এবং রেজাউল ইসলাম। মামলায় রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানা, তার বাবা আবদুল খালেক ওরফে খালেক কুলুসহ ৫৯ জনকে আসামি করা হয়েছে। তবে আসামিদের মধ্যে ১৭ জনের নাম উভয় মামলার অভিযোগপত্রে উল্লেখ থাকায় ব্যক্তি হিসেবে আসামি ৪২ জন। এর মধ্যে হত্যা মামলায় ৪১ জনকে আসামি করা হয়েছে এবং সাক্ষী করা হয়েছে ৫৯৪ জনকে। ইমারত নির্মাণ আইনের মামলায় ১৮ জনকে আসামি করা হয়েছে এবং সাক্ষী করা হয়েছে ১৩৫ জনকে। এই তিন মামলার বাইরে রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানার বিরুদ্ধে সম্পদের তথ্য গোপনের অভিযোগে দুদকের দায়ের করা মামলাটিই কেবল নিষ্পত্তি হয়েছে। এ মামলায় ২০১৭ সালের ২৯ আগস্ট সোহেল রানাকে তিন বছরের কারাদ- ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা এবং অনাদায়ে আরও তিন মাসের কারাদ-ের আদেশ দেন ঢাকার বিশেষ জজ-৬-এর বিচারক।
সর্বশেষঃ
রানা প্লাজা ট্রাজেডির ৯ বছরেও শেষ হয়নি ৩ মামলার বিচার
-
দৈনিক আইন বার্তা
- আপডেট সময়ঃ ০৮:২১:২৯ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৪ এপ্রিল ২০২২
- ৪১৬ বার পড়া হয়েছে
ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ