নিজস্ব প্রতিবেদক :
নির্বাচন কমিশন (ইসি) একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। সংবিধানের ১১৮ নং অনুচ্ছেদে সুস্পষ্টভাবে নির্বাচন কমিশন গঠনের কথা বলা আছে। এর আগে যদিও সাংবিধানিকভাবে নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়নি, কিন্তু এবার ক্ষমতাশীল সরকার নির্বাচন কমিশন গঠনে সংবিধানের আদেশানুসারে আইন গঠনের প্রক্রিয়া চালাচ্ছে। ইতোমধ্যে আইনের খসড়া বিল আকারে সংসদে উত্থাপন করা হয়েছে। উত্থাপন করেছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। কিন্তু নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য উত্থাপিত আইন নিয়ে বিরোধী মহলে চলছে অসন্তোষ। সুশীল সমাজেও চলছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। সরকারের আনীত আইনে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির দাবি অনুসারে অনেক ফাঁকফোকর রয়েছে। উত্থাপিত বিলটিতে আরও একটি লক্ষণীয় বিষয় হলো যে এতে বলা হয়েছে, এর আগে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক গঠিত সার্চ কমিটি, তাদের কাজ এবং তাদের সুপারিশের ভিত্তিতে সিইসি ও কমিশনার নিয়োগ বৈধ ছিল বলে গণ্য হবে এবং এ বিষয়ে আদালতে কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করা যাবে না। আগের সার্চ কমিটির ‘বৈধতা’ দেওয়ার বিষয়ে আইনমন্ত্রী সংসদে বলেন, ‘দুবার যে সার্চ কমিটি করা হয়েছিল, তা ঐকমত্যের ভিত্তিতে। সেটাকে আইনসিদ্ধ করা হচ্ছে।’
প্রতিক্রিয়ায় বিএনপির সাংসদ হারুনুর রশিদ বলেন ভিন্ন কথা।তিনি বলেন, সার্চ কমিটির মাধ্যমে গত দুটি নির্বাচন কমিশন গঠনের মধ্য দিয়ে নির্বাচন কমিশনকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে। এর আগে সার্চ কমিটির মাধ্যমে গঠিত দুটি কমিশনকে বৈধতা দেওয়ার জন্য এই আইন আনা হয়েছে। এখানে নতুনত্ব কিছু নেই। এর আগে যে কমিশন গঠিত হয়েছে, তার অনুরূপ বিল এখানে তোলা হয়েছে। নির্বাচন ব্যবস্থা ধ্বংস এবং অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের সদস্যদের আইনের আওতায় আনা জরুরি বলে দাবি জানান তিনি।
প্রস্তাবিত আইনটিকে তিনি দুর্বল ও প্রশ্নবিদ্ধ বলে আখ্যায়িত করেন। তিনি জোরালভাবে বলেন, এ আইন দিয়ে বর্তমান সঙ্কটের নিরসন হবে না। সঙ্কট থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে পারব না। এ সময় তিনি আইনটি প্রত্যাহার করারও দাবি তুলেন।
উথাপিত বিলে মূলত কি বলা হয়েছে সেটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিলে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রপতি ছয় সদস্যের সার্চ কমিটি গঠন করবেন। সিইসি ও কমিশনার হিসেবে নিয়োগের জন্য প্রতিটি পদের বিপরীতে দুজন করে মোট ১০ জনের নাম প্রস্তাব করার জন্য একটি অনুসন্ধান কমিটি গঠন করবেন রাষ্ট্রপতি। অনুসন্ধান কমিটির সভাপতি হবেন প্রধান বিচারপতির মনোনীত আপিল বিভাগের একজন বিচারপতি। আর সদস্য হিসেবে থাকবেন- প্রধান বিচারপতির মনোনীত হাইকোর্টের একজন বিচারপতি, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক, সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) চেয়ারম্যান এবং রাষ্ট্রপতির মনোনীত দুজন বিশিষ্ট নাগরিক। তিন জন সদস্যের উপস্থিতিতে অনুসন্ধান কমিটির সভার কোরাম গঠিত হবে। সভায় উপস্থিত সদস্যদের সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। ভোটের সমতার ক্ষেত্রে সভায় সভাপতিত্বকারী সদস্যের দ্বিতীয় বা নির্ণায়ক ভোট প্রদানের ক্ষমতা থাকবে।
এই আইনের আওতায় গঠিত নির্বাচন কমিশন যে স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষতার সাথে তাঁদের দায়িত্ব পালন করবে, এবং কমিটির সদস্যারা যে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হবে সে বিষয়েও ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, সার্চ কমিটি স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতার নীতি অনুসরণ করে দায়িত্ব পালন করবে। আইনে বেঁধে দেওয়া যোগ্যতা, অযোগ্যতা, অভিজ্ঞতা, দক্ষতা ও সুনাম বিবেচনা করে সিইসি ও নির্বাচন কমিশনার পদে নিয়োগের জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ করবে। কমিটি গঠনের ১০ কার্যদিবসের মধ্যে সুপারিশ রাষ্ট্রপতির কাছে দেবে। খসড়া প্রস্তাবে বলা হয়েছে, সার্চ কমিটি সিইসি এবং নির্বাচন কমিশনার পদে যোগ্যদের অনুসন্ধানের জন্য রাজনৈতিক দল এবং পেশাজীবী সংগঠনের কাছ থেকে নাম আহ্বান করতে পারবে। আর কমিটির কাজে সাচিবিক সহায়তা দেবে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।
এছাড়া উত্থাপিত আইনে সিইসি ও কমিশনার পদের জন্য ছয়টি অযোগ্যতার কথা বলা হয়েছে। আদালত অপ্রকৃতিস্থ ঘোষণা করলে। দেউলিয়া হওয়ার পর দায় থেকে অব্যাহতি না পেলে। কোনো বিদেশি রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব নিলে কিংবা বিদেশি রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা বা স্বীকার করলে। নৈতিক স্খলনজনিত ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়ে অনূন্যম দুই বছরের কারাদ-ে দন্ডিত হলে। ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস (ট্রাইব্যুনালস) অ্যাক্ট-১৯৭৩ বা বাংলাদেশ কোলাবরেটরস (স্পেশাল ট্রাইব্যুনালস) অর্ডার-১৯৭২ এর অধীনে কোনো অপরাধের জন্য দন্ডিত হলে। আইনের দ্বারা পদাধিকারীকে অযোগ্য ঘোষণা করছে না, এমন পদ ব্যতীত প্রজাতন্ত্রের কর্মে লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত থাকলে।
উল্লেখ্য, সাংবিধানিক সংস্থা ইসিতে কমিশনার নিয়োগের এখতিয়ার রাষ্ট্রপতির। আর তা একটি আইনের অধীনে হবে বলে সংবিধানে বলা আছে। দীর্ঘ ৫০ বছরেও এই আইনটি প্রণীত না হওয়ায় প্রতিবারই ইসি গঠনের সময় শুরু হয় বিতর্ক। আর এই বিতর্ক এড়াতে প্রথমবারের মতো ২০১২ সালে নতুন কমিশন নিয়োগের সময় তৎকালীন রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান সার্চ কমিটি নামে একটি মধ্যস্থ ফোরাম তৈরি করেন, যেটি নিয়েও পড়ে বিতর্ক হয়। এ পদ্ধতিতে রাষ্ট্রপতি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে একজন বিচারপতির নেতৃত্বে বিশিষ্ট কয়েকজন নাগরিকদের নিয়ে সার্চ কমিটি গঠন করেন।
তখন দেখা যায়, ওই সার্চ কমিটি সিইসি ও ইসি হতে যোগ্যদের নামের একটি তালিকা তৈরি করা হয়। সেই তালিকা থেকে একজন সিইসিসহ অনধিক পাঁচজন কমিশনার নিয়োগ দেন। এরপর রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ২০১৭ সালে সেই পদ্ধতিই অনুসরণ করেছিলেন। এবারও একই পদ্ধতিতে এগিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। কিন্তু সংলাপে অংশ নেওয়া ২৫টি রাজনৈতিকদলের প্রায় সবগুলো ইসি গঠনে স্থায়ী সমাধান হিসেবে সংবিধানের আলোকে আইন প্রণয়নের ওপর জোর দেয়। আলোচনায় রাষ্ট্রপতিও এ বিষয়ে সম্মত হন বলে দলগুলোর নেতারা জানান। বিএনপিসহ সাতটি দল অবশ্য এবারের রাষ্ট্রপতির এই সংলাপে অংশ নেয়নি।
তবে এটি স্পষ্ট যে, এতোদিন সাংবিধানিক নিয়মের বাইরে সার্চ কমিটির মাধ্যমেই নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়ে এসেছে। সেক্ষেত্রে এটি একটি ভালো উদ্যোগ। কেননা সংবিধানের নিয়ম অনুসরন করেই ইসি গঠনের আইন করা হচ্ছে। এখন আইন যাতে স্বচ্ছতা বজায় থাকে এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনের ভিত্তিতে যাতে আগামী জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় সেজন্য সরকারকে সদিচ্ছার পরিচয় দিতে হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।