নিজস্ব প্রতিবেদক :
দাঙ্গা একটি বিভিষীকাময় শব্দ। দাঙ্গা বলতে আমাদের সামনে ভেসে ওঠে মুসলমান আর হিন্দুর মধ্যে এক ভয়াবহ রক্তাত্ব সংঘর্ষের চিত্র। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ইতিহাস এই অঞ্চলে কয়েকশ বছরের পুরোনো। এখন পর্যন্ত বিশ লক্ষের বেশি হিন্দু-মুসলমান নিহত হয়েছে দাঙ্গায়। বাস্তুহারা হয়েছে এক কোটির বেশি অভাগা মানুষ। কয়েক শত বছর ধরে চলমান এই হত্যাকান্ড একুশ শতকেও থামেনি। সংঘর্ষ এখনও চলমান। সম্প্রতি কুমিল্লার একটি পূজাম-প থেকে পবিত্র কোরআন উদ্ধারের ঘটনায় ওই এলাকায় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে। এ ঘটনায় বেশ কয়েকটি পূজাম-পে দাঙ্গা হ্যাঙ্গামার ঘটনা ঘটেছে বলে জানা গেছে।
‘দাঙ্গা’ শব্দটি এসেছে ফারসি ‘জঙ্গ’ শব্দ থেকে। যুদ্ধের সৈন্যদের বলা হতো ‘জঙ্গ’। আর যুদ্ধের কৌশলকে বলা হত ‘দঙ্গ’। দঙ্গ শব্দটি থেকে ধীরে ধীরে বাংলায় নতুন শব্দের সৃষ্টি হয় ‘দাঙ্গা’।
মোঘলরা আসার আগে এই অঞ্চলে হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধদের মধ্যে যে সংঘর্ষ বা মারামারি হতো তাকে ‘দাঙ্গা’ বলা হতো না। অন্য যেকোন সংর্ঘষে মতোই মনে করা হত এই মারামারিকে। ধর্মীয় বিদ্দেষ তখনও দাঙ্গা নাম ধারণ করেনি।
১৭১৪ সালে ইংল্যান্ডে ‘রায়ট অ্যাক্ট’ পাশ হবার পর ‘রায়ট’ শব্দটির বাংলা অনুবাদ হিসেবে ধরা হয় এই ‘দাঙ্গা’কে।
উপমহাদেশে হিন্দু মুসলমানের মধ্যে প্রথম দাঙ্গা হয় ১৬৭১ সালে। সূত্রপাত স¤্রাট আওরঙ্গজেবের জারি করা ধর্ম পালনের নতুন নিয়ম নীতি। দশ বছর ধরে চলে মুসলমান আর হিন্দুদের এই সংঘর্ষ। এরপর আরো কিছু দাঙ্গা হয়েছে এই সময় যার বেশির ভাগ মুসলমান আর পার্সিদের সাথে।
সবচেয়ে বেশি দাঙ্গা দেখা দেয় ব্রিটিশ ভারতে। ইংরেজরা নিজেদের স্বার্থে দাঙ্গার মনোবৃত্তি বাঁচিয়ে রেখেছিল মুসলমান আর হিন্দুদের মধ্যে। যা এখনও সমানভাবে বহমান এই অঞ্চলের মানুষের রক্তে।
ব্রিটিশ-ভারতে হিন্দু মুসলমানদের প্রথম দাঙ্গা হয় ১৮৮২ সালে। সালেম দাঙ্গা। মধ্যপ্রদেশের তামিলনাড়ুর সালেম শহরে মসজিদ নির্মাণ নিয়ে শুরু হয় এই দাঙ্গা। হিন্দুদের দাবি তাদের ধর্মীয় পথে মুসলমানেরা মসজিদ বানিয়েছিল। এই নিয়ে সংঘর্ষ, মারামারি আর হত্যা। ভেঙ্গে ফেলা হয় মুসলমানের মসজিদ আর ফলাফল ধ্বংস হয় হিন্দুদের ৮টি মন্দির। দাঙ্গায় দুপক্ষের মানুষই নিহত হয়।
১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহে হিন্দু মুসলমান একজোট হয়ে লড়েছিল। আর তাতেই নড়বড়ে হয়ে গিয়েছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভিত। কোম্পানীর শাসন শেষ করে রানীর শাসন চালু করতে বাধ্য হয় ইংরেজরা। ভারত কোম্পানির হাত থেকে বের হয়ে রুপ নেয় ব্রিটিশ-ভারতে। আর তখন থেকেই হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে বৈষ্যম আর বিভেদ সৃষ্টির কৌশল তৈরি করতে থাকে ইংরেজরা। সেই কালো কৌশলের নাম ‘ডিভাইড এ- রুল’, ভাগ করো শাসন করো।
বিশ শতকের প্রথম দিকে এসে এই বৈষম্য আর বিভেদ চরম আকার ধারণ করে। শুরু হয় একের পর এক রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা। ১৯২০-২১ এর মাদ্রাজে ইংরেজ- হিন্দু -মুসলমানের মধ্যে যে সংঘর্ষ হয় তাকে কেউ বলে দাঙ্গা কেউ বলে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন। ‘ম্যাপপিরা দাঙ্গা’র কারণে পরে হিন্দু মুসলমান সাজা ভোগ করে।
এরপর ‘কোহাটের দাঙ্গায়’ নিহত হন ১৫৫ জন। আর নাগপুর দাঙ্গায় নিহত হয় ২২ জন। এ ছাড়া ১৯২০-৩০ সালের মধ্য কয়েক দফায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কয়েকশ দাঙ্গা সংঘটিত হয়।
হিন্দু মসুলমানের সবচেয়ে ভয়াবহ দাঙ্গাটি হয় কলকাতায়। ১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট শুরু হয় এই হত্যা উৎসব। এক সপ্তাহ ধরে চলে এই দাঙ্গা। ‘দীর্ঘ ছুরিকার সপ্তাহ’ বা ‘ডায়রেক্ট অ্যাকশন ডে’ ‘বা ক্যালকাটা কিলিং’ নামে পরিচিত এই দাঙ্গা।৭২ ঘন্টার মধ্যে ৫ হাজার মানুষ নিহত হয়। ১ লক্ষ মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়েছিল।
ভারতের ক্ষমতা শুধুমাত্র কংগ্রেস নেতাদের হাতে দিয়ে চলে যেতে চেয়েছিল ব্রিটিশরা। তার প্রতিবাদে ১৬ আগস্ট হরতাল ডেকেছিল মুসলিমলীগ। সেই হরতালের সুত্রধরেই শুরু হয় ভয়াবহ মানুষ হত্যার রক্তক্ষয়ী উৎসব।
কলকাতার দাঙ্গার প্রতিশোধ নিতেই দুমাসেই মধ্যেই পূর্ববঙ্গের নোয়াখালিতে শুরু হয় আরেক মানুষ হত্যা উৎসব।
১৯৪৬ এর ১০ অক্টোবরের সেই দিনটি ছিল কোজাগরি লক্ষী পূজার দিন। চার সপ্তাহ ধরে নোয়াখালিতে চলে এই গণহত্যা। ৫ হাজার হিন্দুকে হত্যা করা হয় এই কয়েকদিনে। ধর্ষণ, লুন্ঠন, জোর করে ধর্মান্তরিত করা হয় অসহায় হিন্দুদের। কয়েক লাখ হিন্দু বাস্তুচুত্য হয়ে পড়ে। নিহত পাঁচ হাজার মানুষের পরিবার পড়ে এক গভীর অন্ধকারে।
তিন মাস পরে নোয়াখালি পরিদর্শনে আসে অহিংস আন্দোলনের নেতা মহাতœা গান্ধী। তাতে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নত হলেও যা ক্ষতি হবার তা হয়ে যায় এদেশের মানুষের।
নোয়াখালির ঘটনার পরপরই বিহার দাঙ্গা শুরু হয়। সে বছরই ২৪ অক্টোবর থেকে ১১ নভেম্বর চলে মানুষ খুনের বিভৎস। পরিসংখ্যান বলছে ১৯৪৬ সালে দেশজুড়ে ৩১৭৬ টি দাঙ্গার ঘটনা ঘটে। দাঙ্গা যেন হয়ে ওঠে প্রতিদিনের ঘটনা। এর আগের বছর ১৯৪৫ সালে শুধু উত্তর প্রদেশে দাঙ্গা হয়েছিল ১৮০৬ টি।
১৯৪৬ এর ২৭ অক্টোবর থেকে ৬ নভেম্বর পর্যন্ত চলা দাঙ্গাই ছিল দেশভাগের আগে সবচেয়ে ভয়াবহ ঘটনা। এ্ই সময় হতাহতের সংখ্যা নিয়ে বৃটিশ পালামেন্টে দেয়া বিবৃতিতে জানা যায় পাঁচ হাজার মানুষ নিহত হয়েছিল এই কয়েকদিনে। ‘দ্যা স্টেটসম্যান’ পত্রিকা জানায় সেই সংখ্যা সাড়ে সাত হাজার থেকে দশ হাজার। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের মতে এ সংখ্যা অনেক কম, মাত্র দুই হাজার। তবে মোহাম্মাদ আলী জিন্নাহ বলেছিলেন, এই সময়ের দাঙ্গায় নিহত হয়েছিল ত্রিশ হাজার মানুষ।
দাঙ্গার সূত্রপাত গুলো হত গুজব বা মিথ্যে তথ্য দিয়ে। ১৯৪৬ ভয়াবহ দাঙ্গার সুত্রপাতটিও হয়েছিল মিথ্যে অভিযোগ দিয়ে। অভিযোগ ছিল যে মুসলমানেরা এক হিন্দু মহিলাকে ধরে নিয়ে গেছে। পরে জানা যায় পুরোটাই গুজব এবং মিথ্যে।
ইংরেজ বিরোধী আন্দোলন শেষে এসে রুপ নিয়েছিল হিন্দু মুসলমানের ভয়াবহ রক্তাত্ব সংঘর্ষে। দেশভাগ তখন অনিবার্য হয়ে উঠেছিল। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট শেষ হয় ১৯০ বছরে ব্রিটিশ শাসন। দাঙ্গার ভেজা রক্তের মধ্যেই হিন্দু আর মুসলমানদের জন্য গঠিত হয় আলাদা আলাদা দুটি রাষ্ট্র। হিন্দুস্তান আর পাকিস্তান।কিন্তু তাতে কি বন্ধ হয়েছে মানুষ হত্যার এই বিভৎস উৎসব ?
ঢাকা
০১:০৯ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৪ মার্চ ২০২৫
সর্বশেষঃ
সাম্প্রদায়িকতার বিষবৃক্ষের ফল ভোগ করতে হবে আর কতোদিন
-
দৈনিক আইন বার্তা
- আপডেট সময়ঃ ০৯:৩৬:৪৩ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৭ অক্টোবর ২০২১
- ৫১৭ বার পড়া হয়েছে
ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ