নিজস্ব প্রতিবেদক :
সরকারবিরোধী আন্দোলনের নামে বিএনপি-জামায়াতের অগ্নি সন্ত্রাসের কথা স্মরণ করে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, কেউ রাজনীতি করতে চায় সুষ্ঠু রাজনীতি করুক, আমাদের আপত্তি নেই। কিন্তু আমাদের এই সাধারণ মানুষের গায়ে কেউ হাত দিলে তাদের রক্ষা নেই। তাদের রক্ষা নেই। এটা সহ্য করা যায় না। এটা কোন মানুষ সহ্য করতে পারবে না। আজ রোববার দুপুরে রাজধানীর শাহবাগে জাতীয় জাদুঘর মিলনায়তনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ আয়োজিত অগ্নি সন্ত্রাসের আর্তনাদ বিএনপি-জামায়াতের অগ্নি সন্ত্রাস, নৈরাজ্য ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের খন্ডচিত্র” শীর্ষক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন তিনি। বিএনপি জামায়াতের আগুন সন্ত্রাসের শিকার ভুক্তভোগী ও পরিবারের সদস্যদের বেদনার কথা শোনেন এবং তাদের প্রতি সহমর্মিতা জানান। এ প্রসঙ্গ তুলে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘কাজেই এ রকম ঘটনা যেনো আর না ঘটে। আমার একটাই আহ্বান থাকবে দেশবাসীর কাছে, কেউ রাজনীতি করতে চায় সুষ্ঠু রাজনীতি করুক, আমাদের আপত্তি নেই। কিন্তু আমাদের এই সাধারণ মানুষের গায়ে কেউ হাত দিলে তাদের রক্ষা নেই। তাদের রক্ষা নেই। এটা সহ্য করা যায় না। এটা কোন মানুষ সহ্য করতে পারবে না।’ দেশবাসীকে এ ব্যাপারে সকলকে সজাগ থাকার আহ্বান জানিয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, ‘এই ধরনের ঘটনা যেন ভবিষ্যতে আর কেউ ঘটাতে না পারে। দল মত নির্বিশেষ যেই হোক, এ দেশের প্রত্যেকটা মানুষের স্বাধীনভাবে বাঁচার অধিকার আছে। প্রত্যেকটা মানুষের স্বাধীনভাবে নিজের জীবন জীবিকা করার অধিকার আছে। প্রত্যেকটা মানুষের সুন্দরভাবে বাঁচার অধিকার আছে। সেই অধিকারটা সংরক্ষণ করাই আমাদের দায়িত্ব; আমরা সেটাই করে যাচ্ছি।’ ১৫ আগস্ট নিজের স্বজন হারানোর বেদনার কথা স্মরণ করে আগুন সন্ত্রাসের শিকার ভুক্তভোগী ও পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা জানান প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘এদের কষ্টটা উপলব্ধি করতে পারি। আমরা রাজনীতি করি মানুষের জন্য মানুষের কল্যাণে মানুষের মঙ্গলের জন্য। আমার দেশের মানুষ খেয়ে পড়ে ভাল থাকবে, শান্তিতে থাকবে, উন্নত জীবন পাবে যেটা আমার বাবা জাতির পিতার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্ন ছিল। সেই স্বপ্নটা পূরণ করাই ছিল আমার একমাত্র লক্ষ্য। সেই লিক্ষ্য নিয়েই কাজ করেয যাচ্ছিলাম।’ বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে যা যা করার আমরা চেষ্টা করেছি জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘দুভার্গ্য আমাদের পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের ঘাতকের দল, যারা ক্ষমতা দখল করেছিল এদেশে যে মানুষ হত্যার যে একটা যাত্রা শুরু, এটা আমার মনে সেই যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আমাদের উপর অত্যাচার করেছে তার পুনরাবৃত্তি আমরা বারবার দেখতে পেয়েছি।’ পঁচাত্তর সালের পর সেনাবাহিনীতে প্রায় ১৯-২০টা ক্যূ হয়েছে। সেনা অফিসার মুক্তিযোদ্ধা অফিসার, যারা একে একে তাদেরকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। তাদের পরিবার লাশও পায়নি। কারণও জানতে পারেনি, বিচার পায়নি। হয়ত বিচার চলছে কিন্তু ফাঁসি দিয়ে অথবা গুলি করে ফায়ারিং স্কোয়াডে দিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে। এই ধারাবাহিকতাই তো দিনের দিন পর দিন চলেছে দেশে বলে দাবি করেন তিনি। ‘অনেক সংগ্রামের পর যখন আমরা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হলাম। আমরা রাষ্ট্র পরিচালনা শুরু করেছিলাম মানুষের সামাজিক উন্নতির কাজ করে যাচ্ছিলাম। তখনি সরকার উৎখাতের নামে যে অগ্নি-সন্ত্রাস, খুন। ২০০১ সালে শুরু আবার ২০১৩, ২০১৪, ২০১৫ বারবার। কিভাবে মানুষ পারে, একটা গাড়িতে জীবন্ত মানুষগুলি যাচ্ছে সেখানে আগুন ধরিয়ে মানুষকে হত্যা করা? কিভাবে মানুষ পারে? এভাবে মানুষের ক্ষতি করা? এটাই নাকি আন্দোলন? এই আন্দোলন তো আমরা কখনও দেখিনি। আন্দোলন তো সেই স্কুল জীবন থেকেই আমরা করেছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘প্রত্যেকটা মিলিটারি ডিটেকটরের বিরুদ্ধে আন্দোলনে শরিক হয়েছি। সেই আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছি, ইয়াহিয়া খানের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছি। জিয়ার বিরুদ্ধে আন্দোলন করা হইছে? কই আমরা তো কখনও একথা স্বপ্নেও ভাবিনি যে পেট্রোল বোমা দিয়ে অথবা অগ্নিসংযোগ করে সাধারণ মানুষকে হত্যা করে আন্দোলন করা হবে।’ বিএনপি ঘোষণা দিল অবরোধ এবং হরতাল। কিন্তু কাজ হল কি মানুষকে হত্যা করা। আজকে যারা এখানে উপস্থিত এত খুব সামান্য কয়েকজন। একমাত্র ২০১৩’তে তো প্রায় তিন হাজার ৬০০ মানুষকে তারা পেট্রোল বোমা মেরে আহত করেছে। ২০১৪ ও ২০১৫ ’তে করেছে। আর গাড়ি পুড়িয়ে যাদের জীবন জীবিকার সুযোগ ছিল, সেটাও শেষ করে দিয়েছে বলে দাবি করেন প্রধানমন্ত্রী। এই আন্দোলন কি রকম আন্দোলন, এটা আমি জানি না প্রশ্ন তুলে শেখ হাসিনা বলেন, ‘মানুষের জন্য আন্দোলন করতে হলে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হলে মানবাধিকার রক্ষা করতে হলে তো মানুষকে নিয়েই আন্দোলন করবে আর তারা আক্রমণ চালিয়েছে।’ ২০০১ সালে আওয়ামী লীগের অগণিত নেতাকর্মীর উপর হত্যা মেয়েদের ওপর পাশবিক অত্যাচার, হাতুড়ি দিয়ে পিঠিয়ে হাড় গুড়ো করার শিকার আমরা হয়েছি বলে দাবি করেন প্রধানমন্ত্রী। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পর সরকার পতনের নামে ২০১৩ সাল থেকে সরকার পতনের নামে বিএনপি-জামায়াত আন্দোলনের নামে মানুষ খুন করা শুরু করে বলে অভিযোগ করেন আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনা। এ সময় প্রায় ৫০০ মানুষ শুধু আগুনে পুড়ে মারা গেছে। সাড়ে তিন হাজারের বেশি মানুষ আহত হয়েছে সে পরিসংখ্যানও তুলে ধরেন তিনি। শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমাদের সাধ্যমত চেষ্টা করেছি তাদের পাশে দাঁড়াতে। তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছি। জীবন জীবিকার ব্যবস্থা যতটা পেরেছি, করেছি। যে মানুষগুলি আপনজন হারিয়েছে, তাদের যে ব্যথা কষ্ট সেটা তো দূর করা সম্ভব না। সেটা তো আমি বুঝি। আজ যারা আগুনে পুড়ে কি অবস্থা এক এক জনের। জীবনে কত স্বপ্ন ছিল? কত আকাক্সক্ষা পুড়ে একে একে শেষ হয়ে গেছে।’ দেশবাসীকে তাই বিএনপি-জামায়াত সরকারের আমলের দুঃসময়ের কথা কাউকে ভুলে না যাওয়ার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘প্রত্যেকটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছিল অস্ত্রের ঝনঝনানি। মেধাবী ছাত্রদের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়ে মাদক তুলে দিয়ে অর্থ তুলে দিয়ে তাদেরকে বিপথে ঠেলে দিয়েছে। পঁচাত্তরের পর থেকে তো এই চলছিল বাংলাদেশে। আওয়ামী লীগ আসার পরে আমরা কিছুটা স্থিতিশীলতা আনতে পেরেছি। শিক্ষার পরিবেশ তৈরি করা, উৎপাদন বৃদ্ধি করা, দেশের মানুষের আর্থ সামাজিক উন্নতি করা যতটুকু সম্ভব আমরা কিন্তু করে যাচ্ছি। যেটুকু কাজ আমরা করে যাচ্ছি মানবকল্যাণে। কিন্তু তারই মাঝে এই ধরনের আঘাত এটা চরম মানবাধিকার লঙ্ঘন করা।’ ‘বিচার এদের নিজেদের বিচার এমনিই হচ্ছে। বিচার হবে, এটা বোধহয় আল্লাহর তরফ থেকেই হবে। হয়ত প্রত্যেক কেসে বিচার চলছে না। কিন্তু যারা এই ধরনের অগ্নি-সন্ত্রাসের সাথে জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে মামলা আছে, তাদের বিচারের কাজও হচ্ছে, শাস্তিও হচ্ছে, ভবিষ্যতে হবে। কিন্তু যারা হুকুমদাত্রী বা হুকুমদাতা; তাদের কথাও আপনারা ভেবে দেখেন। জানি না মানুষ কিভাবে এদের পাশে দাঁড়ায় আর কিভাবে সমর্থন করে যারা; এই ধরনের ধ্বংসাত্মক কাজ করতে পারে আর মানুষকে এভাবে কষ্ট দিতে পারে।’ ভুক্তভোগীদের পাশে সাধ্যমতো দাঁড়ানোর অঙ্গীকার ব্যক্ত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি শুধু এইটুকু আশ্বাস দিতে পারি, আপনারা এখনও শুধু এই কয়জন তো না। আরও অনেক, কয়েক হাজার মানুষ এই ধরনের ভুক্তভোগী। আমরা সবারই খোঁজ নিচ্ছি, খোঁজ নেবো। আমার সাধ্যমতো যা যা করার আমি করেছি এবং করবো। এইটুকু আমি আশ্বাস দিতে পারি এবং এটাই আমার দায়িত্ব। কত যে লাশ টানতে হয়েছে, কত মানুষকে সহযোগিতা করতে হয়েছে, কত মানুষের যে চিকিৎসা দিতে হয়েছে তার শেষ নেই। যখন থেকে দেশে ফিরেছি, এই একই ঘটনা আমি দেখে যা যাচ্ছি।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি এইটুকু বলব, বাংলাদেশে আমরা এ রকম চাই না। আমরা শান্তি চাই। দেশের উন্নতি চাই। মানুষের কল্যাণ চাই।’ স্বজন হারানোর বেদনা নিয়ে বেঁচে থাকাদের সাত্বনা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাকে দেখেন, আমরা দু’টি বোন একই দিনে সব হারালাম। দেশে আসতে পারলাম না, রিফিউজি হিসাবে বিদেশে আশ্রয় নিয়ে থাকতে হলো। অর্থ নেই, সম্পদ নেই, কিচ্ছু নেই, ওই ভাবেই আমাদেরকে জীবন কাটাতে হয়েছে। আমি নিজেও তো গ্রেনেড হামলা থেকে বেঁচে গেছি। আইভী রহমানসহ আমাদের বহু নেতাকর্মী মারা গেছেন। শুধু একবার না বারবার আঘাত এসেছে। জানি না আল্লাহর কি ইচ্ছে বারবার বাঁচিয়েছে। আমার পার্টির আওয়ামী লীগের লোকজন আমাকে মানব ঢাল রচনা করে বাঁচিয়েছে, বেঁচে আছি। তারপরও আমি কাজ করে যাচ্ছি, কাজ করে যাবো এবং আমি আছি আপনাদের পাশে।’ অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্বে আগুন সন্ত্রাসের হামলার শিকার হয়ে বেঁচে থাকা ভুক্তভোগী ও পরিবারের সদস্যগুলোর কাছ থেকে অনুভূতি ব্যক্ত করেন। ভুক্তভোগীরা আগুন-সন্ত্রাসে জড়িত বা দায়ীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন এবং আন্দোলনের নামে সাধারণ মানুষের জান-মালের ক্ষয়-ক্ষতি না করতে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আহ্বান জানান। অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আসাদুজ্জামান নূর এমপি।