ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ০২ অক্টোবর ২০২৫ | ই-পেপার

চট্টগ্রামে ঘুষ ছাড়া মিলছে না সরকারি বাসা, তদন্তে উপসচিব

দৈনিক আইন বার্তা
  • আপডেট সময়ঃ ০৮:৩২:৩৪ অপরাহ্ন, বুধবার, ১ অক্টোবর ২০২৫
  • / ৪৫ বার পড়া হয়েছে

প্রভাবশালী দালালচক্র ও কর্মকর্তাদের আঁতাতেই ঘুষের বিনিময়ে হচ্ছে বাসা বরাদ্দ। সরকারি অর্থ নয়ছয় ও অনিয়মে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে আবাসন দপ্তর।

রিপন চৌধুরী বিশেষ প্রতিনিধি :

গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধিনস্ত চট্টগ্রামে সরকারী আবাসন পরিদপ্তরে বাসা বরাদ্দ প্রক্রিয়ায় ঘুষ বাণিজ্য ও সরকারি অর্থ নয়ছয়ের অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগ রয়েছে, একটি প্রভাবশালী চক্র সরকারি নিয়ম উপেক্ষা করে অতিরিক্ত অর্থের বিনিময়ে পছন্দসই বাসা বরাদ্দ দিয়ে আসছে।

ঘুষের বিনিময়ে অফিসারদের জন্য নির্ধারিত বাসা পিয়নের নামে বরাদ্দ দিয়ে সরকারি অর্থ নয়ছয় করছে চক্রটি। আর ঘুষ না দিলে অফিসারদের বাসা বরাদ্দ নিয়ে টালবাহানার অভিযোগ পাওয়া গেছে। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, বরাদ্দ প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করছে আবাসন পরিদপ্তরের ভেতরের একটি প্রভাবশালী সিন্ডিকেট। এ চক্রের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী ও বহিরাগত দালাল।তাদের মাধ্যমেই ঘুষের টাকা আদান-প্রদান হয়। অনেক ক্ষেত্রে বরাদ্দ ফাইল মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর আগেই অঘোষিত ‘রেট’ নির্ধারণ করা হয়। এসব বিষয় নিয়ে করা একটি অভিযোগের তদন্ত করছেন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব নাহিদ উল মোস্তাক। গত ২৯ সেপ্টেম্বর এবিষয়ে মন্ত্রণালয়ে বৈঠক করা হয়েছে বলে বিশ্বস্ত সূত্র নিশ্চিত করেছে। এর আগে গত বৃহস্পতিবার (১৮ সেপ্টেম্বর) গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের দুটি পৃথক প্রজ্ঞাপন ও সরকারি আবাসন পরিদপ্তরের এক আদেশে সহকারী পরিচালক বিলাল হোসাইন, উপপরিচালক রাশেদ আহাম্মেদ সাদী ও সহকারী হিসাবরক্ষক মো. নজরুল ইসলামকে বরখাস্ত করা  হয়েছে।  এ ঘটনায় গত সপ্তাহে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের একজন উপসচিবের নেতৃত্বে তদন্ত টিম চট্টগ্রামে আসে। তারা সরকারি আবাসিক এলাকায় বরাদ্দ সংক্রান্ত ফাইল, নথি ও আর্থিক লেনদেনের খতিয়ান পর্যালোচনা করেন।তদন্ত টিমের এক কর্মকর্তা জানান, “বাসা বরাদ্দে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা এবং অনিয়ম বন্ধ করাই আমাদের মূল লক্ষ্য। অভিযোগের সত্যতা মিললে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” জানা যায়, সরকারি বাসা বরাদ্দে সুবিধার্থে বিগত ২০১৯ সালের ১০ এপ্রিল একটি গেজেট প্রকাশ করে বাংলাদেশ সরকার। গেজেট অনুযায়ী গ্রেড ১৮,১৯ ও ২০ পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের জন্য এ টাইপ, ১৬, ১৭ ও ১৮ এর জন্য বি টাইপ, ১৪, ১৫ ও ১৬ এর জন্য সি-২ টাইপ, ১২, ১৩ ও ১৪ এর জন্য সি-১ টাইপ, ১০, ১১ ও ১২ এর জন্য ডি-২ টাইপ, ৭, ৮ ও ৯ এর জন্য ডি-১ টাইপ, ই টাইপ এর জন্য গ্রেড ৬ থেকে উপরের কর্মকর্তা, এফ টাইপ গ্রেড ৫ ও এর উপরের গ্রেডের কর্মকর্তা/ উপ সচিব এর জন্য, গ্রেড ৩ বা যুগ্নসচিব এর উপরের কর্মকর্তাদের জন্য সুপিরিয়র টাইপের বাসা বরাদ্দ দেয়ার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু ২০২৪ সালের ১৫ অক্টোবর জেলা প্রসাশকের কার্যালয়ে জেলা আবসন বোর্ডের সভায় ২২২টি বাসা বরাদ্দে বাংলাদেশ গেজেটটি ফলো করা হয়নি। এসব বাসা বরাদ্দে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ ওঠেছে।

জানা যায়, এসব অনিয়ম নিয়ে চট্টগ্রাম আবাসন পরিদপ্তরের উপপরিচালকসহ ৯ জনের নাম উল্লেখ করে, গতবছরের ২৯  অক্টোবর গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবরে একটি লিখিত অভিযোগ করেন চট্টগ্রাম নির্বাচন কমিশন অফিসের হিসাব সহকারী মো. আলা উদ্দীন। অভিযোগে বলা হয়েছে, সরকারি আবাসন পরিদপ্তর, চট্টগ্রামের উপ পরিচালক মুনতাসির জাহান, প্রধান সহকারী মো. মোজাফ্ফর হোসেন, উচ্চমান সহকারী মো. দেলওয়ার হোসেন, রাজীব বড়ুয়া, উচ্চমান সহকারী, মো. আরিফুর রহমান, মো. ফিরোজ কবির প্রধান, সাঁট-মুদ্রাক্ষরিক কাম কম্পিউটার অপারেটর বকুল জ্যোতি চাকমা, সহকারী হিসাব রক্ষক প্রদীপ কুমার রায় ও অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক সেন্টলী চাকমার, যোগসাজশে ২৮ জন ব্যক্তিকে সরকারি গেজেট অনুসরণ না করে সর্বমোট ৭৯ লাখ টাকা ঘুষ গ্রহণের মাধ্যমে অবৈধভাবে ২য় শ্রেণির কর্মচারীকে ১ম শ্রেণির সরকারি বাসা, ৩য় শ্রেণির কর্মচারীকে ২য় শ্রেণির বাসা এবং ৪র্থ শ্রেণির কর্মচারীকে ২ শ্রেণির বাসা বরাদ্দ প্রদান করে শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন।

অভিযোগে বলা হয়েছে, হালিশহর আহমদিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক (১০ম গ্রেড) মোজাম্মেল হক তিনি ডি/৭-ডি নাফ সিজিএস, সুলতান আল নাহিয়ান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আনোয়ার শাদাত (১০ম গ্রেড) ডি৭/১সি নাফ সিজিএস এর বাসা বরাদ্দ পেয়েছেন। প্রকৃতপক্ষে এই বাসাগুলো ৭,৮,৯ গ্রেডের জন্য বরাদ্দ দেয়ার কথা। একইভাবে আগ্রাবাদ সরকারি কলোনী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের  ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক (১৩ তম গ্রেড) তিনি ডি-৭/১৭ নাফ সিজিএস, ডবলমুরিং থানা শিক্ষা অফিসের অফিস সহকারী প্রতাপ কান্তি দস্তিদার (১৬ তম গ্রেড) সে ডি-২/১সি হালদা সিজিএস, কর অফিসের সাঁট মুদ্রাক্ষরিক সাদ্দাম হোসেন (১৪তম) ডি-২/২২ হালদা, ফারহানা আক্তার (১৪তম) ডি-২/১ হালদা,কর অঞ্চল ৪ এর সার্কেল ৮১ এর উচ্চমান সহকারী আমির হোসেন (১৪তম) ডি-২/৯ টাইপের বাসা বরাদ্দ পেয়েছে। যা গেজেটের সাথে সাংঘর্ষিক। এসব বাসা বরাদ্দে ৩ লাখ টাকা ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ তুলেছেন। এছাড়াও শেরশাহ কলোনীতে সি-২/কে, সি- ১/ডি, সি- ১/সি, সি- ১/ এইচ সহ অনেক বাসা ২ থেকে আড়াই লাখ টাকা ঘুষের মাধ্যমে নেয়া হয়েছে। একইভাবে বাসা বরাদ্দ ক্রমিকের ৪১, ৪২, ৪৩, ৪৪, ৪৫, ৫৩, ৫৪, ৫৫, ৫৬, ৫৭, ৫৮, ৫৯, ৬০, ৬১, ৭২, ৭৩, ৭৪, ৭৫, ৭৬, ৭৭, ৭৮, ৭৯, ৮০, ৮১, ৮৬, ৯৩, ৯৬, ৯৭ নং বাসাগুলো ঘুষের বিনিময়ে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। আর এসব ঘুষের মূলহোতা হিসেবে কাজ করছেন, চট্টগ্রাম আবাসন অফিসের প্রধান সহকারী মো. মোজাফফর, সাথে আছে ফিরোজ ও প্রদীপ। তারা টাকার বিনিময়ে যোগ্য লোককে বাসা না দিয়ে অপেক্ষাকৃত কম যোগ্য লোককে বাসা পেতে সহযোগিতা করেন, এরফলে প্রতিনিয়ত মোটা অংকের রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। অন্যদিকে, স্থানীয় কয়েকজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, বহু বছর ধরে এই আবাসন ব্যবস্থায় দালাল ও কিছু ভেতরের কর্মচারী যোগসাজশে ঘুষ বাণিজ্য চালাচ্ছে। ফলে প্রকৃত চাহিদাভিত্তিক কর্মকর্তারা বঞ্চিত হচ্ছেন।

এব্যপারে আবাসন পরিদপ্তর চট্টগ্রামের উপপরিচালক মুনতাসির জাহান বলেন,
বাসা বরাদ্দ দিয়ে থাকেন জেলা আবাসন বোর্ড। যেটির সভাপতি জেলা প্রশাসক। তিনি ছাড়াও আরো ৯ জন সদস্য থাকেন। সরকারী নিয়ম মেনেই বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। তবে বাসা বরাদ্দের কোন এখতিয়ার আবাসন পরিদপ্তরের নেই। আমরা শুধুমাত্র সাচিবিক কাজগুলো করে থাকি। গতবছরের একটি অভিযোগের শুনানিতে মন্ত্রণালয়ে যাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে তিনি বলেন, আমরা সবাই শুনানিতে গিয়েছি কিন্তু আবেদনকারী আসেনি। আর যে ব্যক্তি অভিযোগ দিয়েছেন ওই নামের (আলা উদ্দীন) কোন ব্যক্তির অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি।” 

তবে বিশ্বস্ত একটি সূত্র জানিয়েছে, এর আগে আলাউদ্দীন (আবেদনকারী) তদন্তকারী কর্মকর্তার সাথে কথা বলেছে, দেখাও করেছে। শুধুমাত্র ২৯/৯/২৪ এর শুনানিতে তিনি উপস্থিত হতে পারেননি। আবার যদি শুনানির জন্য চিঠি দেয়া হয় তবে যথাসময়ে উপস্থিত থাকবেন। 

এব্যপারে জানতে অভিযোগের তদন্তকারী কর্মকর্তা গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের উপসচিব নাহিদ উল মোস্তাকের মোবাইলে কল দিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি।

অভিযোগে আরো বলা হয়েছে, যারা সিন্ডিকেট ঘুষের বিনিময়ে বাসা নিতে আগ্রহী তারাই পেয়ে থাকেন তা না হলে বাসা যেন সোনার হরিণ।

কোন কর্মচারী নিয়ম অনুযায়ী সরকারি বাসা বরাদ্দের জন্য আবেদন করলেও তাদের সিন্ডিকেটকে যারা ঘুষ দেন শুধুমাত্র তারাই সরকারি বাসা বরাদ্দ পেয়ে থাকেন।  শেরশাহ কলোনির সি-১/ডি বাসাটি হাবিব নামে একজন তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীকে না দিয়ে টাকার বিনিময়ে ৪র্থ শ্রেণির পুলিশ কনস্টেবলকে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। শেরশাহ সরকারি কলোনির সি টাইপের ১ নং ভবনটি মেজিস্ট্রেটদের থাকার জন্য করা হয়েছিল। উনারা ভবনে না উঠায় বিভিন্ন দপ্তরের লোককে বরাদ্দ দেয়া হয়। কিন্তুু বর্তমানে শেরশাহ সরকারি কলোনিতে ৮ থেকে ১০ টি ছাড়া বাকি সব বাসাই পুলিশ কনস্টেবল, হাবিলদার ও এএসআইদের দখলে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ সেখানে অবৈধভাবে বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণসহ বড় পানির ট্যাংক বসিয়েছেন, যা কলোনির পরিবেশ নষ্ট করছে। 

এবিষয়ে জানতে চট্টগ্রাম আবাসন পরিদপ্তরের প্রধান সহকারী মো. মোজাফফরের অফিসে গিয়ে এবং মোবাইলে কল দিয়েও পাওয়া যায়নি।

চট্টগ্রাম আবাসন পরিদপ্তরে সরকারি বাসা বরাদ্দকে কেন্দ্র করে ঘুষ বাণিজ্য ও কোটি টাকার নয়ছয়ের অভিযোগ নতুন নয়। তবে এবার সরাসরি মন্ত্রণালয়ের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারা তদন্তে নেমেছেন। অভিযোগকারীরা মনে করছেন, যদি এ তদন্ত সঠিকভাবে সম্পন্ন হয়, তাহলে দুর্নীতির দীর্ঘদিনের এই চক্র ভেঙে পড়বে এবং সরকারি কর্মকর্তারা স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় বাসা বরাদ্দের সুযোগ পাবেন।#

ট্যাগস :

নিউজটি শেয়ার করুন

চট্টগ্রামে ঘুষ ছাড়া মিলছে না সরকারি বাসা, তদন্তে উপসচিব

আপডেট সময়ঃ ০৮:৩২:৩৪ অপরাহ্ন, বুধবার, ১ অক্টোবর ২০২৫

প্রভাবশালী দালালচক্র ও কর্মকর্তাদের আঁতাতেই ঘুষের বিনিময়ে হচ্ছে বাসা বরাদ্দ। সরকারি অর্থ নয়ছয় ও অনিয়মে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে আবাসন দপ্তর।

রিপন চৌধুরী বিশেষ প্রতিনিধি :

গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধিনস্ত চট্টগ্রামে সরকারী আবাসন পরিদপ্তরে বাসা বরাদ্দ প্রক্রিয়ায় ঘুষ বাণিজ্য ও সরকারি অর্থ নয়ছয়ের অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগ রয়েছে, একটি প্রভাবশালী চক্র সরকারি নিয়ম উপেক্ষা করে অতিরিক্ত অর্থের বিনিময়ে পছন্দসই বাসা বরাদ্দ দিয়ে আসছে।

ঘুষের বিনিময়ে অফিসারদের জন্য নির্ধারিত বাসা পিয়নের নামে বরাদ্দ দিয়ে সরকারি অর্থ নয়ছয় করছে চক্রটি। আর ঘুষ না দিলে অফিসারদের বাসা বরাদ্দ নিয়ে টালবাহানার অভিযোগ পাওয়া গেছে। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, বরাদ্দ প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করছে আবাসন পরিদপ্তরের ভেতরের একটি প্রভাবশালী সিন্ডিকেট। এ চক্রের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী ও বহিরাগত দালাল।তাদের মাধ্যমেই ঘুষের টাকা আদান-প্রদান হয়। অনেক ক্ষেত্রে বরাদ্দ ফাইল মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর আগেই অঘোষিত ‘রেট’ নির্ধারণ করা হয়। এসব বিষয় নিয়ে করা একটি অভিযোগের তদন্ত করছেন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব নাহিদ উল মোস্তাক। গত ২৯ সেপ্টেম্বর এবিষয়ে মন্ত্রণালয়ে বৈঠক করা হয়েছে বলে বিশ্বস্ত সূত্র নিশ্চিত করেছে। এর আগে গত বৃহস্পতিবার (১৮ সেপ্টেম্বর) গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের দুটি পৃথক প্রজ্ঞাপন ও সরকারি আবাসন পরিদপ্তরের এক আদেশে সহকারী পরিচালক বিলাল হোসাইন, উপপরিচালক রাশেদ আহাম্মেদ সাদী ও সহকারী হিসাবরক্ষক মো. নজরুল ইসলামকে বরখাস্ত করা  হয়েছে।  এ ঘটনায় গত সপ্তাহে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের একজন উপসচিবের নেতৃত্বে তদন্ত টিম চট্টগ্রামে আসে। তারা সরকারি আবাসিক এলাকায় বরাদ্দ সংক্রান্ত ফাইল, নথি ও আর্থিক লেনদেনের খতিয়ান পর্যালোচনা করেন।তদন্ত টিমের এক কর্মকর্তা জানান, “বাসা বরাদ্দে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা এবং অনিয়ম বন্ধ করাই আমাদের মূল লক্ষ্য। অভিযোগের সত্যতা মিললে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” জানা যায়, সরকারি বাসা বরাদ্দে সুবিধার্থে বিগত ২০১৯ সালের ১০ এপ্রিল একটি গেজেট প্রকাশ করে বাংলাদেশ সরকার। গেজেট অনুযায়ী গ্রেড ১৮,১৯ ও ২০ পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের জন্য এ টাইপ, ১৬, ১৭ ও ১৮ এর জন্য বি টাইপ, ১৪, ১৫ ও ১৬ এর জন্য সি-২ টাইপ, ১২, ১৩ ও ১৪ এর জন্য সি-১ টাইপ, ১০, ১১ ও ১২ এর জন্য ডি-২ টাইপ, ৭, ৮ ও ৯ এর জন্য ডি-১ টাইপ, ই টাইপ এর জন্য গ্রেড ৬ থেকে উপরের কর্মকর্তা, এফ টাইপ গ্রেড ৫ ও এর উপরের গ্রেডের কর্মকর্তা/ উপ সচিব এর জন্য, গ্রেড ৩ বা যুগ্নসচিব এর উপরের কর্মকর্তাদের জন্য সুপিরিয়র টাইপের বাসা বরাদ্দ দেয়ার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু ২০২৪ সালের ১৫ অক্টোবর জেলা প্রসাশকের কার্যালয়ে জেলা আবসন বোর্ডের সভায় ২২২টি বাসা বরাদ্দে বাংলাদেশ গেজেটটি ফলো করা হয়নি। এসব বাসা বরাদ্দে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ ওঠেছে।

জানা যায়, এসব অনিয়ম নিয়ে চট্টগ্রাম আবাসন পরিদপ্তরের উপপরিচালকসহ ৯ জনের নাম উল্লেখ করে, গতবছরের ২৯  অক্টোবর গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবরে একটি লিখিত অভিযোগ করেন চট্টগ্রাম নির্বাচন কমিশন অফিসের হিসাব সহকারী মো. আলা উদ্দীন। অভিযোগে বলা হয়েছে, সরকারি আবাসন পরিদপ্তর, চট্টগ্রামের উপ পরিচালক মুনতাসির জাহান, প্রধান সহকারী মো. মোজাফ্ফর হোসেন, উচ্চমান সহকারী মো. দেলওয়ার হোসেন, রাজীব বড়ুয়া, উচ্চমান সহকারী, মো. আরিফুর রহমান, মো. ফিরোজ কবির প্রধান, সাঁট-মুদ্রাক্ষরিক কাম কম্পিউটার অপারেটর বকুল জ্যোতি চাকমা, সহকারী হিসাব রক্ষক প্রদীপ কুমার রায় ও অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক সেন্টলী চাকমার, যোগসাজশে ২৮ জন ব্যক্তিকে সরকারি গেজেট অনুসরণ না করে সর্বমোট ৭৯ লাখ টাকা ঘুষ গ্রহণের মাধ্যমে অবৈধভাবে ২য় শ্রেণির কর্মচারীকে ১ম শ্রেণির সরকারি বাসা, ৩য় শ্রেণির কর্মচারীকে ২য় শ্রেণির বাসা এবং ৪র্থ শ্রেণির কর্মচারীকে ২ শ্রেণির বাসা বরাদ্দ প্রদান করে শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন।

অভিযোগে বলা হয়েছে, হালিশহর আহমদিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক (১০ম গ্রেড) মোজাম্মেল হক তিনি ডি/৭-ডি নাফ সিজিএস, সুলতান আল নাহিয়ান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আনোয়ার শাদাত (১০ম গ্রেড) ডি৭/১সি নাফ সিজিএস এর বাসা বরাদ্দ পেয়েছেন। প্রকৃতপক্ষে এই বাসাগুলো ৭,৮,৯ গ্রেডের জন্য বরাদ্দ দেয়ার কথা। একইভাবে আগ্রাবাদ সরকারি কলোনী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের  ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক (১৩ তম গ্রেড) তিনি ডি-৭/১৭ নাফ সিজিএস, ডবলমুরিং থানা শিক্ষা অফিসের অফিস সহকারী প্রতাপ কান্তি দস্তিদার (১৬ তম গ্রেড) সে ডি-২/১সি হালদা সিজিএস, কর অফিসের সাঁট মুদ্রাক্ষরিক সাদ্দাম হোসেন (১৪তম) ডি-২/২২ হালদা, ফারহানা আক্তার (১৪তম) ডি-২/১ হালদা,কর অঞ্চল ৪ এর সার্কেল ৮১ এর উচ্চমান সহকারী আমির হোসেন (১৪তম) ডি-২/৯ টাইপের বাসা বরাদ্দ পেয়েছে। যা গেজেটের সাথে সাংঘর্ষিক। এসব বাসা বরাদ্দে ৩ লাখ টাকা ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ তুলেছেন। এছাড়াও শেরশাহ কলোনীতে সি-২/কে, সি- ১/ডি, সি- ১/সি, সি- ১/ এইচ সহ অনেক বাসা ২ থেকে আড়াই লাখ টাকা ঘুষের মাধ্যমে নেয়া হয়েছে। একইভাবে বাসা বরাদ্দ ক্রমিকের ৪১, ৪২, ৪৩, ৪৪, ৪৫, ৫৩, ৫৪, ৫৫, ৫৬, ৫৭, ৫৮, ৫৯, ৬০, ৬১, ৭২, ৭৩, ৭৪, ৭৫, ৭৬, ৭৭, ৭৮, ৭৯, ৮০, ৮১, ৮৬, ৯৩, ৯৬, ৯৭ নং বাসাগুলো ঘুষের বিনিময়ে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। আর এসব ঘুষের মূলহোতা হিসেবে কাজ করছেন, চট্টগ্রাম আবাসন অফিসের প্রধান সহকারী মো. মোজাফফর, সাথে আছে ফিরোজ ও প্রদীপ। তারা টাকার বিনিময়ে যোগ্য লোককে বাসা না দিয়ে অপেক্ষাকৃত কম যোগ্য লোককে বাসা পেতে সহযোগিতা করেন, এরফলে প্রতিনিয়ত মোটা অংকের রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। অন্যদিকে, স্থানীয় কয়েকজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, বহু বছর ধরে এই আবাসন ব্যবস্থায় দালাল ও কিছু ভেতরের কর্মচারী যোগসাজশে ঘুষ বাণিজ্য চালাচ্ছে। ফলে প্রকৃত চাহিদাভিত্তিক কর্মকর্তারা বঞ্চিত হচ্ছেন।

এব্যপারে আবাসন পরিদপ্তর চট্টগ্রামের উপপরিচালক মুনতাসির জাহান বলেন,
বাসা বরাদ্দ দিয়ে থাকেন জেলা আবাসন বোর্ড। যেটির সভাপতি জেলা প্রশাসক। তিনি ছাড়াও আরো ৯ জন সদস্য থাকেন। সরকারী নিয়ম মেনেই বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। তবে বাসা বরাদ্দের কোন এখতিয়ার আবাসন পরিদপ্তরের নেই। আমরা শুধুমাত্র সাচিবিক কাজগুলো করে থাকি। গতবছরের একটি অভিযোগের শুনানিতে মন্ত্রণালয়ে যাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে তিনি বলেন, আমরা সবাই শুনানিতে গিয়েছি কিন্তু আবেদনকারী আসেনি। আর যে ব্যক্তি অভিযোগ দিয়েছেন ওই নামের (আলা উদ্দীন) কোন ব্যক্তির অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি।” 

তবে বিশ্বস্ত একটি সূত্র জানিয়েছে, এর আগে আলাউদ্দীন (আবেদনকারী) তদন্তকারী কর্মকর্তার সাথে কথা বলেছে, দেখাও করেছে। শুধুমাত্র ২৯/৯/২৪ এর শুনানিতে তিনি উপস্থিত হতে পারেননি। আবার যদি শুনানির জন্য চিঠি দেয়া হয় তবে যথাসময়ে উপস্থিত থাকবেন। 

এব্যপারে জানতে অভিযোগের তদন্তকারী কর্মকর্তা গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের উপসচিব নাহিদ উল মোস্তাকের মোবাইলে কল দিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি।

অভিযোগে আরো বলা হয়েছে, যারা সিন্ডিকেট ঘুষের বিনিময়ে বাসা নিতে আগ্রহী তারাই পেয়ে থাকেন তা না হলে বাসা যেন সোনার হরিণ।

কোন কর্মচারী নিয়ম অনুযায়ী সরকারি বাসা বরাদ্দের জন্য আবেদন করলেও তাদের সিন্ডিকেটকে যারা ঘুষ দেন শুধুমাত্র তারাই সরকারি বাসা বরাদ্দ পেয়ে থাকেন।  শেরশাহ কলোনির সি-১/ডি বাসাটি হাবিব নামে একজন তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীকে না দিয়ে টাকার বিনিময়ে ৪র্থ শ্রেণির পুলিশ কনস্টেবলকে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। শেরশাহ সরকারি কলোনির সি টাইপের ১ নং ভবনটি মেজিস্ট্রেটদের থাকার জন্য করা হয়েছিল। উনারা ভবনে না উঠায় বিভিন্ন দপ্তরের লোককে বরাদ্দ দেয়া হয়। কিন্তুু বর্তমানে শেরশাহ সরকারি কলোনিতে ৮ থেকে ১০ টি ছাড়া বাকি সব বাসাই পুলিশ কনস্টেবল, হাবিলদার ও এএসআইদের দখলে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ সেখানে অবৈধভাবে বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণসহ বড় পানির ট্যাংক বসিয়েছেন, যা কলোনির পরিবেশ নষ্ট করছে। 

এবিষয়ে জানতে চট্টগ্রাম আবাসন পরিদপ্তরের প্রধান সহকারী মো. মোজাফফরের অফিসে গিয়ে এবং মোবাইলে কল দিয়েও পাওয়া যায়নি।

চট্টগ্রাম আবাসন পরিদপ্তরে সরকারি বাসা বরাদ্দকে কেন্দ্র করে ঘুষ বাণিজ্য ও কোটি টাকার নয়ছয়ের অভিযোগ নতুন নয়। তবে এবার সরাসরি মন্ত্রণালয়ের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারা তদন্তে নেমেছেন। অভিযোগকারীরা মনে করছেন, যদি এ তদন্ত সঠিকভাবে সম্পন্ন হয়, তাহলে দুর্নীতির দীর্ঘদিনের এই চক্র ভেঙে পড়বে এবং সরকারি কর্মকর্তারা স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় বাসা বরাদ্দের সুযোগ পাবেন।#