ঢাকা, শনিবার, ০১ নভেম্বর ২০২৫ | ই-পেপার

টেকনাফ উপকূলে নৌবাহিনী-কোস্টগার্ডের অভিযান : ৩৯ জন উদ্ধার

দৈনিক আইন বার্তা
  • আপডেট সময়ঃ ০৫:৪০:২১ অপরাহ্ন, শনিবার, ৪ অক্টোবর ২০২৫
  • / ৭২ বার পড়া হয়েছে

রিপন চৌধুরী বিশেষ প্রতিনিধি :

কক্সবাজারের টেকনাফ উপকূলে আবারও সক্রিয় হয়ে উঠেছে আন্তর্জাতিক মানবপাচারচক্র। এরই অংশ হিসেবে অপহরণের শিকার ৩৯ জনকে উদ্ধার করেছে নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ড। এসময় পাচারচক্রের দুই সক্রিয় সদস্যকে আটক করা হয়। শুক্রবার (৩ অক্টোবর) ভোর রাতে সেন্টমার্টিনগামী সমুদ্রপথে বিশেষ এই অভিযান পরিচালিত হয়।
কোস্টগার্ড ও নৌবাহিনী সূত্র জানায়, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিনগামী একটি ট্রলারে তল্লাশি চালানো হয়। তখন সেখানে অমানবিকভাবে আটকে রাখা ৩৯ জনকে উদ্ধার করা হয়। উদ্ধারকৃতদের মধ্যে নারী ও শিশুও ছিল। পাচারকারীরা ট্রলারটিকে মিয়ানমার সীমান্তের কাছাকাছি নিয়ে যাচ্ছিল বলে জানা গেছে। উদ্ধার হওয়া ব্যক্তিরা দীর্ঘসময় না খাওয়া ও মানসিক চাপে দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন। তাদের প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়। আটক দুই পাচারকারীকে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে পুলিশের কাছে হস্তান্তরের প্রস্তুতি চলছে।

গতকাল (০২-১০-২৫) দিবাগত রাতে টেকনাফ উপজেলার বাহারছড়া ইউনিয়নস্থ কচ্ছপিয়া পাহাড়ের গহিনে একটি সংঘবদ্ধ অপহরণকারী ও মানবপাচারকারী চক্র কর্তৃক মুক্তিপণ আদায় ও বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে মালয়েশিয়া পাচারের উদ্দেশ্যে নারী ও শিশুসহ বিভিন্ন শ্রেণির মানুষকে আটকে রাখার সংবাদ পাওয়া যায়। সংবাদ পাওয়ার সাথে সাথে দ্রুততম সময়ের মধ্যে নৌবাহিনীর বিশেষায়িত ফোর্স সোয়াডসের কমান্ডোদলসহ কোস্টগার্ডের আভিযানিক দল ঘটনাস্থলে পৌঁছে যায়।

এ সময় মানবপাচারকারী চক্র সদস্যরা অভিযানিক দলের উপস্থিতি টের পেয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে তাদের ধাওয়া করে ঘটনাস্থল থেকে ০২ জনকে আটক করা হয়। পরবর্তীতে গহীন পাহাড়ের চিরুনি অভিযান চালিয়ে পাহাড়ের কয়েকটি স্থান হতে অপহরণের শিকার নারী, পুরুষ ও শিশুসহ ৩৯ জনকে উদ্ধার করা হয়। উদ্ধারকৃতদের মধ্যে রয়েছে ১৮ জন রোহিঙ্গা নারী, ১১ জন রোহিঙ্গা পুরুষ, ০৮ জন রোহিঙ্গা শিশু ও ০২ জন বাঙালি পুরুষ।

উদ্ধারকারীদের ভাষ্যমতে জানা যায় পাহাড়ে একটি সঙ্ঘবদ্ধ মানব পাচারকারী দল বিভিন্ন সময়ে প্রলোভন দেখিয়ে ও অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে তুলে এনে গহীন পাহাড়ে আটকে রাখে। আটকে রাখাদের মধ্যে কারো কারো কাছ থেকে মুক্তিপণ দাবী ও বিদেশে প্রেরণের কথা বলে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নেয় চক্রটি। উদ্ধারকৃত ভিকটিমদের পরিবারের নিকট হস্তান্তর এবং আটককৃত মানবপাচারকারী চক্রের সদস্যদ্বয়ের বিরুদ্ধে পরবর্তী আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। স্থানীয়দের মতে, দীর্ঘদিন ধরে টেকনাফ ও কক্সবাজার উপকূল দিয়ে মানবপাচার চলছে। উন্নত জীবনের আশায় মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখিয়ে দালালচক্র গরিব মানুষদের টার্গেট করে। পরে তাদের পরিবার থেকে মোটা অঙ্কের টাকা আদায় করা হয়। অনেকে মুক্তিপণের টাকাও দিতে না পারলে অপহরণের শিকার হন। উদ্ধার হওয়া এক যুবক জানান, তাকে কাজের প্রলোভন দেখিয়ে টেকনাফে আনা হয়েছিল। পরে কয়েকজন অস্ত্রধারী লোক তাকে আটক করে রাখে এবং পরিবারের কাছে মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করে। তার মতো আরও অনেকে একই অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন। গত ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫ হতে ০২ অক্টোবর পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে যৌথ অভিযানে সর্বমোট ১৩৪ জনকে উদ্ধার করে বাংলাদেশ নৌবাহিনী।

বাংলাদেশ নৌবাহিনী তার দায়িত্বপূর্ণ এলাকা সমূহে মানব পাচার চোরাচালানসহ যে-কোনো ধরনের অপরাধ নির্মূলে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে এবং এধরনের অভিযান অব্যাহত থাকবে। নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ডের অভিযানে ৩৯ জন অপহৃত মানুষের জীবন বাঁচলেও এটি প্রমাণ করেছে—মানবপাচারচক্র এখনও সক্রিয় এবং ভয়াবহ। এ ধরনের অভিযান সাময়িক স্বস্তি দিলেও স্থায়ী সমাধান হবে তখনই, যখন পাচারকারীদের মূল গডফাদারদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা হবে এবং মানুষকে এ চক্রের ফাঁদে পড়া থেকে রক্ষা করা যাবে।

ট্যাগস :

নিউজটি শেয়ার করুন

টেকনাফ উপকূলে নৌবাহিনী-কোস্টগার্ডের অভিযান : ৩৯ জন উদ্ধার

আপডেট সময়ঃ ০৫:৪০:২১ অপরাহ্ন, শনিবার, ৪ অক্টোবর ২০২৫

রিপন চৌধুরী বিশেষ প্রতিনিধি :

কক্সবাজারের টেকনাফ উপকূলে আবারও সক্রিয় হয়ে উঠেছে আন্তর্জাতিক মানবপাচারচক্র। এরই অংশ হিসেবে অপহরণের শিকার ৩৯ জনকে উদ্ধার করেছে নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ড। এসময় পাচারচক্রের দুই সক্রিয় সদস্যকে আটক করা হয়। শুক্রবার (৩ অক্টোবর) ভোর রাতে সেন্টমার্টিনগামী সমুদ্রপথে বিশেষ এই অভিযান পরিচালিত হয়।
কোস্টগার্ড ও নৌবাহিনী সূত্র জানায়, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিনগামী একটি ট্রলারে তল্লাশি চালানো হয়। তখন সেখানে অমানবিকভাবে আটকে রাখা ৩৯ জনকে উদ্ধার করা হয়। উদ্ধারকৃতদের মধ্যে নারী ও শিশুও ছিল। পাচারকারীরা ট্রলারটিকে মিয়ানমার সীমান্তের কাছাকাছি নিয়ে যাচ্ছিল বলে জানা গেছে। উদ্ধার হওয়া ব্যক্তিরা দীর্ঘসময় না খাওয়া ও মানসিক চাপে দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন। তাদের প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়। আটক দুই পাচারকারীকে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে পুলিশের কাছে হস্তান্তরের প্রস্তুতি চলছে।

গতকাল (০২-১০-২৫) দিবাগত রাতে টেকনাফ উপজেলার বাহারছড়া ইউনিয়নস্থ কচ্ছপিয়া পাহাড়ের গহিনে একটি সংঘবদ্ধ অপহরণকারী ও মানবপাচারকারী চক্র কর্তৃক মুক্তিপণ আদায় ও বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে মালয়েশিয়া পাচারের উদ্দেশ্যে নারী ও শিশুসহ বিভিন্ন শ্রেণির মানুষকে আটকে রাখার সংবাদ পাওয়া যায়। সংবাদ পাওয়ার সাথে সাথে দ্রুততম সময়ের মধ্যে নৌবাহিনীর বিশেষায়িত ফোর্স সোয়াডসের কমান্ডোদলসহ কোস্টগার্ডের আভিযানিক দল ঘটনাস্থলে পৌঁছে যায়।

এ সময় মানবপাচারকারী চক্র সদস্যরা অভিযানিক দলের উপস্থিতি টের পেয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে তাদের ধাওয়া করে ঘটনাস্থল থেকে ০২ জনকে আটক করা হয়। পরবর্তীতে গহীন পাহাড়ের চিরুনি অভিযান চালিয়ে পাহাড়ের কয়েকটি স্থান হতে অপহরণের শিকার নারী, পুরুষ ও শিশুসহ ৩৯ জনকে উদ্ধার করা হয়। উদ্ধারকৃতদের মধ্যে রয়েছে ১৮ জন রোহিঙ্গা নারী, ১১ জন রোহিঙ্গা পুরুষ, ০৮ জন রোহিঙ্গা শিশু ও ০২ জন বাঙালি পুরুষ।

উদ্ধারকারীদের ভাষ্যমতে জানা যায় পাহাড়ে একটি সঙ্ঘবদ্ধ মানব পাচারকারী দল বিভিন্ন সময়ে প্রলোভন দেখিয়ে ও অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে তুলে এনে গহীন পাহাড়ে আটকে রাখে। আটকে রাখাদের মধ্যে কারো কারো কাছ থেকে মুক্তিপণ দাবী ও বিদেশে প্রেরণের কথা বলে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নেয় চক্রটি। উদ্ধারকৃত ভিকটিমদের পরিবারের নিকট হস্তান্তর এবং আটককৃত মানবপাচারকারী চক্রের সদস্যদ্বয়ের বিরুদ্ধে পরবর্তী আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। স্থানীয়দের মতে, দীর্ঘদিন ধরে টেকনাফ ও কক্সবাজার উপকূল দিয়ে মানবপাচার চলছে। উন্নত জীবনের আশায় মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখিয়ে দালালচক্র গরিব মানুষদের টার্গেট করে। পরে তাদের পরিবার থেকে মোটা অঙ্কের টাকা আদায় করা হয়। অনেকে মুক্তিপণের টাকাও দিতে না পারলে অপহরণের শিকার হন। উদ্ধার হওয়া এক যুবক জানান, তাকে কাজের প্রলোভন দেখিয়ে টেকনাফে আনা হয়েছিল। পরে কয়েকজন অস্ত্রধারী লোক তাকে আটক করে রাখে এবং পরিবারের কাছে মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করে। তার মতো আরও অনেকে একই অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন। গত ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫ হতে ০২ অক্টোবর পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে যৌথ অভিযানে সর্বমোট ১৩৪ জনকে উদ্ধার করে বাংলাদেশ নৌবাহিনী।

বাংলাদেশ নৌবাহিনী তার দায়িত্বপূর্ণ এলাকা সমূহে মানব পাচার চোরাচালানসহ যে-কোনো ধরনের অপরাধ নির্মূলে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে এবং এধরনের অভিযান অব্যাহত থাকবে। নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ডের অভিযানে ৩৯ জন অপহৃত মানুষের জীবন বাঁচলেও এটি প্রমাণ করেছে—মানবপাচারচক্র এখনও সক্রিয় এবং ভয়াবহ। এ ধরনের অভিযান সাময়িক স্বস্তি দিলেও স্থায়ী সমাধান হবে তখনই, যখন পাচারকারীদের মূল গডফাদারদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা হবে এবং মানুষকে এ চক্রের ফাঁদে পড়া থেকে রক্ষা করা যাবে।