বিমানবন্দরের নিরাপত্তায় নতুন বাহিনী ‘এয়ার গার্ড অব বাংলাদেশ’

- আপডেট সময়ঃ ০২:৩৯:১৮ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫
- / ১৮ বার পড়া হয়েছে
বিমানবন্দরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকার এয়ার গার্ড অব বাংলাদেশ (এজিবি) নামে নতুন বাহিনী গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে। এ লক্ষ্যে এর কার্যকারিতা ও প্রয়োজনীয়তা যাচাইয়ের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে ১২ সদস্যের একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি গঠন করা হয়েছে। গত ৩১ আগস্ট এই কমিটি তাদের কার্যক্রম শুরু করেছে। এই বাহিনী গঠনে সম্ভাব্য খরচ ধরা হয়েছে ৩৯৭ কোটি টাকা।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, কমিটিতে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয়, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়, পুলিশ ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন অনুবিভাগের প্রতিনিধিরা অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন। কমিটিকে এজিবি গঠনের জন্য সুপারিশ প্রণয়নের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর পক্ষ থেকে এ বাহিনী গঠনের প্রস্তাব আসে। পরে সেটির যৌক্তিকতা যাচাইয়ের জন্য কমিটি গঠন করা হয়। বিষয়টি এখন প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব নাসিমুল গনি সমকালকে বলেন, আন্তর্জাতিক বেসামরিক বিমান চলাচল সংস্থার (আইসিএও) নির্দেশনা অনুযায়ী বিমানবন্দরগুলোতে আন্তর্জাতিক মানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এয়ার গার্ড গঠন সময়ের দাবি। প্রথমে এটি বাহিনী হিসেবে কাজ শুরু করবে, পরে অধিদপ্তরে রূপান্তর করা হবে।
জানতে চাইলে আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটির প্রধান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন ও অর্থ) আতাউর রহমান খান বলেন, সবে তো কাজ শুরু হলো। গণমাধ্যমে বলার মতো এখনও কোনো তথ্য নেই। জানা গেছে, ১৯৮৫ সাল থেকে দেশে বেসামরিক বিমান চলাচল পরিচালনা করছে বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)। বর্তমানে বিমানবন্দরের ভেতরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা বিমানবাহিনীর সদস্যরা এবং বাইরের নিরাপত্তা আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন দেখভাল করছে। এ ছাড়া এভিয়েশন সিকিউরিটির সদস্যরা যাত্রীদের এবং তাদের জিনিসপত্রের নিরাপত্তা নিশ্চত করা, নিষিদ্ধ আইটেম যেমন অস্ত্র, বিস্ফোরক ও অবৈধ ড্রাগের জন্য স্ক্রিনিং করা, বিমান এবং লাগেজের নিরাপত্তা পরীক্ষা পরিচালনা করা, এয়ারপোর্ট টহল কার্যক্রম, নিরাপত্তা হুমকি রোধ ও শনাক্ত করা, যে কোনো জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলা করা, বিমানবন্দরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অন্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সঙ্গে কাজ করছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, দেশে বিমানবন্দরের পরিধি যেমন বাড়ছে, তেমনি নিরাপত্তা ব্যবস্থাও আছে ঝুঁকিতে। বিমানবন্দরে দিনের পর দিন চলে আসছে নানা অপরাধ। এতে দেশ-বিদেশে বদনাম হচ্ছে। এ ব্যাপারে জিরো টলারেন্স নীতি নেওয়া হলেও কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। বরং অপরাধীদের আরও বেপরোয়া হয়ে উঠতে দেখা যাচ্ছে। স্বর্ণ ও বৈদেশিক মুদ্রা পাচারসহ সব ধরনের অপরাধই হচ্ছে বিমানবন্দরের আনাচে-কানাচে। অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হচ্ছে।
বেবিচক জানায়, শাহজালাল বিমানবন্দরে বর্তমানে দেশি-বিদেশি অন্তত ৩৭টি বিমান সংস্থা বাংলাদেশে তাদের ফ্লাইট পরিচালনা করে আসছে। ৪৭টি দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের বিমান চলাচল চুক্তি রয়েছে। প্রতিদিন গড়ে ৪০ হাজারের মতো যাত্রী আসা-যাওয়া করছেন শাহজালাল, শাহ আমানত, ওসমানীসহ সব বিমানবন্দরে। কিন্তু বিমানবন্দরের নিরাপত্তা জোরালো না থাকায় যাত্রীবেশী অপরাধীরা সহজেই অপরাধকাণ্ড চালাচ্ছে। বিভিন্ন কৌশল নিয়েও অপরাধীদের নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো। বিশেষ করে চোরাচালান ও মানব পাচারের ঘটনা ঘটছে বেশি। যাত্রী হয়রানি এবং লাগেজ নিয়ে ভোগান্তির অন্ত নেই। এ ছাড়া বিদেশ থেকে আসা যাত্রীরা যানবাহনের অভাবে বেকায়দায় পড়ছেন। বিমানবন্দরের ভেতরে থাকা রেন্ট-এ-কারের লোকজন যাত্রীদের অনেকটা জিম্মি করে ফেলে বলে অভিযোগ আছে। অন্য বিমানবন্দরেও একই অবস্থা।
তবে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে এয়ারপোর্ট আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) ও আনসারের ৯০২ সদস্য দায়িত্ব ছেড়ে চলে গেলে বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। ফ্লাইট ওঠানামা বন্ধ থাকে প্রায় ছয় ঘণ্টা। তখন বাংলাদেশ বিমানবাহিনী জরুরি ভিত্তিতে দায়িত্ব নেয় এবং বর্তমানে তারা বেবিচকের এভিয়েশন সিকিউরিটি ফোর্সের (এভসেক) সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করছে।
এর ফলে এপিবিএন, এয়ারফোর্স ও বেবিচকের মধ্যে সমন্বয়হীনতা ও বিরোধ সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে এয়ারসাইটে এপিবিএনকে দায়িত্ব পালনে বাধা দেওয়ায় পরিস্থিতি জটিল হয়ে ওঠে। এমনকি এপিবিএনের কমান্ড সেন্টার দখল ও গুরুত্বপূর্ণ নথি হারানোর অভিযোগও ওঠে।
এ পরিস্থিতিতে যাত্রীসেবা ও নিরাপত্তার মানোন্নয়নে বেবিচক ও বিমানবাহিনী যৌথভাবে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। লাগেজ চুরি ও যাত্রী হয়রানির মতো দীর্ঘদিনের অভিযোগ কমেছে। যাত্রীদের জন্য বিনামূল্যে ফোন বুথ চালু হওয়াসহ বেশ কিছু উদ্যোগ ইতিবাচক পরিবর্তন আনছে।
এদিকে, বিমানবন্দরের নিরাপত্তার দায়িত্ব নিয়ে বিরোধে জড়িয়েছে সরকারি দুটি বাহিনী। গত ২৪ আগস্ট বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন আহমেদের বৈঠকে এপিবিএনের অধিনায়ক সিহাব কায়সার খান মন্তব্য করেন, বিমানবাহিনী পুলিশকে সহায়তা করার পরিবর্তে রিপ্লেস করেছে। পরে বেবিচকের সদস্য (নিরাপত্তা) এয়ার কমডোর আসিফ ইকবাল এটিকে শিষ্টাচারবহির্ভূত দাবি করে আইজিপির কাছে চিঠি দেন এবং সিহাব কায়সারকে প্রত্যাহারের দাবি জানান।
তবে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলেন, অধিনায়ক মিথ্যা কিছু বলেননি, বরং বাস্তব পরিস্থিতি তুলে ধরেছেন। তাদের মতে, বেবিচক কর্মকর্তার এমন চিঠি পাঠানো শিষ্টাচারবহির্ভূত এবং এর পেছনে অন্য উদ্দেশ্য থাকতে পারে।
এসব বিষয়ে জানতে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মোস্তফা মাহমুদ সিদ্দিকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি সদস্য (নিরাপত্তা) এয়ার কমডোর আসিফ ইকবালের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। এয়ার কমডোর আসিফ ইকবালের সঙ্গে যোগাযোগ করেও তাঁর বক্তব্য পাওয়া সম্ভব হয়নি। সমকালের পক্ষ থেকে দুদিন ধরে তাঁর মোবাইল ফোনে বক্তব্য জানতে চেয়ে মেসেজ পাঠানো হলেও তিনি সাড়া দেননি।
বেবিচক সূত্রে জানা গেছে, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল চালুর প্রস্তুতির অংশ হিসেবে এভসেক বাহিনীতে প্রায় সাড়ে তিন হাজারসহ পাঁচ হাজারের বেশি জনবল নিয়োগ প্রক্রিয়াধীন। তবে দীর্ঘ মেয়াদে বিমানবন্দরের নিরাপত্তা জোরদারে এয়ার গার্ড অব বাংলাদেশ গঠনের উদ্যোগকে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, বিভিন্ন বাহিনীর মধ্যে টানাপোড়েন দূর করে সমন্বিত ও আন্তর্জাতিক মানের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে এয়ার গার্ড নামে নতুন বাহিনী গঠন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। তবে বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় আন্তঃবাহিনী দ্বন্দ্ব সমাধান করাই হবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।