তিন মাসের মধ্যে সুপ্রিম কোর্টের জন্য পৃথক সচিবালয় গঠনের নির্দেশ

- আপডেট সময়ঃ ১২:৫০:৪৫ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২ সেপ্টেম্বর ২০২৫
- / ২৬ বার পড়া হয়েছে
তিন মাসের মধ্যে সুপ্রিম কোর্টের জন্য ‘স্বতন্ত্র সচিবালয়’ প্রতিষ্ঠার নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে সংবিধানে পুনর্বহাল করা হয়েছে ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ।
মঙ্গলবার (২ সেপ্টেম্বর) বিচারপতি আহমেদ সোহেল ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রায় দেন। এ রায়ের ফলে অর্ধশতাব্দী পর অধস্তন আদালতের বিচারকদের নিয়ন্ত্রণ (নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি ও ছুটি) এবং শৃঙ্খলা বিধানের ক্ষমতা ফিরল সুপ্রিম কোর্টের কাছে।
রায়ে অধস্তন আদালতের বিচারকদের নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলা সংক্রান্ত সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদে এ পর্যন্ত যে সংশোধনী আনা হয়েছে, তা অবৈধ ও অসাংবিধানিক উল্লেখ করে বাতিল ঘোষণা করা হয়েছে।
১৯৭২ সালের মূল সংবিধানে ১১৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী অধস্তন আদালতের বিচারকদের বদলি, পদোন্নতি ও শৃঙ্খলা বিধানের ক্ষমতা ছিল সুপ্রিম কোর্টের কাছে। অর্থাৎ বিচারকদের নিয়োগ-পদোন্নতি-বদলি এবং ছুটি মঞ্জুরের ক্ষমতা ছিল প্রধান বিচারপতি ও সুপ্রিম কোর্টের হাতে। কিন্তু ১৯৭৫ সালের চতুর্থ সংশোধনীতে এই ক্ষমতা সুপ্রিম কোর্টের কাছ থেকে নিয়ে রাষ্ট্রপতিকে দেওয়া হয়, যা আইন মন্ত্রণালয় বা অন্য কোনো উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে প্রয়োগ করা হতো।
এর ফলে অধস্তন আদালতের বিচারকদের ওপর নির্বাহী বিভাগের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। যদিও তখন ১১৬ অনুচ্ছেদে বলা ছিল, রাষ্ট্রপতি ‘সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে পরামর্শক্রমে’ এই ক্ষমতা প্রয়োগ করবেন। পরে ১৯৮৯ সালে পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে ১১৬ অনুচ্ছেদ আবার পরিবর্তন আনা হয়। এই সংশোধনীতে ‘সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে পরামর্শক্রমে’ অংশটি বাদ দিয়ে অধস্তন আদালতের বিচারকদের নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষমতা পুরোপুরি রাষ্ট্রপতির হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়।
এসব সংশোধনীর অধীনে ২০১৭ সালে আওয়ামী লীগ সরকার যে শৃঙ্খলাবিধি প্রণয়ন করে, তা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক উল্লেখ করে বাতিল ঘোষণা করা হয়েছে রায়ে।
রাষ্ট্রের তিন স্তম্ভের একটি আরেকটির ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে পারে না
রায়ের পর্যবেক্ষণে হাইকোর্টে বলেছেন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর অংশ। সংবিধানের মৌলিক কাঠামো পরিপন্থি কোনো আইন সংসদ প্রণয়ন করতে পারে না। যদি এমন আইন করা হয়, তবে তা অসাংবিধানিক ঘোষণা করার ক্ষমতা সুপ্রিম কোর্টের রয়েছে।
রায়ে বলা হয়েছে, সংবিধান সাধারণ কোনো আইন নয়।
সংবিধানের কোনো বিধানকে যখন অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হয়, তখন পূর্ববর্তী বিধান স্বয়ংক্রিয়ভাবে পুণরজ্জীবীত বা পুনর্বহাল হয়ে যায়। সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী মামলা, ভারত ও বাংলাদেশের বিভিন্ন সাংবিধানিক মামলার রায়ে এই দৃষ্টান্ত রয়েছে।
রায়ে আদালত বলেন, মামলার শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষ দাবি করেছিল- বিদ্যমান সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ বাতিল করা হলে চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স বিনষ্ট হবে। কিন্তু হাইকোর্ট মনে করে এই যুক্তি সঠিক নয়। কারণ সংবিধানে বলা আছে, বিচার বিভাগ প্রভাবমুক্ত থাকবে। তাছাড়া রাষ্ট্রের তিন স্তম্ভের (আইন বিভাগ, শাসন বা নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগ) মধ্যে ক্ষমতার যে পৃথকীকরণ নীতি, বিদ্যমান ১১৬ অনুচ্ছেদ সেই নীতিকে খর্ব করেছে। কারণ, রাষ্ট্রের তিন স্তম্ভের একটি আরেকটির ওপর প্রভাব বা নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে পারে না। সে কারণে আমরা মনে করি, বিদ্যমান সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ অসাংবিধানিক। এজন্য তা বাতিল ঘোষণা করা হলো। একই সঙ্গে আদি (বাহাত্তরের) সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ পুনর্বহাল হলে সেটি হবে ক্ষমতা পৃথকীকরণ নীতির যথার্থ বাস্তবায়ন।
আদালত বলেন, ২০১৭ সালে তৎকালীন সরকার অধস্তন আদালতের বিচারকদের শৃঙ্খলা বিধিমালা প্রণয়ন করে। রিটকারীদের দাবি, সরকার রাজনৈতিক স্বার্থে সুপ্রিম কোর্টের শ্রষ্ঠত্ব ও কৃর্তৃত্বকে ক্ষুন্ন করে এই বিধিমালা প্রণয়ন করেছিল। অথচ এই বিধিমালা প্রণয়নের ক্ষমতা সুপ্রিম কোর্টের। মাসদার হোসেন মামলার রায়ের আলোকে অধস্তন আদালতের বিচারকদের শৃঙ্খলাবিধি প্রণয়ন না করায় ২০১৭ সালে প্রণীত শৃঙ্খলাবিধি অসাংবিধানিক ও বাতিল ঘোষণা করা হলো।
সুপ্রিম কোর্টের স্বতন্ত্র সচিবালয় নিয়ে রায়ে আদালত বলেন, জাতীয় সংসদ ও নির্বাচন কমিশনের স্বতন্ত্র সচিবালয় রয়েছে। কিন্তু বিচার বিভাগের স্বতন্ত্র সচিবালয়ের কথা সংবিধান এবং মাসদার হোসেন মামলায় রায়ে উল্লেখ থাকলেও আজ পর্যন্ত হয়নি। আমরা মনে করি স্বতন্ত্র সচিবালয় না করা সংবিধান ও মাসদার হোসেন মামলার রায়ের পরিপন্থি। তাছাড়া সুপ্রিম কোর্টের জন্য স্বতন্ত্র সচিবালয় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা কোনো আপত্তি করেননি। বিচার বিভাগ ও সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনেও সুপ্রিম কোর্টের জন্য স্বতন্ত্র সচিবালয় প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে। আর এই দুটি কমিশনের সুপারিশে সমর্থন জানিয়েছে ৩১টি রাজনৈতিক দল। সুতরাং হাইকোর্ট মনে করছে, বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগের প্রভাবমুক্ত রাখতে পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠা এখনি উপযুক্ত সময়। ফলে বিবাদীদের নির্দেশ দেওয়া হলো- সুপ্রিম কোর্টের প্রস্তাবনা অনুসারে রায়ের অনুলিপি পাওয়ার তিন মাসের মধ্যে সুপ্রিম কোর্টের জন্য স্বতন্ত্র সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করতে।
চতুর্থ ও পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের পরিবর্তিত ১১৬ অনুচ্ছেদ এবং এই অনুচ্ছেদের অধীনে ২০১৭ সালে প্রণীত জুডিশিয়াল সার্ভিস (শৃঙ্খলা) বিধিমালার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে গত বছর ২৫ আগস্ট সুপ্রিম কোর্টের সাত আইনজীবী রিট করেন। রিটে সুপ্রিম কোর্টের জন্য স্বতন্ত্র সচিবালয় প্রতিষ্ঠার নির্দেশনা চাওয়া হয়। প্রাথমিক শুনানির পর গত বছরের ২৭ অক্টোবর হাইকোর্ট রুল দেন। সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ এবং এ সংক্রান্ত ২০১৭ সালের জুডিশিয়াল সার্ভিস (শৃঙ্খলা) বিধিমালা কেন সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয় রুলে। একই সঙ্গে কেন সুপ্রিম কোর্টের জন্য স্বতন্ত্র সচিবালয় প্রতিষ্ঠার নির্দেশ দেওয়া হবে না, তাও জানতে চাওয়া হয় রুলে। আইন মন্ত্রণালয়ের দুই সচিব ও সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলকে চার সপ্তাহের মধ্যে রুলের জবাব দিতে বলা হয়। এই রুলে চূড়ান্ত শুনানির পর রায় দিলেন উচ্চ আদালত।
আদালতে রিট আবেদনকারীদের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির। তার সঙ্গে ছিলেন আইনজীবী মোহাম্মদ সাদ্দাম হোসেন। ইন্টারভেনর (পক্ষ) হিসেবে রুল শুনানিতে অংশ নেন
জ্যেষ্ঠ আইনজীবী আহসানুল করিম। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান, অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল অনীক আর হক ও ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোহাম্মদ মেহেদি হাসান। রুল শুনানিতে অ্যামিকাস কিউরি (আদালত বন্ধু) হিসেবে মতামত দেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শরীফ ভূইয়া।
রায়ের পর আইনজীবী আহসানুল করিম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘চতুর্থ ও পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে ১১৬ অনুচ্ছেদে দুইবার পরিবর্তন এসেছে। পঞ্চম সংশোধনী যেহেতু অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে, ফলে ১১৬ অনুচ্ছেদ স্বয়ংক্রিয়ভাবে চতুর্থ সংশোধনীতে ফিরে গেছে। বাহাত্তরের মূল সংবিধানে ফেরার সুযোগ নেই।’
রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হবে কি না, এ বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছেন বলে জানান এই আইজীবী। আর এ বিষয়ে জানার চেষ্টা করেও রাষ্ট্রপক্ষের কারো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
রায়ের পর আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির সাংবাদিকদের বলেন, ‘এই রায়ের মাধ্যমে বাংলাদেশের ইতিহাসে এক গৌরবজ্জ্বল অধ্যায়ের সূচনা হলো। একই সঙ্গে এই রায়ের মাধ্যমে নির্বাহী বিভাগের কর্তৃত্ব এবং রাজনৈতিক প্রভাব থেকে আমাদের অধস্তন বিচার বিভাগ মুক্তি পেল। আত্মমর্যাদা, সম্মান ফিরে পেলেন অধস্তন আদালতের বিচারিক কর্মকর্তারা।
এই আইনজীবী বলেন, ‘এই রায়ের মাধ্যমে বিচার বিভাগ মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারলে, ভারতীয় উপমহাদেশের বিচারিক ব্যবস্থায় গুরুত্বের দৃষ্টিতে দেখা হবে। দেশের বিচার ব্যবস্থায় যে অনিশ্চয়তা আছে, যে প্রভাব আছে, এই রায়ের মাধ্যমে তা মুক্ত হলো। এই রায় বাস্তবায়ন হলে বিচার বিভাগের ওপর দুষ্টচক্রের যে প্রভাব আছে, তার অবসান ঘটবে। এ রায়ের ফলে কথিত ‘উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ’র হাতে আর কোনো নাটাই থাকল না। বিচার বিভাগের ওপর নির্বাহী বিভাগ আর ছড়ি ঘুরাতে পারবে না।’
সাংবিধানিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বিবেচনায় হাইকোর্ট এই রায়ের বিরুদ্ধে সরাসরি আপিল করার সার্টিফিকেট দিয়েছেন বলে জানান এই আইনজীবী।