আমেরিকার ঋণের চাপ কমাবে বিটকয়েন

- আপডেট সময়ঃ ০৯:৪১:৩২ অপরাহ্ন, রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪
- / ২২১ বার পড়া হয়েছে
নিজস্ব প্রতিবেদক :
ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই হু হু করে বাড়ছে ক্রিপ্টোকারেন্সি বিটকয়েনের দাম। এক লাখ ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করে এই মুদ্রার দাম এরই মধ্যে রেকর্ড এক লাখ ডলার অতিক্রম করেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, ট্রাম্পের অর্থনৈতিক পরিকল্পনায় রয়েছে বিটকয়েন। ধারণা করা হচ্ছে, এই ক্রিপ্টোমুদ্রা কাজে লাগিয়ে মূল্যস্ফীতি রোধ ও ঋণের চাপ কমিয়ে আনতে চান তিনি।
তাঁর বিটকয়েনবান্ধব ঘোষণায়ই এই বাজারে বিনিয়োগ বাড়ছে, আর সেই জোয়ারে বাড়ছে বিটকয়েনের দামও।
এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণাটিতে ট্রাম্প বলেছেন, তিনি বিটকয়েনের কৌশলগত রিজার্ভ গড়ে তুলবেন, যেভাবে যুক্তরাষ্ট্রে জ্বালানি তেলের রিজার্ভ গড়ে তোলা হয়েছে। ফলে প্রশ্ন উঠেছে, ট্রাম্প কেন বিটকয়েনের রিজার্ভ গড়ে তুলতে চান, এতে যুক্তরাষ্ট্র কিভাবে লাভবান হবে?
কৌশলগত রিজার্ভ কী : কৌশলগত রিজার্ভ হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ মজুদ করে রাখা, যা সংকটের সময় বা সরবরাহে বিঘ্ন ঘটলে বাজারে ছাড়া হয়। যেমন—আমেরিকার কৌশলগত পেট্রোলিয়ামের মজুদ।
জরুরি প্রয়োজনে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল সরবরাহে বিশ্বের সবচেয়ে বড় রিজার্ভ এটি। ১৯৭৩-৭৪ সময়ে আরব দেশগুলোর তেল নিষেধাজ্ঞায় ধাক্কা খায় মার্কিন অর্থনীতি। এর পরই ১৯৭৫ সালে কংগ্রেস একটি আইনের মাধ্যমে এই জরুরিকালীন রিজার্ভ গড়ে তোলে। বিভিন্ন যুদ্ধে বা প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাজারে তেল সরবরাহে বিঘ্ন ঘটলে দাম নিয়ন্ত্রণে যুক্তরাষ্ট্রের এই মজুদ বাজারে ছাড়ে।
এতে বাজার স্থিতিশীল হয়। এ ছাড়া কানাডার রয়েছে বিশ্বের একমাত্র ম্যাপল সিরাপের কৌশলগত রিজার্ভ। চীনের রয়েছে ধাতু, শস্য ও শূকরের পণ্যের কৌশলগত রিজার্ভ।
বিটকয়েনের রিজার্ভ কিভাবে কাজ করবে: বিশ্লেষকরা বলছেন, বিটকয়েনের এ কৌশলগত রিজার্ভ হতে পারে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ বিভাগের মুদ্রাবাজার স্থিতিশীলকরণ তহবিলের মতো। যার মাধ্যমে বিদেশি মুদ্রা ক্রয়-বিক্রয় করা হয়।
একইভাবে বিটকয়েনেরও মজুদ গড়ে তুলে তা ক্রয়-বিক্রয় করা হবে।
মার্কিন সরকার এরই মধ্যে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে থাকা ব্যক্তিদের কাছ থেকে যেসব বিটকয়েন জব্দ করেছে তার পরিমাণ প্রায় দুই লাখ টোকেন। বিটকয়েনট্রেজারিস ডটকমের মতে, যার বর্তমান মূল্য আসে ২১ বিলিয়ন ডলার। খোলাবাজার থেকে আরো বিটকয়েন কিনে ট্রাম্প এই মজুদ বাড়াবেন কি না, তা বলেননি। এটা করতে হলে সরকারকে ঋণ ইস্যু করতে হবে। যদিও প্রস্তাবের পক্ষের কিছু লোক বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র তাদের সোনার রিজার্ভ কিছুটা বিক্রি করে তা দিয়ে বিটকয়েন কিনতে পারে। ক্রিপ্টোবান্ধব রিপাবলিকান সিনেটর সিনথিয়া লিউমিস পাঁচটি বিটকয়েনের মালিক। তিনি জানান, তিনি একটি বিল এনেছেন, যা অনুমোদন পেলে ট্রেজারি বা অর্থ বিভাগের অধীন বিটকয়েনের একটি রিজার্ভ পরিচালনা করা হবে।
ওই বিল অনুযায়ী ট্রেজারি বিভাগ একটি প্রগ্রাম তৈরি করবে, যার অধীন পাঁচ বছরের জন্য বার্ষিক দুই লাখ বিটকয়েন ক্রয় করা হবে। এই ক্রয় অব্যাহত থাকবে যত দিন ১০ লাখ টোকেন মজুদ হয়। বর্তমান বিশ্বে দুই কোটি ১০ লাখ বিটকয়েন টোকেন রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র পাঁচ বছর এভাবে ক্রয় করলে দেশটির হাতে বিশ্বের বিটকয়েন বাজারের ৫ শতাংশ যাবে।
বিটকয়েন রিজার্ভে কী লাভ হবে : জুলাইয়ের বক্তব্যে ট্রাম্প বলেছিলেন, বিটকয়েন বাজারে চীনের পক্ষ থেকে তুমুল প্রতিযোগিতা বাড়ছে। যুক্তরাষ্ট্র একটি রিজার্ভ গড়ে তুললে চীনের বিপরীতে এই বাজারে আধিপত্য বিস্তার করা যাবে। অনেক বিশ্লেষক বলছেন, বিটকয়েনের রিজার্ভ গড়ে তুলে যুক্তরাষ্ট্র তাদের ঘাটতি কমিয়ে আনতে চায় কর না বাড়িয়েই। এতে ডলার শক্তিশালী হবে। গত নভেম্বরে সিনথিয়া লিউমিস ফক্স নিউজকে বলেছেন, ‘তাঁর পরিকল্পনা অনুযায়ী যদি বিটকয়েনের কৌশলগত রিজার্ভ গড়ে তোলা হয়, তবে আগামী ২০ বছরে যুক্তরাষ্ট্র তাদের ঋণ অর্ধেক কমিয়ে আনতে পারবে।’ তিনি বলেন, ‘এই মজুদ আমাদের মূল্যস্ফীতির বিপরীতে রক্ষা করবে এবং বিশ্ববাজারে ডলারকেও সুরক্ষা দেবে।’ তাঁর মতে, ডলার শক্তিশালী হলে তা চীন ও রাশিয়ার মতো প্রতিদ্বন্দ্বীদের বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান শক্ত করবে।
বিটকয়েনে ঝুঁকি কী : ক্রিপ্টোমুদ্রা নিয়ে যাঁরা সন্দেহ পোষণ করেন তাঁরা বলছেন, অন্যান্য পণ্যের মতো বিটকয়েনের নিজস্ব কোনো গুণ বা মূল্য নেই। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি সচল রাখার ক্ষেত্রেও এটি গুরুত্বপূর্ণ নয়। ২০০৮ সালে বিটকয়েন তৈরি করা হয়। বিশ্বের অন্যতম বিলিয়নেয়ার ওয়ারেন বাফেট বিটকয়েনে বিনিয়োগকে অর্থহীন মনে করলেও এতে বিনিয়োগ করেছেন শীর্ষ ধনী ইলন মাস্কসহ অনেকেই। ইলন মাস্ক এখন ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ হওয়ায় এ বাজারে ট্রাম্প ইতিবাচক ভূমিকা রাখবেন বলে আশা করা হচ্ছে। অন্যদিকে সমালোচকরা বলছেন, দীর্ঘ মেয়াদে বিটকয়েনের মূল্য বাড়বে না, তা ছাড়া এটি সাইবার হামলারও ঝুঁকিতে রয়েছে। যদিও যেকোনো সরকারের ক্রয়-বিক্রয়ে এ বাজারে প্রভাব পড়বে।
বাজার তিন ট্রিলিয়ন ছাড়াল : বিটকয়েনের মূল্যবৃদ্ধি পাওয়ায় সামগ্রিকভাবে ক্রিপ্টোকারেন্সির বাজার মূলধন বেড়েছে। কয়েন মার্কেট ক্যাপের তথ্যানুসারে, ক্রিপ্টোকারেন্সির বাজার মূলধন এখন ৩.৩ ট্রিলিয়ন বা তিন লাখ ৩০ হাজার কোটি ডলার। এ বছর বিটকয়েনের দাম বেড়েছে ১৩১ শতাংশ। অন্যান্য ক্রিপ্টোমুদ্রার দামও বেড়েছে। ২০২১ সালেও ডোনাল্ড ট্রাম্প বিটকয়েনকে এক ধরনের জালিয়াতি মনে করতেন। এরপর ট্রাম্পের মত পাল্টেছে। এবারের নির্বাচনের অঙ্গীকারে ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রকে বিশ্বের ক্রিপ্টোকারেন্সির রাজধানী হিসেবে গড়ে তোলার কথা বলেছেন।
ক্রিপ্টোমুদ্রায় বিনিয়োগ বাড়ছে : যুক্তরাজ্যের এক জরিপে দেখা গেছে, এখন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ, যেমন—শিক্ষক, ব্যাংকার, নার্স ও আইটি পেশাদাররা ক্রিপ্টোকারেন্সিতে বিনিয়োগ করছেন। ফলে একসময় কারেন্সি যে শুধু প্রযুক্তি জগতের মানুষের বিনিয়োগ ক্ষেত্র হিসেবে মনে করা হতো, সেই ধরাবাঁধা চিত্রটা পাল্টে গেছে। এই শ্রেণির মানুষেরা মনে করছেন, বিপুল পরিমাণে ব্যক্তিগত সম্পদ অর্জনের ক্ষেত্রে ক্রিপ্টোমুদ্রা বিনিয়োগের সেরা মাধ্যম।
সূত্র : রয়টার্স, ট্রেডিং ইকোনমিকস, আলজাজিরা।