মুক্তি পেলেন ২৬ জনের ফাঁসির দড়ি টানা ‘জল্লাদ’ শাহজাহান

- আপডেট সময়ঃ ০৭:৫৪:৫৪ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৮ জুন ২০২৩
- / ২৩০ বার পড়া হয়েছে
নিজস্ব প্রতিবেদক :
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা মামলায় মৃত্যুদ-প্রাপ্ত ছয় আসামিসহ ২৬ জনের ফাঁসির দড়ি টানা আলোচিত ‘জল্লাদ’ শাহজাহান মুক্তি পেয়েছেন। দীর্ঘ ৩২ বছর কারাভোগের পর আজ রোববার বেলা ১১টা ৪৭ মিনিটে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্তি পান তিনি। জল্লাদ শাহজাহানের পুরো নাম শাহজাহান ভূঁইয়া। তিনি নরসিংদী জেলার পলাশ থানার ইছাখালী গ্রামের মৃত হাছেন আলীর ছেলে। ৭৩ বছর বয়সী শাহজাহান ব্যক্তিগত জীবনে অবিবাহিত। কারাগারে তার কয়েদি নম্বর ছিল ২৫৮৯/এ এবং মুক্তির আগ পর্যন্ত তিনি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের প্রধান জল্লাদ ছিলেন। কারা কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, শাহজাহান ভূইয়া ১৯৯১ সালে গ্রেপ্তার হন। তাকে মানিকগঞ্জ জেলা কারাগারে রাখা হয়। কারাগারে ভালো কাজ ও মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামিদের ফাঁসির রায় কার্যকর করতে জল্লাদের দায়িত্ব পালনের জন্য তার সাজার মেয়াদ ১০ বছর মওকুফ (রেয়াত) করা হয়। পাশাপাশি শাহজাহানের পরিবারের আর্থিক অবস্থা ভালো না হওয়ায় আবেদনের প্রেক্ষিতে কারা কর্তৃপক্ষ তার জরিমানার ১০ হাজার টাকা পরিশোধ করে দিয়েছে। ফলে দীর্ঘ ৩১ বছর ছয়মাস দুইদিন কারাগারের চার দেয়ালের মধ্যে বন্দিজীবন কাটানোর পর এখন তিনি মুক্ত। কারাগারের তথ্যানুযায়ী, শাহজাহান ২০০১ সাল থেকে এ পর্যন্ত ২৬ জনের ফাঁসির দড়ি টেনেছেন। যার মধ্যে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার মৃত্যুদ-প্রাপ্ত আসামি ছিলেন ছয়জন। এ ছাড়া চারজন যুদ্ধাপরাধী, দুজন জেএমবি সদস্য ও অন্যান্য আলোচিত মামলার ১৪ আসামি। এর আগে গত শনিবার রাতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে (কেরানীগঞ্জ) সিনিয়র জেল সুপার সুভাষ কুমার ঘোষ জল্লাদ শাহজাহানের মুক্তির বিষয়টি নিশ্চিত করেন। মুক্তি পেয়ে তিনি বলেন, আমি অপরাধ করেছি, সেজন্য জেলে সাজা ভোগ করেছি। এখন আমি মায়ের গর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হওয়ার মতো। আমি অতীতের সবকিছু ভুলে গেছি। এখন আমি আগামী দিনে কীভাবে চলবো, থাকবো সেটা হচ্ছে বিষয়। এ সময় তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, আমার বাড়ি, ঘর নেই। এত বছর জেল খাটার পর আমার কিছুই নেই। আমি এখন কারাগার থেকে বেরিয়ে নিজের বাড়িতেও যাচ্ছি না। আমি আরেকজনের বাড়িতে গিয়ে উঠছি এখন। আমি এখন কী করে খাবো? কোথায় যাবো? কি করবো? আমার এখন আর কিছু করার বয়স নেই। জল্লাদ শাহজাহান আরও বলেন, প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমার একটিই আবেদন, আমাকে যেনো বাড়ি-ঘর ও একটি কর্মসংস্থান দিয়ে চলার মতো কিছু করে দেন। এটিই প্রধানমন্ত্রীর কাছে আকুল আবেদন। জল্লাদ শাহজাহানের পুরো নাম মো. শাহজাহান ভূঁইয়া। জন্ম ১৯৫০ সালের ২৬ মার্চে। জন্মস্থান নরসিংদীর পলাশ উপজেলার গজারিয়া ইউনিয়নের ইছাখালী গ্রামে। তার তিন বোন ও এক ভাই। বাবার নাম হাছেন আলী, মায়ের নাম মেহের। পড়াশোনা করেছেন এইচএসসি পর্যন্ত। খাস হাওলা ফ্রি প্রাইমারি স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা শেষে মাধ্যমিক পড়াশোনা করেছেন পারলিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে। এরপর ১৯৭৪ সালে নরসিংদী সরকারি কলেজে উচ্চমাধ্যমিক সম্পন্ন করেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি অবিবাহিত। ছোট থেকেই সেনাবাহিনীর কর্মকা- তাকে খুব আকর্ষণ করতো। বিশেষ করে তাদের শৃঙ্খলাবোধ তার সবথেকে বেশি ভালো লাগতো। তাই মনেপ্রাণে সবসময় চাইতেন সুযোগ পেলেই সেনাবাহিনীতে চাকরি করবেন। বাবার কাছে একবার খবর পান সেনাবাহিনীতে লোক নেওয়া হচ্ছে। এরপর সেনাবাহিনীর চাকরির জন্য অংশগ্রহণ করলে তিনি টিকে জান। পরে তিন বছর সেনাবাহিনীতে থাকার পর বাড়ি চলে আসেন। চাকরি করবেন না বলে ১১ মাস কর্মস্থলে অনুপস্থিত ছিলেন। ফলে সেনাবাহিনী থেকে চাকরি হারান। পরে নরসিংদী জেলা কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতির দায়িত্বও গ্রহণ করেন শাহজাহান। মুক্তিযুদ্ধের চারবছর পরের কথা, তখন তিনি তরতাজা তরুণ। এইচএসসি পাস করেছেন দুই বছর আগে। মনের অজান্তে ভালো লেগে যায় কমিউনিস্ট পার্টি, যোগ দেন দলে। তার কার্যক্রমে খুশি হয়ে কেন্দ্র থেকে ডেকে পাঠানো হয়। সেসময় নরসিংদী জেলা কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতির দায়িত্ব দিতে চাইলে তিনি রাজি হন। ১৯৭৬ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে জেলা কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতির দায়িত্ব নেন। মানুষ হিসেবে শাহজাহানের বেশ সুনাম ছিল। পারতপক্ষে কারও উপকার ছাড়া ক্ষতি করার চেষ্টা করতেন না। তবে প্রচ- বন্ধু পাগল ছিলেন। একবার গ্রামে দুই বন্ধুসহ শাহজাহানের নামে অভিযোগ ওঠে। গ্রামে বসা সালিশ কার্যক্রমে তাকে অপরাধী প্রমাণিত করে সাজা দেওয়া হয়। এরপর থেকেই বদলে যান। ওইদিনের অপমান সহ্য করতে না পেরে সিদ্ধান্ত নেন অপরাধ জগতে প্রবেশ করার। যেই সিদ্ধান্ত সেই কাজ। গ্রামের ওই ঘটনার পরে জল্লাদ শাহজাহান তখন বাংলাদেশের একজন বহুল পরিচিত সন্ত্রাসীর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছেন। তাছাড়া কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদানের পর থেকে যেকোনো অপারেশনে (দলীয় গোপন কার্যক্রমে) তার চাহিদা দিনদিন বাড়তে থাকে। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য অপারেশন ছিল ১৯৭৯ সালে মাদারীপুর জেলায়, এটাই ছিল তার জীবনে সর্বশেষ অপারেশন। সেখানে কাজ শেষ করে মানিকগঞ্জ হয়ে ঢাকায় ফেরার চেষ্টা করেন। তবে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে পুলিশ জানতে পারে শাহজাহানের দল মানিকগঞ্জ হয়ে ঢাকায় ফিরছে। মানিকগঞ্জে পুলিশ চেকপোস্ট বসালে শাহজাহান তার বাহিনীর সদস্যদের মাধ্যমে তা জানতে পারেন। সব জেনেই ওই এলাকা দিয়ে ঢাকায় ফেরার সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। মানিকগঞ্জে পুলিশের সঙ্গে গোলাগুলিও হয়। কিন্তু পুলিশ তাকে ধরতে পারেনি। এরপর ঢাকায় পৌঁছে যখন নরসিংদীর উদ্দেশ্যে রওনা হন, সেসময় তাকে আটক করে পুলিশ। এরপর থেকে তার বন্দি জীবন শুরু। জীবনের সোনালি সময় তাকে কারাগারেই কাটাতে হবে- এমন ভাবনা থেকে চিন্তা করলেন জল্লাদ হিসেবে সময় দিলে সাজা কিছুটা হলেও কমবে। তাই নিজেকে অন্যভাবে প্রস্তুত করার জন্য জেল সুপারের কাছে জল্লাদের খাতায় নাম লেখানোর আগ্রহ প্রকাশ করেন। প্রথমে তিনি সহযোগী জল্লাদ হিসেবে গফরগাঁওয়ের নূরুল ইসলামকে ফাঁসি দিয়ে তার জল্লাদ জীবনের সূচনা করেন। এরপর ১৯৯৭ সালে কারা কর্তৃপক্ষ তাকে প্রধান জল্লাদ মনোনীত করে। প্রধান জল্লাদ হওয়ার পর আলোচিত ডেইজি হত্যা মামলার আসামি হাসানকে প্রথম ফাঁসি দেন। একটি ফাঁসি দিতে প্রধান জল্লাদের সঙ্গে ৬ জন সহযোগী থাকেন। এ ছাড়া একটি ফাঁসির রায় কার্যকর করলে প্রত্যেক জল্লাদের ২ মাস ৪ দিন করে কারাদ- মওকুফ করা হয়। শুধু ফাঁসির রায় কার্যকর নয়, কারাগারে যারা জল্লাদ হওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করতেন, কারা কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে শাহজাহান তাদের প্রশিক্ষণ দিতেন। ১৯৯১ সালে আটক হওয়ার আগে ও পরে তার নামে সর্বমোট ৩৬টি মামলা হয়। এর মধ্যে একটি অস্ত্র মামলা, একটি ডাকাতি মামলা এবং অবশিষ্ট ৩৪টি হত্যা মামলা। বিচারকার্যে দেরি হওয়ার কারণে সাজা ছাড়াই তিনি ১৯৯১ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত ৪ বছর হাজতি হিসেবে কারাগারে থাকেন। ১৯৯৫ সালে তার সাজা হয় ১৪৩ বছর। পরে ৮৭ বছর সাজা মওকুফ করে তাকে ৫৬ বছরের জন্য কারাদ- দেওয়া হয়। শাহজাহানের জেল থেকে বের হওয়ার তারিখ তার জেল কার্ডের ওপর লেখা ছিল ‘ডেট অব রিলিজ ২০৩৫’। তবে ফাঁসি কার্যকর, সশ্রম কারাদ- এবং বিভিন্ন মেয়াদে কারাভোগ করে এখন তিনি মুক্ত।