মব ও গুজব রোধে চূড়ান্ত সতর্কবার্তা সেনাবাহিনীর

- আপডেট সময়ঃ ০৪:০৫:০১ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৫
- / ১৭ বার পড়া হয়েছে
সেনাবাহিনী কী করছে, কী করবে—এ নিয়ে গল্প, কামনা, ধারণা, অনুমানের কিছু অবশিষ্ট নেই। তা আরো পরিষ্কার করা হয়েছে বাহিনীটির সর্বশেষ ব্রিফিংয়ে। বাকিটা যার যার বোধ-বুদ্ধিতে বুঝে নেওয়ার বিষয়। এ নিয়ে বাড়তি কথা বা মনগড়া ন্যারেটিভ একদম নিরর্থক।
বার্তা পরিষ্কার। এর পরও কোনো সংশয় বা বোঝার বাকি থাকলে ডাকসুতে সেনা মোতায়েনের হাইপ ও প্রোপাগান্ডা বরবাদের মাধ্যমে তা যে কারো বোধগম্য। সেনাবাহিনী চেয়েছে ডাকসু নির্বাচনের মাধ্যমে সুষ্ঠু পরিবেশে অন্তত ভোটের চর্চা যেন শুরু হয়; যা জাতীয়, স্থানীয় এমনকি পেশাজীবী সংগঠনগুলো থেকেও হারিয়ে গিয়েছিল টানা দেড় দশক ধরে।
সেনাবাহিনীর এখন যাবতীয় প্রস্তুতি আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে।
সরকার থেকে তাদের নির্বাচনে সংযুক্ত থাকার প্রস্তুতি নিতে বলা হয়েছে। অপেক্ষা কেবল নির্বাচন কমিশনের আনুষ্ঠানিক নির্দেশনার। নির্বাচন সামনে রেখে বিভিন্ন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর বিশেষ অভিযান পরিচালনা শুরু হয়েছে অনেকটা আওয়াজ ছাড়াই। ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা থাকার পরও শো আপ, হাঁকডাক বা বল প্রয়োগে না গিয়ে নিজস্ব স্টাইলে সেনাবাহিনী এই অভিযানে অংশীজন হয়েই থাকছে।
চব্বিশের ৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ে খোয়ানো ৮০ শতাংশের বেশি অস্ত্র এরই মধ্যে উদ্ধার করা হয়েছে। বাকি ২০ শতাংশ উদ্ধারের জন্য জাল ফেলা হয়েছে। মবের বিরুদ্ধে বিশেষ অ্যাকশনের ছকও চূড়ান্ত। যেখানেই মব বা পাণ্ডামির তথ্য পাচ্ছে, সেখানে দ্রুত ছুটছেন সেনা সদস্যরা। শিগগিরই এতে আরো মাত্রা যোগের পরিকল্পনামাফিক প্রস্তুতি চূড়ান্ত।
সামনের দিনগুলোতে মবের যম হয়ে ওঠা সময়ের অপেক্ষা মাত্র।
গুজবের বিরুদ্ধেও কিছু অ্যাকশনের পরিকল্পনার তথ্যও রয়েছে। গুজববাজরা দিনে দিনে যেভাবে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে তা বড় রকমের শঙ্কা জাগাচ্ছে। নির্বাচন পর্যন্ত এরা কোন অবস্থা করে ছাড়ে তা বলা যায় না। মনমতো না হলে এরই মধ্যে যাকে-তাকে নাস্তানাবুদ করে মান-ইজ্জত ধুলায় মিশিয়ে দিতে শুরু করেছে। ব্যবহার করা হচ্ছে যাচ্ছেতাই শব্দ-ভাষা। লেখা বা উচ্চারণের অযোগ্য হলেও তারা তা দিব্যি প্রয়োগ করে যাচ্ছে। তাদের অবস্থান দেশে-বিদেশে দুইখানেই। তবে নির্দিষ্ট ঠিক-ঠিকানা, আড়ত বা মোকাম নেই। হালে তাদের স্পেশাল টার্গেট সেনাপ্রধান ও তাঁর বাহিনী। টার্গেট অনুযায়ী প্রতিদিনই সেনাবাহিনী সম্পর্কে অসত্য, অরুচিকর, নিম্নমানের গুজব ছড়াচ্ছে। এ ক্ষেত্রে তাদের ভরসা ফেসবুকসহ কিছু সোশ্যাল মিডিয়া।
এদের দমানো না গেলে অচিরেই গুজব স্টার্টআপের বাজারমূল্য শেয়ারবাজারকেও ছাড়িয়ে যাওয়ার আলামত দেখা যাচ্ছে। মূলধারার কিছু গণমাধ্যমও এসব গুজবকে সংবাদ হিসেবে পরিবেশন করছে। একে সুযোগ হিসেবে ঢাকা-কলকাতাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থানকারী ইউটিউবাররা যথেচ্ছ ছড়াচ্ছে। এতে দেশের ক্ষয়ক্ষতি তাদের বিবেচ্য নয়। হিট বা ভাইরাল হওয়া নিয়েই কথা। নির্বাচন দোরগোড়ায় চলে আসায় এরা আরো বেপরোয়া। প্রধান নির্বাচন কমিশনারও গুজব এবং এআই দিয়ে বানানো নানা কনটেন্ট নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। নির্বাচনের সময় এরা বড় ঝামেলা পাকাতে পারে বলে শঙ্কা তাঁর মতো অনেকেরই। সামনে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সেনাবাহিনী ভূমিকা রাখতে যাচ্ছে, এটি গুজববাজদের টেনশনে ফেলে দিয়েছে। তাই গুজবের বিশেষ টার্গেটে সেনাবাহিনী। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ওপর জন-আস্থায় চিড় ধরাতে পারলে কার লাভ, তা সবারই জানা। গুজবের কারিগররা জানে আরো বেশি। সাম্প্রতিক অপতথ্যের মতলব কে না বোঝে? পোস্টদাতারা অনেকেই আন্ডারগ্রাউন্ড কিংবা ফেক আইডি থেকে গুজব ছড়ায়। তার ওপর আছে আশোভন মন্তব্য, খিস্তিখেউড়, ট্রল। এগুলো সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানের মানুষের পক্ষে হজম অযোগ্য।
এক বছরের বেশি সময় ধরে মাঠে কাজ করছে সেনাবাহিনী। কেবল পরিশ্রম নয়, নানা প্রতিবন্ধকতা, বিশেষ করে উসকানি, টিপ্পনী হজম করতে হচ্ছে তাদের। প্রতিনিয়ত দিতে হচ্ছে ধৈর্যের পরীক্ষা। সরকার ও জনগণের সঙ্গে থেকে কাজ করতে হচ্ছে তাদের। সেনাবাহিনীকে যে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, তা গ্রেপ্তার, আটক ও হস্তান্তর পর্যন্ত। বাকিটা আইন ও বিচারের কাজ। কয়েক জায়গায় বাজারে, মাজারে হামলা, মুক্তিযোদ্ধাদের নাজেহালের পদক্ষেপ প্রশ্নে সেনাবাহিনীর ভূমিকা নিয়ে জবাব স্পষ্ট করা হয়েছে সেদিনের সেনা সদরের ব্রিফিংয়ে। বিষয়টা খুব জরুরি ছিল। জানানো হয়েছে, রাজবাড়ীতে নুরাল পাগলার দরবারের ঘটনাটি জানার সঙ্গে সঙ্গে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। এরপর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এসেছে। ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে পুলিশ ও সেনাবাহিনী তৎপর আছে। ব্রিফিংটিতে কর্নেল শফিকুল ইসলামের বক্তব্য ছিল অত্যন্ত মেদহীন। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমেই এ দেশ সৃষ্টি হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, ‘আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান করি এবং অন্তর থেকে শ্রদ্ধা করি। এই শ্রদ্ধা ও সম্মান আগেও যেমন করতাম, এখনো করি এবং ভবিষ্যতেও করব। কোনো মব বা কোনো কিছু দিয়ে আমাদের মুক্তিযোদ্ধা বা মুক্তিযুদ্ধকে ছোট করার সুযোগ নেই। মুক্তিযোদ্ধা ফজলুর রহমানের বাড়ির সামনে যখন মব সৃষ্টি হয়েছিল, তখন খবর পেয়েই সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দায়িত্বপ্রাপ্ত ইউনিট সেখানে উপস্থিত হয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনেছে।’
অনেকটা লাস্ট ওয়ার্নিংয়ের মতো সেনাবাহিনীর এ ধরনের অবস্থান ব্যাখ্যা করার ফল মিলতে শুরু করেছে। নতুন করে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়নি। জানানো হয়েছে, জান-মালের ক্ষতিসাধন, ‘মব ভায়োলেন্স’ এবং জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করতে পারে এমন যেকোনো কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী কঠোর পদক্ষেপে নামবে। জনমানুষের প্রত্যাশা সেটাই। অধীরভাবে সেই অপেক্ষাই করছে মানুষ। এর পাশাপাশি বিভিন্ন জায়গায় মাদকের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীর কয়েকটি অভিযান মানুষকে বেশ আশাবাদী করে তুলেছে। মাদকবিরোধী অভিযানে গত এক মাসে রাজধানীর খিলগাঁও, কাফরুল, কলাবাগান, নাখালপাড়া এবং যশোর, মুন্সীগঞ্জ, গাজীপুর, হবিগঞ্জ, ময়মনসিংহসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে ৩৭৮ জন মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তার করেছে সেনাবাহিনী। একই সময় মাদক সেবন, পরিবহনসহ সংশ্লিষ্ট মোট পাঁচ হাজার ৯৫৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা, জনগণের জান-মাল এবং রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ ও স্থাপনার নিরাপত্তাসহ সার্বিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখতে রুটিন কাজের পাশাপাশি এ কাজগুলো ছিল সময়ের দাবি। এর বাইরে দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখা, বিদেশি কূটনীতিক ও দূতাবাসগুলোর নিরাপত্তা, পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা করা এবং বল প্রয়োগে মায়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে সেনাবাহিনী সদস্যদের কাজের ভলিউম অনেকেরই অজানা। সেদিন গাজীপুরের শ্রীপুরে এক ব্যবসায়ীকে অস্ত্রসহ আটক করার সময় স্থানীয় লোকজনের রোষানলে পড়া র্যাব দলকে উদ্ধারও করতে হয়েছে। আর এসব কাজ করতে গিয়ে তাদের সমন্বয় রাখতে হচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, অন্যান্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী, স্থানীয় প্রশাসন, বিভিন্ন সংস্থা, গণমাধ্যম ও সাধারণ মানুষের সঙ্গে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময়ে আহতদের অনেকের চিকিৎসার দেখভালও করতে হচ্ছে। এখন পর্যন্ত মোট তিন হাজার ৮৫৯ জনকে দেশের বিভিন্ন সিএমএইচে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এর মধ্যে ৪১ জন এখনো চিকিৎসাধীন। তাদের চিকিৎসা করতে হচ্ছে রুটিন কাজ হিসেবে।
গত এক মাসে দেশের বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে ৬৫টি অবৈধ অস্ত্র এবং ২৯৭টি গোলাবারুদ উদ্ধার করেছে সেনাবাহিনী। একই সময় হারানো ৯ হাজার ৭৯৪টি অস্ত্র এবং দুই লাখ ৮৭ হাজার ৩৫৯টি গোলাবারুদ উদ্ধার করা হয়েছে। এ সময়ে বিভিন্ন অপরাধে জড়িত এক হাজার ২৯৪ জনকে গ্রেপ্তার করেছে সেনাবাহিনী। এর মধ্যে রয়েছে কিশোর গ্যাং, তালিকাভুক্ত অপরাধী, ডাকাত, চাঁদাবাজসহ অন্য অপরাধীরা। ভেজাল প্রসাধনসামগ্রী উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ও কারখানায় বিশেষ অভিযান, অবৈধভাবে নদী থেকে বালু উত্তোলন প্রতিরোধ, পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে আগ্নেয়াস্ত্র, ৬১টি গোলাবারুদ, মাদকসহ অন্যান্য সরঞ্জাম উদ্ধার, গ্রেপ্তার সবই করতে হচ্ছে। এটি সেনাবাহিনীর কাজ নয় বলে ফেলে রাখা বা এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই তাদের। সেখানে নতুন কাজ হিসেবে যোগ হয়েছে মব দমন, প্রতিরোধ, নির্বাচন সুষ্ঠু করার ঐতিহাসিক দায়িত্ব।
লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি
হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন