নিজস্ব প্রতিবেদক :
অতি মুনাফার লোভে মজুদদারদের কৃত্রিম সঙ্কটে পাটের দাম ঊর্ধ্বমুখী। তাতে হুমকির মুখে পড়েছে দেশের পাটশিল্প। মিল মালিকরা যে দামে পাটজাত পণ্য বিক্রি করার জন্য বিক্রয় আদেশ পায়, বর্তমানে কাঁচা পাটের দর তার চেয়ে অনেক বেশি। তাতে উৎপাদন খরচ বেশি পড়ায় মিল মালিকরা বিক্রিত মাল সরবরাহ করতে গিয়ে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে অনেক উদ্যোক্তা পাটপণ্য উৎপাদন বন্ধ করে দিচ্ছে। মূলত এক শ্রেণীর অবৈধ মজুদদার কাঁচা পাটের ব্যবসায়ী বেআইনিভাবে কাঁচা পাট মজুদ করে বাজারে কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করে পাটের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। অথচ পাট অধিদফতরের অবৈধ মজুদদারির বিরুদ্ধে মোবাইল কোর্ট পরিচালনাসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থার কথা থাকলেও তার বাস্তবায়ন নেই। এমন পরিস্থিতিতে বিদেশী ক্রেতারা নির্ধারিত মূল্যে পাটপণ্য না পেয়ে বিকল্প পণ্যের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। তাতে আন্তর্জাতিক পাটপণ্যের বাজার হারাচ্ছে দেশ। পাট অধিদফতর এবং পাটখাত সংশ্লিষ্টদের সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, গত বছর দেশে যে পরিমাণ কাঁচা পাট উৎপাদিত হয়েছে তার মধ্যে রফতানি ও স্থানীয় ব্যবহার মিলিয়ে এই পর্যন্ত সর্বোচ্চ ৩০-৩৫ শতাংশ ব্যবহার হয়েছে। বাকি পাট মজুদদারদের গুদামে অব্যবহৃত অবস্থায় রয়েছে। অথচ সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এক হাজার মণের বেশি কাঁচা পাট এক মাসের বেশি সময় ধরে মজুদ করা যায় না। কিন্তু দেশের বিভিন্ন জেলায় বিপুল পরিমাণে কাঁচা পাট মজুদ রয়েছে। অবৈধ মজুদদাররা অতিরিক্ত মুনাফার লোভে বাজারে কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করে পাটের মূল্য বাড়াচ্ছে। ফলে কাঁচা পাটের দর বেশি হওয়ায় মিল মালিকরা ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন।
সূত্র জানায়, দেশে পাট দিয়ে পাট সুতা, দড়ি, বস্তা, প্যাকিং সরঞ্জাম, ব্যাগ বা থলে, হাতে বাছাই করা আঁশ, পাটজাত কাপড় বহুদিন ধরে তৈরি হয়। তার সঙ্গে এখন পাটের তৈরি বৈচিত্র্যময় পণ্যের রফতানিও বেড়েছে। পাটের তৈরি টব, খেলনা, জুট ডেনিম, জুয়েলারি, ম্যাটস, নারী-পুরুষের জুতা স্যান্ডেল, বাস্কেট, পাটের শাড়ি, পাঞ্জাবি ও পাটের তৈরি গৃহস্থালি নানা সরঞ্জামের চাহিদা বিদেশে তৈরি হয়েছে। প্রধানত আমেরিকা ও ইউরোপীয় দেশগুলোয় ওই জাতীয় পণ্য রফতানি হয়। আফ্রিকান দেশগুলো বস্তা ও পাটজাত দড়ি বেশি রফতানি হয়। পাটের আঁশের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজারে পাটখড়িরও একটি বড় বাজার তৈরি হয়েছে। ওসব পণ্য দিয়ে পার্টিকেল বোর্ড, কম্পোজিট, সেলুলয়েডে ব্যবহার হয়। দেশে সর্বশেষ ২০২০-২১ অর্থবছরে ৯০ লাখ ৯১ হাজার বেল কাঁচা পাট উৎপাদিত হয়েছে। তার আগের বছর পাট ৮৪ লাখ ৫৫ হাজার বেল উৎপাদিত হয়েছিল। দেশের বেসরকারি পাটকলগুলোর জন্য প্রয়োজন বছরে ৬৫ লাখ বেল কাঁচা পাট। গৃহস্থালিতে ব্যবহারে প্রয়োজন পাঁচ লাখ বেল। যদিও বর্তমানে সরকারি পাটকলগুলো বন্ধ থাকায় সার্বিকভাবে কাঁচা পাটের অভ্যন্তরীণ চাহিদা কিছুটা কমেছে। কিন্তু আগের সব রেকর্ড ভেঙ্গে গত বছর কাঁচা পাটের মণপ্রতি দাম ৭ হাজার টাকা হয়েছিল। আর গত জুলাইয়ে শুরু হওয়া চলতি মৌসুমে কাঁচা পাটের দাম আড়াই থেকে ৩ হাজার টাকা মণ ছিল।
সূত্র আরো জানায়, সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী লাইসেন্স না থাকলে কাঁচা পাটের ব্যবসা করা যায় না। একই সঙ্গে এক হাজার মণের বেশি কাঁচা পাট এক মাসের বেশি সময় ধরে মজুদ করার নিয়ম নেই। কিন্তু বিভিন্ন জেলায় বিপুল পরিমাণে কাঁচা পাট মজুদ রয়েছে। মূলত পাট ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত নয় এমন মানুষজনও অতিমুনাফার লোভে কাঁচা পাট কিনে মজুদ করেছে। আরকাঁচা পাটের মূল্যবৃদ্ধিতে এবারও বিপাকে পাটকল মালিকরা। গত বছর কাঁচা পাট নিয়ে অরাজকতার জন্য উদ্যোক্তারা অনেক বিদেশী ক্রেতা হারিয়েছে। চলতি বছরও তার পুনরাবৃত্তি হলে পাটকলগুলো রুগ্ন শিল্পে পরিণত হবে। অথচ এবারে দেশে পাটের ভাল ফলন হয়েছে। দুই হাজার টাকার মতো মণপ্রতি উৎপাদন খরচ পড়েছে। কিন্তু বাজারে পাটের দাম সাড়ে ৩ হাজার টাকা মণ। পাটের দাম এরকম ওঠানামা করলে ভালর চেয়ে বেশি ক্ষতিই বেশি হচ্ছে। যদি পাটের দাম একটি স্থিতাবস্থায় বেঁধে দেয়া সম্ভব হয় তাহলে কৃষক ও ব্যবসায়ী উভয়েই লাভবান হবে।
এদিকে এ বিষয়ে বাংলাদেশ জুট স্পিনার্স এ্যাসোসিয়েশনের (বিজেএসএ) চেয়ারম্যান শেখ নাসির উদ্দিন জানান, গত বছর দেশে পাটের যে উৎপাদন হয়েছে তার ৬০-৭০ শতাংশ কাঁচাপাট এখনো উদ্বৃত্ত রয়েছে। কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করে এক শ্রেণীর মৌসুমি ব্যবসায়ীরা অবৈধভাবে কাঁচা পাটের মজুদ গড়ে পাটের মূল্য বাড়াচ্ছে। আর কাঁচা পাটের দর বেশি হওয়ায় মিল মালিকেরা ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। অবৈধ মজুদদারদের বিরুদ্ধে পাট অধিদফতরের নিয়মিত অভিযান করার নির্দেশনা থাকলেও তার বাস্তবায়ন নেই।
অন্যদিকে একই প্রসঙ্গে বাংলাদেশ জুট এ্যাসোসিয়েশন (বিজেএ) সাবেক চেয়ারম্যান ও শিপার্স কাউন্সিল অব বাংলাদেশের চেয়ারম্যান মোঃ রেজাউল করিম জানানন, এখনো দেশে ৩৫ থেকে ৪০ লাখ বেল কাঁচা পাট মজুদ রয়েছে। সরকারের আইন অনুযায়ী ১ হাজার মনের বেশি কেউ কাঁচা পাট মজুদ করতে পারে না। ওই হিসেবে কৃষকের কাছে এতো পাট থাকার সুযোগ নেই। ওসব পাট মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ীরা অবৈধভাবে মজুদ করে রেখেছে। ওসব ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া না হলে অচিরেই অনেক মিল বন্ধ হয়ে যাবে। একই সঙ্গে রফতানি কার্যক্রমও ব্যাহত হবে।