নিজস্ব প্রতিবেদক :
করোনা মহামারীর কারণে দীর্ঘদিনের জড়তা কাটিয়ে সামগ্রিক অর্থনৈতিক কর্মকা- গতি পাচ্ছে অভ্যন্তরীণ চাহিদা বাড়ায়। বিদেশি ক্রেতাদের চাহিদা বাড়াচ্ছে রপ্তানি আয়। এতে উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি হচ্ছে আমদানিতে। ব্যবসা বাণিজ্য বাড়ায় সরকারের রাজস্ব আহরণও বাড়তে শুরু করেছে। সূত্র জানায়, চলতি বছরের ১১ আগস্ট সব’কিছু চালু হওয়ার পর থেকে ধীরে ধীরে অভ্যন্তরীণ অর্থনৈ’তিক কর্মকা- চাঙ্গা হতে শুরু করে। দোকানপাট, শপিংমল, অফিস-আদালত, ছোট-বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক-বীমা, শিল্প-কারখানা ও সড়ক, নৌ, রেল, আকাশ পথের পরিবহ’নসহ সবকিছু স্বাভাবিক’ভাবে চল’ছে। শুধু তাই নয়, মানুষের মনের এই স্বস্তি সামষ্টিক অর্থনীতিতেও এক ধরনের ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অর্থনীতি গতিশীল রাখতে সরকারের প্রণোদনা ঘোষণা ছিল সময়োপযোগী পদক্ষেপ। এটা নিশ্চিত বলা যায় যে, কোভিডে’র অচলাবস্থা ভেঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনীতি স্বস্তিকর গতি নিয়ে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। আমরা কোভিড পরবর্তী পুনরুদ্ধার পর্যায়ে আছি। উৎপাদন পুরোপুরি আগের অবস্থা’য় ফিরে না গেলেও কাছাকাছি পর্যায়ে গেছে। এটা একটা ইতিবাচ’ক পর্যায়ে যাচ্ছে। আগামী বছরের প্রথম ৩/৪ মাসের মধ্যে হয়ত আমরা কোভিডে’র বিরূপ প্রভাব থেকে পুরোপুরি বেরিয়ে আসতে পারব। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের অক্টোবর পর্যন্ত প্রথম চার মাস শেষে রপ্তানি আয়ে ২২ দশমিক ৬২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এ সময়ে মোট রপ্তানি হয়েছে এক হাজার ৫৭৪ কোটি ৯০ লাখ ডলার সমমূল্যের পণ্য, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ বেশি।আমদানি-রপ্তানিসহ সার্বিক অর্থনৈতিক কর্মকা-ে গতি আসার এমন পরিস্থিতিতে ব্যবসা-বাণিজ্যের বিদ্যমান ঝুঁকিগুলো কমিয়ে এনে টেকসই প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে সরকারকে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদ ও শিল্পোদ্যোক্তারা। মহামারির কারণে প্রবাসী শ্রমিকেরা কাজ হারাবেন, বড় অংশের দেশে ফিরতে হবে, অনেকের আয় কমবেÑএসব কারণে দেশে অর্থ পাঠানো কমবে বলেই মনে করা হয়েছিল। গত এপ্রিলেই বিশ্বব্যাংক এক প্রতিবেদনে বলেছিল মহামারির কারণে বিশ্বব্যাপী প্রবাসী আয় কমবে ২০ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি প্রবাসী আয় পাওয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান অষ্টম। অথচ চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে প্রবাসী আয়ে প্রবৃদ্ধি ৪৬ শতাংশ। রেকর্ড পরিমাণ প্রবাসী আয়, রপ্তানির অল্প প্রবৃদ্ধি, কম আমদানি ব্যয় এবং বাড়তি বৈদেশিক সাহায্য পাওয়ায় দেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুতও বেড়ে চলছে। সূত্র জানায়, করোনার কারণে ২০২১ অর্থবছরে’র বড় একটা সময় ব্যাংকিং কার্যক্রম সীমি’ত ছিল। তারপরও আগের বছরের তুলনায় এ খাত থেকে সরকারে’র আয় বেড়েছে ৩০ শতাংশের বেশি। ব্যাংক হিসাব খোলা, ঋণ প্রদান, ক্রেডিট কার্ড, ডেবিট কার্ড, ঋণের হিসাব, আমদানি-রফতানিসহ ব্যাংকের সব ধরনে’র সার্ভিস চার্জ থেকে সরকার ১৫ শতাংশ ভ্যাট পায়। এ ছাড়া ব্যাংকের কেনাকাটায়’ও দিতে হয় উৎসে ভ্যাট। এনবিআরের তথ্য বলছে, ২০২১ অর্থবছরে ব্যাংকে’র এসব চার্জের ওপর ২ হাজার ২৫১ কোটি টাকা ভ্যাট পেয়েছে সরকার। আগের বছর এ খাতে আদায়’কৃত ভ্যাট ছিল ১ হাজার ৫৬২ কোটি টাকা। করোনা’কালে ভাল ব্যবসা করেছে ওষুধশিল্প। গত বছর করোনার লকডাউনের মধ্যেও সচল ছিল আবাসনসহ নির্মাণ খাত। এ খাতের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত কনস্ট্রাকশ’ন ফার্মগুলো থেকে সরকারে’র রাজস্ব আহরণ বেড়েছে প্রায় ১৪ শতাংশ। এ খাতের অনুষঙ্গ রড, সিমেন্ট ও সিরামিকস থেকেও রাজস্ব ১০ শতাংশের বেশি হারে বেড়েছে। এনবিআরে’র তথ্যানুসারে, গত বছর স্টিল ও রডশিল্প থেকে রাজস্ব আহরণ বেড়েছে ২৭ শতাংশ, সিমেন্ট খাত থেকে ১১ শতাংশ ও সিরামিকস থেকে ৩৬ দশমিক ১৬ শতাংশ। করোনায় দেশে বিনিয়োগে’র যে খরা তৈরি হয়ে’ছিল, তা কাটতে শুরু করেছে। ব্যাংক ব্যবস্থায় ঋণের জন্য আবে’দন বাড়ছে। বেড়েছে বিতরণও। ফলে ব্যাংকে যে অতি’রিক্ত তারল্য জমে ছিল, তা ছোট হতে শুরু করেছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ঋণ বিতরণ হয়েছে ৫৪ হাজা’র ৩৮৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে প্রথম প্রান্তি’কে মার্চ পর্যন্ত বিতর’ণ ছিল ১৮ হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি। এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত বিতরণ হয়েছে এর প্রায় দ্বিগুণ। ঋণ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কমছে উদ্বৃত্ত আমানত। কেবল জুলাই’য়ে উদ্বৃত্ত আমানত কমেছে ২৮ হাজার কোটি টাকা। এ বিষয়ে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষে’র (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলামের ভাষ্য, বাংলা’দেশে কোভিড-১৯ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসায় অর্থনৈতি’ক কর্মকা- বেশ গতিশীল হয়েছে। তবে বিদেশী বিনিয়োগে’র পরিমাণ প্রত্যাশিত মাত্রায় না আসায় কিছুটা সতর্ক পর্যবেক্ষ’ণ তার। তিনি বলেন, বহি’র্বিশ্বের উন্নত দেশ’গুলোতে বিশেষ করে ইউরোপে এখনও স্বাভাবিক চলাফেরা’য় অনেক সতর্কতা রয়েছে। সেই কারণে প্রত্যাশিত পরিমাণ নতুন বিদেশী বিনিয়োগ আসেনি। তবে যেসব বিদেশী কোম্পানি’র আগে থেকেই এ দেশে বিনিয়োগ রয়েছে তারা প্রয়োজন মতো নতুন বিনিয়োগ করছে। আবার অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতেও বিদেশী বিনিয়োগ আসছে। যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের সঙ্গে কোভিডের মধ্যেও ‘ভার্চুয়াল কনফা’রেন্স’ করে বিনিয়োগ আকর্ষণের চেষ্টা অব্যাহত ছিল জানিয়ে তিনি বলেন, অনেকেই বিনিয়োগ করতে আগ্রহী, কিন্তু ভ্রমণে বিধনিষেধ থাকায় অনেক কিছুই থেমে আছে। সে কারণে নতুন বিনি’য়োগের ক্ষেত্রে কোভিডের প্রভাবমুক্ত হতে আরও কিছুদিন সময় প্রয়োজন হবে।
অর্থনৈতিক কর্মকা- চাঙা হওয়ায় কর্মসংস্থানের বন্ধ দুয়ারও খুলছে বলে জানিয়েছেন উদ্যোক্তারা। অধিকাংশ কারখানাতেই নতুন নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি ঝুলছে। পাশাপাশি দীর্ঘদিন ধরে থেমে থাকা সরকারি নিয়োগ প্রক্রিয়াও চালু হয়েছে। এ বিষয়ে রপ্তানিকারকদের সবচেয়ে বড় সংগঠন বিজিএমইএর জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের ভাষ্য, পোশাক খাতে ক্রয়াদেশ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এ খাতে নতুন দক্ষ কর্মীরও প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। অধিকাংশ বড় কারখানায় ১০ থেকে ১৫ শতাংশ শ্রমিকের চাহিদা তৈরি হয়েছে বলে আমাদের কাছে খবর আসছে। সূত্র জানায়, সম্প্রতি মিয়ানমার, চীন ও ভিয়েতনাম থেকে পোশাকের কিছু ক্রয়াদেশ বাংলাদেশে স্থানান্তরিত হয়ে আসছে বলে খাত সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। দীর্ঘদিন পর ইউরোপ-আমেরিকায় অফিস চালু হওয়ায় নিট পোশাকের পাশাপাশি উভেন পণ্যের চাহিদাও বাড়তে শুরু করেছে।
তবে চীনের কাঁচামালনির্ভর উভেন পণ্যে ক্রয়াদেশের বিপরীতে কাঁচামাল ঘাটতি দেখা দিতে পারে বলে আশাঙ্কা প্রকাশ করছেন অনেকে। চীনে কারখানাগুলো বন্ধ রেখে রেশনিংয়ের মাধ্যমে সপ্তাহে ২/৩ দিন করে উৎপাদন করছে। ফলে উভেন ফেব্রিক্সের সরবরাহ ঘাটতি দেখা দিতে পারে।