• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ০৪:৫২ পূর্বাহ্ন

অর্থ পাচার থামছে না, পাচারকারীরা তালাশ করছে নতুন ঠিকানা

Reporter Name / ২৮৩ Time View
Update : রবিবার, ২৬ ডিসেম্বর, ২০২১

নিজস্ব প্রতিবেদক :
দেশ থেকে অর্থ পাচার বন্ধ হচ্ছে না। প্রতিবছর মোটা অঙ্কের অর্থ পাচার হলেও অদ্যাবধি নেই তেমন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ। এই পাচারের বেশির ভাগ অর্থ যায় সুনির্দিষ্ট ১০ দেশে। এ ক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে কর কম এবং আইনের শাসন আছে-এমন দেশকেই বেছে নিয়েছে অপরাধীরা। এগুলো হচ্ছে: সিঙ্গাপুর, কানাডা, মালয়েশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সুইজারল্যান্ড, সংযুক্ত আরব আমিরাত, অস্ট্রেলিয়া, হংকং ও থাইল্যান্ড। তবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলে গত ১০ ডিসেম্বর দেশের এক প্রতিষ্ঠান ও সাত ব্যক্তির ওপর যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি বিভাগের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করায় হঠাৎ করেই বদলে গেছে আগের হিসাব। অনেকে আশঙ্কা করছেন, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য এমনকি ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত (ইইউ) দেশগুলোয়ও বাংলাদেশী কারো অবৈধ সম্পদ থাকলে তা বাজেয়াপ্ত হতে পারে। এ অবস্থায় অর্থ সরানোর নতুন নিরাপদ গন্তব্য খুঁজতে শুরু করেছেন সম্পদ ব্যবস্থাপকরা।
সূত্র জানায়, এরইমধ্যে সংশ্লিষ্ট মহলগুলোয় যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার সম্ভাব্য প্রভাব নিয়ে চুলচেলা বিশ্লেষণ শুরু হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে এরইমধ্যে যারা যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশে অর্থ সরিয়েছেন তারা বেশ বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েছেন। সামনে যাদের সরানোর পরিকল্পনা রয়েছে, বিড়ম্বনায় পড়েছেন তারাও। তাদের আশঙ্কার সবচেয়ে বড় কারণ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশগুলোর ঐতিহাসিক ঘনিষ্ঠতা। আইনিসহ দ্বিপক্ষীয় বেশকিছু ইস্যুতে সমঝোতা চুক্তিও রয়েছে দেশগুলোর মধ্যে। যেমন কানাডায়ও মার্কিন যেকোনো আইনি ও প্রশাসনিক পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করার আইনি বাধ্যবাধকতা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের জারি করা যেকোনো গ্রেফতারি পরোয়ানা বা নিষেধাজ্ঞা সেখানেও কার্যকর হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অন্য দেশগুলোয়ও এসব কার্যকর হওয়ার অসংখ্য নজির রয়েছে। টাকা পাচার নিয়ে আন্তর্জাতিক ৪টি সংস্থার রিপোর্টেও বাংলাদেশ থেকে ভয়াবহ আকারে টাকা পাচারের তথ্য উঠে এসেছে। সংস্থাগুলো হচ্ছে- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই), সুইস ব্যাংক, ইউএনডিপি এবং যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের সংগঠন আইসিআইজের পানামা ও প্যারাডাইস পেপার। জিএফআইর রিপোর্ট অনুসারে গত বছর দেশ থেকে প্রায় ৫ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে।
সুইস ব্যাংকের সর্বশেষ রিপোর্টে বলা হয়েছে, দেশটিতে বাংলাদেশিদের আমানত সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা। পানামা ও প্যারাডাইস পেপার্সে ৮৪ জন বাংলাদেশির টাকা পাচারের তথ্য উঠে এসেছে। সংস্থাগুলোর মতে, বাংলাদেশ থেকে যেসব টাকা পাচার হয়, তা যায় উন্নত ৩৬ দেশে। এর মধ্যে উল্লিখিত ১০ দেশ চিহ্নিত করেছে বিএফআইইউ ও দুদক। মূলত এসব দেশেই বড় অংশ পাচার হয়।
দেশের বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তি বিদেশে টাকা পাচার করেছেন বলে ইতোমধ্যেই সরকারের বিভিন্ন সংস্থা নিশ্চিত হয়েছে। কিন্তু বিভিন্ন কারণে তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে ‘ধীরে চল নীতি’ অনুসরণ করছেন সরকারের সংশ্লিষ্টরা।
নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, মার্কিন নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা আসার পর পরই দেশের পুঁজিবাজার ও ব্যাংক খাতের লুটেরা হিসেবে সন্দেহভাজন কয়েক ব্যক্তি ইউরোপ-আমেরিকায় থাকা তাদের ধন-সম্পদ তৃতীয় কোনো দেশে সরিয়ে নিতে তৎপর হয়ে উঠেছেন। বাংলাদেশ থেকে সরানো অর্থের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কার মধ্যে রয়েছেন তারা। ভবিষ্যতে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার আওতা আরো বিস্তৃত হলে তাদের সম্পদের ওপরও আঘাত আসতে পারে বলে তারা ভয় পাচ্ছেন।
তাদের এ ভয় একেবারে অমূলক নয় বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের ভাষ্যমতে, স্বাভাবিকভাবেই এখন থেকে এসব দেশে বাংলাদেশীদের পাঠানো অর্থ নিয়ে বাড়তি নজরদারি থাকবে। পাশাপাশি দেশের যে প্রতিষ্ঠান ও এর সাবেক-বর্তমান কর্মকর্তাদের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আরোপ হয়েছে, তাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের সম্পদের ওপরও যুক্তরাষ্ট্র ও দেশটির মিত্ররা নজরদারি চালাবে।
তবে এ নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করার বিষয়ে এখন পর্যন্ত তৃতীয় কোনো দেশের পক্ষ থেকে কোনো ঘোষণা আসেনি। যদিও অতীতের বিভিন্ন ঘটনা পর্যালোচনায় এসব দেশেও এ ঘোষণা কার্যকরের সম্ভাবনাই বেশি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। বিশেষ করে কানাডার ক্ষেত্রে এ নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করার কোনো ঘোষণা দেয়ার প্রয়োজনও নেই। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আইনি সমঝোতার আওতায় সেখানে এটি স্বয়ংক্রিয়ভাবেই কার্যকর হয়ে যাবে। অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের দেশগুলো এ ধরনের নিষেধাজ্ঞার বেলায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যুক্তরাষ্ট্রকে অনুসরণ করে আসছে। সামনের দিনগুলোয় বাংলাদেশ থেকে এসব দেশে রক্ষিত অর্থ সরানোর বিষয়টি আইনিভাবে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে বলে ধারণা করছেন অনেকে।
মার্কিন নিষেধাজ্ঞা মিত্র অন্যান্য দেশে কার্যকর হওয়ার উৎকৃষ্ট উদাহরণ চীনা প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান হুয়াওয়ের জ্যেষ্ঠ নির্বাহী মেং ওয়ানঝু। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল তিনি ইরানের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞার ফাঁকফোকর এড়াতে হুয়াওয়ের ব্যবসা সম্পর্কে মার্কিন ব্যাংকগুলোকে মিথ্যা বলেছিলেন। এ অভিযোগে তার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রে মামলা হওয়ার পর কানাডা তাকে গ্রেফতার করে। তিন বছর ধরে তিনি কানাডার ভ্যাঙ্কুভারে পিতা হুয়াওয়ের প্রতিষ্ঠাতা রেন জেনফেংয়ের মালিকানাধীন একটি বাড়িতে গৃহবন্দি অবস্থায় ছিলেন। এ বছরের সেপ্টেম্বরে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের কূটনীতিকদের মধ্যে আলোচনা ও সমঝোতার পর তিনি মুক্তি পান। কানাডায় তার পিতার বিনিয়োগ ও বাড়ি থাকার পরও মার্কিন নিষেধাজ্ঞা ও মামলার কারণে তাকে আইনি ঝামেলা পোহাতে হয়েছে।
এটি স্পষ্ট যে, একটা সময় পর্যন্ত অর্থ সরানোর নিরাপদ ও জনপ্রিয় গন্তব্য ছিল ইউরোপের দেশ সুইজারল্যান্ড। সারা বিশ্ব থেকেই কর ফাঁকি দিয়ে এবং অবৈধভাবে অর্জিত অর্থ জায়গা করে নিয়েছিল সুইস ব্যাংকগুলোতে। তবে ক্রমাগত সমালোচনার কারণে সাম্প্রতিক সময়ে সুইজারল্যান্ড এ বিষয়ে কিছুটা কড়াকড়ি আরোপ করেছে। বিভিন্ন দেশ থেকে সুইস ব্যাংকগুলোয় কী পরিমাণ অর্থ সঞ্চিত রয়েছে প্রতি বছরই সে তথ্য প্রকাশ করা হচ্ছে। তাছাড়া অর্থ পাচারের বিষয়ে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে তথ্য বিনিময়ও করছে দেশটি। এ কারণে দেশটিতে অর্থ রাখতে আগের মতো স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছেন না অনেকেই।
সিঙ্গাপুর ও হংকংকেও কেউ কেউ অর্থ সরানোর নিরাপদ গন্তব্য হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। তবে অনেক বেশি আলোচনায় আসায় অনেকেই এখন আর হংকংয়ের ব্যাপারেও স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছেন না। এ ছাড়া চীনের নিয়ন্ত্রণ ও রাজনৈতিক সংকটের কারণেও অর্থ সরানোর গন্তব্য হিসেবে হংকং থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছেন।
করস্বর্গ হিসেবে সিঙ্গাপুরের খ্যাতি থাকলেও কভিডের কারণে দেশটিতে মানুষের প্রবেশ ও চলাচলে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। এতে দেশটিতে অর্থ রাখা অনেকেই কভিডকালে ঢুকতে পারেননি। একই অবস্থা কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপের দেশগুলোর জন্যও প্রযোজ্য। এ দেশগুলোয়ও কভিডের সময় বাইরে থেকে অনেকেই ঢুকতে পারেননি। বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে যারা এসব দেশে অর্থ সরিয়ে থাকেন তাদের মূল উদ্দেশ্যই থাকে, যাতে প্রয়োজন ও সংকটের সময় নিজেদের এসব সম্পদ ভোগ করার পাশাপাশি নিজ দেশে প্রতিকূল পরিস্থিতি তৈরি হলে আশ্রয় নেয়া যায়। তাছাড়া উন্নত দেশের শক্তিশালী পাসপোর্ট সুবিধা কাজে লাগিয়ে বিশ্বব্যাপী নির্বিঘেœ ভ্রমণ সুবিধা ভোগ করার বিষয়টি তো রয়েছেই। কিন্তু কভিডের কারণে ইউরোপ-আমেরিকার মতো উন্নত দেশগুলোয় এসব সুবিধা বাধাগ্রস্ত হওয়ার কারণে এখন অনেকেই অর্থ রাখার জন্য তুলনামূলক আরো নিরাপদ উৎস খুঁজছেন।
উল্লেখ্য, পানামা পেপারস, প্যারাডাইস ও প্যান্ডোরা পেপারসের বদৌলতে বারমুডা, পানামা, কেম্যান আইল্যান্ড, মাল্টার মতো করস্বর্গ খ্যাত দেশগুলোয় শেল কোম্পানি খুলে অর্থ সরানোর ঘটনা সামনে এসেছে। তবে বাস্তবে যতগুলো ঘটনা সামনে এসেছে সেগুলোর তুলনায় এসব করস্বর্গে স্থানান্তরিত অর্থের পরিমাণ অনেক বেশি বলে সন্দেহ করছেন সংশ্লিষ্টরা। অনেকেই ভিন্ন কৌশলে ও বিভিন্ন স্তরে এসব দেশে অর্থ রাখার নতুন উপায় খুঁজছেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অর্থ সরানোর বিষয়টি যদি কখনো সামনে আসেও তাহলে এর পেছনে থাকা প্রকৃত ব্যক্তির নাম যাতে জানা না যায়, সেজন্যই নানা স্তরভিত্তিক এ ধরনের কৌশল অবলম্বন করা হচ্ছে।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category