নিজস্ব প্রতিবেদক :
বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের ছোট সুন্দর একটি দ্বীপ সেন্ট মার্টিন। এটি একটি প্রবাল দ্বীপ। এটি কক্সবাজার জেলার টেকনাফ হতে প্রায় ৯ কিলোমিটার দক্ষিণে ও মায়ানমার-এর উপকূল হতে ৮ কিলোমিটার পশ্চিমে নাফ নদীর মোহনায় অবস্থিত। প্রচুর নারিকেল পাওয়া যায় বলে স্থানীয়ভাবে একে নারিকেল জিঞ্জিরাও বলা হয়ে থাকে। বাংলাদেশের সমুদ্রপ্রেমীদের কাছে এটি ব্যাপক পরিচিত একটি নাম। বিখ্যাত লেখক, কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের দারুচিনি দ্বীপ নামের পূর্ণদৈর্ঘ্য ছায়াছবি দ্বারা এই দ্বীপটির পরিচিতি আরো বেড়ে যায়। এই দ্বীপে লেখকে ‘বৃষ্টি বিলাস’ নামে একটি বাড়িও আছে।
জানা যায়, ১৮৯০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে কিছু বাঙালি এবং রাখাইন সম্প্রদায়ের মানুষ এই দ্বীপে বসতি স্থাপনের জন্য আসে। এরা ছিল মূলত মৎস্যজীবী। যতটুকু জানা যায়, প্রথম অধিবাসী হিসাবে বসতি স্থাপন করেছিল ১৩টি পরিবার। এরা বেছে নিয়েছিল এই দ্বীপের উত্তরাংশ। কালক্রমে এই দ্বীপটি বাঙালি অধ্যুষিত এলাকায় পরিণত হয়। আগে থেকেই এই দ্বীপে কেয়া এবং ঝাউগাছ ছিল। সম্ভবত বাঙালি জেলেরা জলকষ্ট এবং ক্লান্তি দূরীকরণের অবলম্বন হিসাবে প্রচুর পরিমাণ নারকেল গাছ এই দ্বীপে রোপণ করেছিল। কালক্রমে পুরো দ্বীপটি একসময় ‘নারকেল গাছ প্রধান’ দ্বীপে পরিণত হয়। এই সূত্রে স্থানীয় অধিবাসীরা এই দ্বীপের উত্তরাংশকে নারিকেল জিঞ্জিরা নামে অভিহিত করা শুরু করে। ১৯০০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে ব্রিটিশ ভূ-জরিপ দল এই দ্বীপকে ব্রিটিশ-ভারতের অংশ হিসাবে গ্রহণ করে। জরিপে এরা স্থানীয় নামের পরিবর্তে খ্রিষ্টান সাধু মার্টিনের নামানুসারে সেন্ট মার্টিন নাম প্রদান করে। এরপর ধীরে ধীরে এই অঞ্চলের বাইরের মানুষের কাছে, দ্বীপটি সেন্ট মার্টিন নামেই পরিচিত লাভ করে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক শেখ বখতিয়ার উদ্দিন এর মতে, ১৯০০ খ্রিষ্টাব্দে দ্বীপটিকে যখন ব্রিটিশ ভারতের অন্তর্ভুক্ত করা হয়, তখন চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মার্টিনের নাম অনুসারে দ্বীপটির নামকরণ করা হয়। দ্বীপটিতে খ্রিষ্টান জনবসতি এবং কোন গির্জা না থাকায় একজন সাধুর নামে দ্বীপটির নামকরণ সঠিক ইতিহাস নয় বলেই মনে হয়। তৎকালীন জেলা প্রশাসকের নামে দ্বীপটির নামকরণ করা হয়েছিলো।
গবেষকদের মতে, সেন্ট মার্টিন্স দ্বীপে প্রায় ৬৬ প্রজাতির প্রবাল, ১শ ৮৭ প্রজাতির শামুক-ঝিনুক, ১শ ৫৩ প্রজাতির সামুদ্রিক শৈবাল, ১শ ৫৭ প্রজাতির গুপ্তজীবী উদ্ভিদ, ২শ ৪০ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ, চার প্রজাতির উভচর ও ১শ ২০ প্রজাতির পাখি পাওয়া যায়। স্থানীয়ভাবে পেজালা নামে পরিচিত ঝবধ বিবফং বা অ্যালগি এক ধরনের সামুদ্রিক শৈবাল সেন্ট মার্টিনে প্রচুর পাওয়া যায়। এগুলো বিভিন্ন প্রজাতির হয়ে থাকে তবে লাল অ্যালগি বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে জনপ্রিয়। এছাড়াও রয়েছে ১৯ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী। অমেরুদ-ী প্রাণীদের মধ্যে রয়েছে স্পঞ্জ, শিল কাঁকড়া, সন্ন্যাসী শিল কাঁকড়া, লবস্টার ইত্যাদি। মাছের মধ্যে রয়েছে পরী মাছ, প্রজাপতি মাছ, বোল করাল,রাঙ্গা কই, সুঁই মাছ, লাল মাছ,উড়ুক্কু মাছ ইত্যাদি। সামুদ্রিক কচ্ছপ সবুজ সাগর কাছিম এবং জলপাইরঙা সাগর কাছিম প্রজাতির ডিম পাড়ার স্থান হিসেবে জায়গাটি খ্যাত।
বিচিত্র প্রাণী ও উদ্ভিদে পরিপূর্ণ অপরূপ সৌন্দর্যের এই দ্বীপটি দিন দিন তার সৌন্দর্য যেমন হারাচ্ছে, তেমনি এর অস্তিত্বও প্রায় হুমকির মুখে পড়ে গেছে। ধ্বংস হচ্ছে এর জীববৈচিত্র। দ্বীপটিতে প্রতিদিন অনিয়ন্ত্রিত পর্যটকের যাতায়াত, অপরিকল্পিত স্থাপনা নির্মাণ, পরিবেশ দূষণ, পর্যটকদের অসচেতনতায় প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্য ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
সম্প্রতি বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউটের এক গবেষণায় সেন্টমার্টিনে সমুদ্রের পানিতে ই-কোলাই ব্যাকটেরিয়ার ভয়াবহ পরিমাণ উপস্থিতি পাওয়া গেছে। বিনোদনমূলক সৈকতের ১০০ মিলিলিটার পানিতে ১ থেকে ১০ কলনি ফরমিং ইউনিট (সিএফইউ) ফিকাল কলিফর্মের উপস্থিতি পাওয়া গেলে সেই পানি ই-কোলাই ব্যাকটেরিয়ায় দূষিত ধরা হয়। সেখানে সেন্টমার্টিনের সৈকতের পানিতে প্রতি ১০০ মিলিলিটারে ১ থেকে ২৭২ সিএফইউ ফিকাল কলিফর্ম, অর্থাৎ ই-কোলাই ব্যাকটেরিয়া পেয়েছেন গবেষকরা। সৈকত থেকে ১ কিলোমিটার দূরে প্রতি ১০০ মিলিলিটার পানিতে সর্বনিম্ন ৩২ থেকে সর্বোচ্চ ২৮০ সিএফইউ ফিকাল কলিফর্ম পাওয়া গেছে।
মনুষ্যঘটিত বেশ কয়েকটি প্রভাবে দ্বীপটি যেভাবে পরিবেশগত বিপর্যয়ের শিকার হচ্ছে, তা অব্যাহত থাকলে এবং অবিলম্বে পুনরুদ্ধারের উদ্যোগ নেওয়া না হলে অদূর ভবিষ্যতে দ্বীপটি সাগরগর্ভে তলিয়ে যেতে পারে বলেও শঙ্কা প্রকাশ করছেন বিশেষজ্ঞরা।
সেন্টমার্টিনে ঘুরতে আসা পর্যটকদের ঘিরে এখানে হোটেল গজিয়ে উঠেছে ব্যাঙের ছাতার মতো। জানা যায়, ২০১২ সালে সেন্টমার্টিনে ১৭টি হোটেল ছিল। ২০১৮ সালে তা ৪৮টিতে দাঁড়ায়। আর ইয়ুথ এনভায়রনমেন্ট সোসাইটির (ইয়েস) হিসাব অনুযায়ী, এখন সেন্টমার্টিনে হোটেল, মোটেল ও কটেজের সংখ্যা দেড়শ।
প্রবালের জন্য প্রসিদ্ধ এই দ্বীপে প্রবাস হ্রাস পাচ্ছে দ্রুত গতিতে। ৩৮ বছরে দ্বীপটিতে প্রবাল আচ্ছাদন ১ দশমিক ৩২ বর্গকিলোমিটার থেকে কমে শূন্য দশমিক ৩৯ বর্গকিলোমিটারে দাঁড়িয়েছে। প্রবাল প্রজাতি ১৪১টি থেকে কমে ৪০টিতে নেমেছে। বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকা সাড়ে ৪ বর্গকিলোমিটার থেকে কমে নেমেছে ৩ বর্গকিলোমিটারে। ২০৪৫ সালের মধ্যে সেন্টমার্টিন দ্বীপ প্রবালশূন্য হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
সূত্র জানায়, সেন্টমার্টিনের সুস্বাস্থ্য রক্ষার জন্য অবৈধভাবে নির্মিত সব স্থাপনা অপসারণ, জলজ প্রাণীর অনিয়ন্ত্রিত আহরণ বন্ধ ও অবাধ পর্যটন নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) ২০০৯ সালে জনস্বার্থে হাইকোর্টে মামলা করে। মামলার চূড়ান্ত শুনানি শেষে ২০১১ সালের ২৪ অক্টোবর আদালত দ্বীপে পরিবেশগত ছাড়পত্র ছাড়া গড়ে ওঠা সব স্থাপনা ভাঙার নির্দেশ দেন। পাশাপাশি জলজ প্রাণী সংরক্ষণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন। এরপরও কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় ২০১৭ সালে হাইকোর্ট সংশ্নিষ্টদের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার রুল জারি করেন।
দেশের একমাত্র এই প্রবাল দ্বীপটির অস্বিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য পরিবেশ অধিদপ্তরও বেশ কয়েক বার পদক্ষেপ নিয়েছে বলে জানা যায়। এ বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, কয়েক দফায় তারা সেন্টমার্টিনে পরিবেশ দূষণের দায়ে ৮০টি হোটেলের প্রত্যেকটিকে পাঁচ লাখ টাকা করে জরিমানা করেছে। অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের নোটিশও দিয়েছে। কিন্তু অবৈধভাবে গড়ে ওঠা সেন্টমার্টিনের এসব স্থাপনা উচ্ছেদে তারা কয়েক দফা অভিযানে গিয়ে দেখেছে, বেশিরভাগই আদালত থেকে নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে স্থগিতাদেশ নিয়েছে। এ কারণে অধিদপ্তর কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছে না।
জানা যায়, দ্বীপে পর্যটকদের বিচরণের নির্দিষ্ট কোন নীতিমালা নেই। দ্বীপে পর্যটকদের যাতায়াত নিয়ন্ত্রণে প্রতিদিন নির্দিষ্টসংখ্যক যাত্রীদের আনা -নেয়ার বিষয়ে নৌ মন্ত্রণালয় ও পর্যটন মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানানো হলেও এসব মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয় করা যাচ্ছে না বলে উল্লেখ করেন পরিবেশ অধিদপ্তরের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। তিনি অভিযোগ করেন, পর্যটক নিয়ন্ত্রণে পরিবেশ অধিদপ্তরের সুপারিশ পর্যটন মন্ত্রণালয় বাস্তবায়ন করেনি। একা পরিবেশ অধিদপ্তরের পক্ষে সব করা সম্ভব নয়।
এটি স্পষ্ট যে, অনিয়ন্ত্রিত পর্যটকের চাপ, অপরিকল্পিতভাবে পর্যটন শিল্প গড়ে তোলা, প্লাস্টিক ও অন্যান্য দূষণ, ক্ষতিকর পদ্ধতিতে মাছ ধরা, অতিরিক্ত মাছ ধরা ও বড় বড় জাহাজ চলাচলসহ মনুষ্যঘটিত অন্যান্য কারণেই এ দ্বীপের প্রবালগুলোর রোগাক্রান্ত হচ্ছে ও মরে যাওয়ার ঘটনা ঘটছে। অনিন্দ্য সুন্দর এই দ্বীপটিকে টিকিয়ে রাখতে সরকারের কঠোর পদক্ষেপের কোন বিকল্প নেই বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।