নিজস্ব প্রতিবেদক :
প্রতারণার দায়ে ইভ্যালির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ রাসেল ও তাঁর স্ত্রী ৩ দিনের রিমা-ে: প্রতারণা ও অর্থ-আত্মসাতের মামলায় ই-কমার্স সাইট ইভ্যালির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ রাসেল ও চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিনকে তিনদিনের রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। পুলিশ ১০ দিন রিমান্ড চেয়েছিল। কিন্তু ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আতিকুল ইসলাম তিনদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। গত বৃহস্পতিবার মোহাম্মদপুর থেকে র্যাব তাদেরকে গ্রেপ্তার করে। র্যাবের গোয়েন্দাদের জেরার মুখে প্রতিষ্ঠানটির সিইও মোঃ রাসেল হাজার কোটি টাকা দেনার কথা স্বীকার করেন। তিনি বলেন, ২০১৮ সনে প্রতিষ্ঠার পর থেকে ২০২১ সনের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ইভ্যালির দায় ছিল ৪০৩ কোটি টাকা। তাদের সম্পদ রয়েছে মাত্র ৬৫ কোটি টাকার। র্যাব’এর আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার আল মঈন বলেন, ইভ্যালি জন্মলগ্ন থেকেই লোকসানি প্রতিষ্ঠান ছিল। কখনো লাভের মুখ দেখেনি। গ্রাহকদের টাকাই ছিল তাদের পুঁজি। এই অর্থ দিয়ে যাবতীয় ব্যয় মেটানো হয়। এরপর থেকেই ধারাবাহিকভাবে তাদের দেনা বাড়তে থাকে।
রিমান্ড আবেদনের ওপর শুনানিতে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের প্রধান সরকারি কৌসুলি মোঃ আব্দুল্লাহ আবু আদালতকে বলেন, ইভ্যালি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পণ্য না দিয়ে গ্রাহকের টাকা আত্মসাৎ করেছে। শত শত গ্রাহকের কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন তারা। এউ আত্মসাতের সঙ্গে কেবল রাসেল কিংবা শামীমা একা নয়, আরও অনেকে জড়িত। তাদের গ্রেফতার এবং ঘটনার রহস্য উদঘাটনের জন্য আসামীদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা জরুরি।
রাসেল ও শামীমার আইনজীবী মনিরুজ্জামান আসাদ রিমান্ড আবেদন বাতিলের বিপক্ষে যুক্তি-তর্ক উপস্থাপন করলেও তা গৃহীত হয়নি। এদিকে বেলা তিনটার দিকে রাসেল ও শামীমাকে আদালতের হাজতখানা থেকে এজলাসে তোলার সময় আদালতের সামনে রাসেলের পক্ষে কয়েকজন ব্যক্তি স্লোগান দেন। রিমান্ড মঞ্জুর হওয়ার পর যখন তাকে এজলাস থেকে হাজতখানায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, তখনও কয়েকজনকে তার পক্ষে স্লোগান দিতে দেখা যায়। এই স্লোগান তোলা ব্যক্তিদের স্বার্থ যে কি তা পরিস্কার বোঝা যায়। পুলিশ এদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়, এবং সেসময় একজনকে আটক করে।
ই-ভ্যালির জন্ম: ২০১৮ সালে ই-বাণিজ্যের প্ল্যাটফর্ম হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয় ইভ্যালি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউট (আইবিএ) থেকে এমবিএ ডিগ্রিধারী মোহাম্মদ রাসেল হচ্ছেন ই-ভ্যালির প্রতিষ্ঠাতা। মাত্র ৫০ হাজার টাকা মূলধনে তিনি শুরু করেন ইভ্যালি যার মধ্যে ৪০ হাজার টাকা দেন তার স্ত্রী শামীমা নাসরীন, এবং তিনি দেন বাকি ১০ হাজার টাকা। রাসেলের কর্মজীবন শুরু হয় ঢাকা ব্যাংক দিয়ে। পরে তা ছেড়ে দিয়ে ‘কিডস’ ব্র্যান্ডের ডায়াপার আমদানি শুরু করেন। পরে নিয়ে আসেন ই-ভ্যালি। পরিচিতি বৃদ্ধির জন্য শুরু থেকেই কোম্পানিটি প্রতিযোগিতামূলক পণ্যমূল্যের উপর মনোনিবেশ করেছিল। মোটরসাইকেল, গাড়ি, মোবাইল ফোন, ঘরের সরঞ্জাম এবং আসবাবপত্রের মতো ইত্যাদি উচ্চমূল্যের পণ্যে লোভনীয় ছাড় দেয়। শুরুর দিকে চালু করা হয় ‘ভাউচার’ নামক একটি পদ্ধতি, এতে দেওয়া হতো ৩০০ শতাংশ ও ২০০ শতাংশ ক্যাশব্যাক। কিছুদিন পর ঘূর্ণিঝড়, ভূমিকম্প ইত্যাদি নামে তারা ক্রেতাদের ১০০% থেকে শুরু করে ১৫০% ক্যাশব্যাকের মতো অত্যন্ত লোভনীয় অফার দেয়। শুরুর দিকে ১০ টাকায় একটি পেনড্রাইভ এবং ১৬ টাকায় টি-শার্ট বিক্রি করেও সাড়া জাগায় ই-ভ্যালি। তাদের ব্যবসার এই কৌশলের ফলে মানুষের মাঝে উদ্দীপনা সৃষ্টি করে।
২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত ‘চ্যানেল আই মিডিয়া অ্যাওয়ার্ড -২০২০’ এ ইভ্যালি ই-বাণিজ্য বিভাগে সেরা কোম্পানি হিসাবে নির্বাচিত হয়েছিল। ২০২০ সালের নভেম্বরে, ইভালি তাদের খাদ্য সরবরাহ পরিষেবা ‘ইফুড’ এর জন্য ই-সিএবি কর্তৃক ইকমার্স মুভার্স অ্যাওয়ার্ড (ইসিএমএ) পেয়েছিল। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে সিঙ্গাপুর-ভিত্তিক আন্তর্জাতিক ম্যাগাজিন এশিয়াওয়ান ইভ্যালিকে বাংলাদেশের সবচেয়ে দ্রুত বর্ধমান ব্র্যান্ড হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
অভিনব প্রতারণা: শুরুতে চমক সৃষ্টি করলেও ইভ্যালির গ্রাহক-প্রতারণা শুরু হয় দ্রুতই। মূলত প্রতারণাই ছিল তাদের মূল লক্ষ্য। ‘গিফট কার্ড’ নাম দিয়েও গ্রাহকের কাছ থেকে অগ্রিম টাকা নিতে শুরু করে ই-ভ্যালি। যাঁরা গিফট কার্ড কিনছেন, তাঁরা তাঁদের টাকা ফেলে রাখতে বাধ্য হয়।
তাদের গ্রাহক প্রতারণার আরেকটি ফাঁদ হলো ‘ই-ওয়ালেট’। ই-ভ্যালিতে পণ্য না পেয়ে অনেক সময় ক্রেতা যখন বিরক্ত হয়ে অর্ডার বাতিল করে দেন, তখন তাঁর টাকা জমা হয় ই-ওয়ালেটে। পণ্যের সরবরাহ না থাকায় ই-ভ্যালি নিজেও বাতিল করে দেয় অর্ডার। তখনো গ্রাহকের টাকা ই-ওয়ালেটে জমা হয়। টাকা আর ফেরত পান না গ্রাহক, বরং অন্য পণ্য কিনে উশুল করতে হয়। যেমন ধরুন, কেউ একজন আসুসের ল্যাপটপ কিনবেন বলে অর্ডার দিলেন। টাকাও জমা দিলেন। এক থেকে দুই মাস পর ই-ভ্যালি তাকে জানাল যে পণ্যটির সরবরাহ নেই। সরবরাহ আছে বেশি বেশি দরের অন্য ব্র্যান্ডের ল্যাপটপ। গ্রাহক তখন সেটাই নিতে বাধ্য হন।
ই-ভ্যালি যে ওয়ালেট পদ্ধতিতে টাকা রাখতে শুরু করে তা বাংলাদেশ ব্যাংকের লাইসেন্সবিহীন। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হওয়ার এক সপ্তাহের মাথায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক গত ৫ মার্চ দেশের সব তফসিলি ব্যাংক, মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) সেবাদাতা, পেমেন্ট সার্ভিস সেবাদাতা (পিএসপি) এবং পেমেন্ট সিস্টেম অপারেটরের (পিএসও) উদ্দেশে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। বলেছে, কিছু প্রতিষ্ঠান লাইসেন্স না নিয়েই পিএসপি ও পিএসওর মতো কার্যক্রম চালাচ্ছে, যা আইনসিদ্ধ নয়। কেউ প্রতারিত হলে গ্রাহকদের আস্থা নষ্ট হবে এবং অর্থনীতিতেও বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে।
কিন্তু ই-ভ্যালির এমডি মোহাম্মদ রাসেল এসবে কর্ণপাত করেননি। তাঁর ভাষ্য ছিল, ‘শুধু আমরা নই, পুরো ই-কমার্সই এখন উঠতির দিকে। ই-ভ্যালিতে বিদেশি বিনিয়োগ আনারও চেষ্টা করছি। কিছু ভুল থাকতে পারে। তবে ভালো ব্যবসা করছি, ভালো সাড়াও পাচ্ছি। আর বাংলাদেশ ব্যাংক যে ওয়ালেটের কথা বলছে, আমাদের সে ধরনের ওয়ালেট নেই। তাই লাইসেন্স নেওয়ার দরকার নেই।’
দায় ট্রান্সফারের অনৈতিক কৌশলঃ
ই-ভ্যালির ব্যাবসায়িক কৌশল ছিল নতুন গ্রাহকের ওপর দায় চাপিয়ে দিয়ে পুরনো গ্রাহক ও সরবরাহকারীদের দেনা আংশিক পরিশোধ করা। অর্থাৎ তারা দায় ট্রান্সফার কৌশল অবলম্বন করে। এটি একটি অনৈতিক কৌশল। মোঃ রাসেল যে জেনেশুনে এই কৌশল অবলম্বন করেছেন তা তিনি র্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছেন।
এ ব্যাপারে র্যাবের মুখপাত্র বলেন, রাসেল ও শামীমার মূল লক্ষ্যছিল ইভ্যালির ‘ব্র্যান্ড ভ্যালু’ তৈরি করা। ব্র্যান্ড ভ্যালু তৈরি করার পর তাদের লক্ষ্য ছিল দায়সহ কোন প্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের কাছে প্রতিষ্ঠানটি বিক্রি করে দেয়া। এজন্য তারা বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ করে। এ ছাড়া তাদের আরও একটি পরিকল্পনা ছিল বিভিন্ন প্রতিষ্ঠিত কোম্পানির কাছে কোম্পানি শেয়ারের প্রস্তাব দিয়ে দায় চাপিয়ে দেওয়া। ইভ্যালির তিন বছর পূর্তির পর শেয়ারবাজারে অন্তর্ভুক্তির একটা ব্যাপার আসতো। শেয়ার বিক্রির মাধ্যমে দায় চাপানোর পরিকল্পনাও ছিল তাদের। গ্রাহকদের দায় মেটানোর জন্য বিভিন্ন অজুহাতে সময় বাড়ানোর আবেদন করা ছিল রাসেলের একটি কৌশল। দায় মেটাতে ব্যর্থ হলে শেষমেশ প্রতিষ্ঠানটিকে দেউলিয়া ঘোষণা করতে চেয়েছিল সে।
দেউলিয়া হওয়ারই বা বাকি আছে কি। ইভ্যালির পকেটে এখন টাকা নেই। ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকরা টাকা কীভাবে ফেরত পাবেন এ নিয়ে হাজারো প্রশ্ন এখন থেকেই যায়। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে অবশ্য স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয়া হয়েছে, ই-কমার্স খাতে বিনিয়োগ করে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তাদের দায় সরকার নেবে না কারণ, ক্ষতিগ্রস্তরা খোঁজখবর না নিয়েই বিনিয়োগ করেছেন।