• শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪, ০৯:৪৩ পূর্বাহ্ন
  • ই-পেপার
সর্বশেষ
সর্বোচ্চ আদালতকে পাশ কাটিয়ে সরকার কিছুই করবে না: আইনমন্ত্রী নাইজেরিয়ান চক্রের মাধ্যমে চট্টগ্রামে কোকেন পাচার কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের অপেক্ষা করতে বললেন ব্যারিস্টার সুমন পদ্মা সেতুর সুরক্ষায় নদী শাসনে ব্যয় বাড়ছে পিএসসির উপ-পরিচালক জাহাঙ্গীরসহ ৬ জনের রিমান্ড শুনানি পিছিয়েছে শৃঙ্খলা ভঙ্গের চেষ্টা করলে কঠোর ব্যবস্থা: ডিএমপি কমিশনার রপ্তানিতে বাংলাদেশ ব্যবহার করছে না রেল ট্রানজিট রাজাকারের পক্ষে স্লোগান সরকারবিরোধী নয়, রাষ্ট্রবিরোধী: পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. ইউনূসসহ ১৪ জনের মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়নি বঙ্গোপসাগরের জীববৈচিত্র্য নিয়ে প্রামাণ্যচিত্র-আলোকচিত্র প্রদর্শনী

উপকূলীয় অঞ্চলে বিপুল পরিমাণ জমি লবণাক্ততায় অনাবাদি হয়ে পড়ছে

Reporter Name / ১৩৯ Time View
Update : সোমবার, ২০ ডিসেম্বর, ২০২১

নিজস্ব প্রতিবেদক :
দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের বিপুল পরিমাণ জমি লবণাক্ততায় অনাবাদি হয়ে পড়ছে। মূলত জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রভাবেই উপকূলীয় অঞ্চলের জমিগুলোতে লবণাক্ততার মাত্রা বাড়ছে। আর লবণাক্ততার তীব্রতায় আবাদি জমি অনাবাদি হয়ে পড়ছে। ফলে ফলন কমছে। মৃত্তিকা সম্পদ গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (এসআরডিআই) এক সমীক্ষার তথ্যানুযায়ী শুধু লবণাক্ততার কারণেই প্রতি বছর উপকূলীয় জেলাগুলো ৩০ লাখ টনেরও বেশি খাদ্যশস্য উৎপাদন-বঞ্চিত থেকে যাচ্ছে। মৃত্তিকা সম্পদ গবেষণা প্রতিষ্ঠান (এসআরডিআই) সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, লবণাক্ততা দেশের দক্ষিণাঞ্চলের খাদ্য নিরাপত্তাসহ সার্বিক আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতিতেই বড় মাত্রায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। লবণাক্ততা বাড়তে থাকায় উপকূলীয় অঞ্চলের মাটিতে অণুজীবের সক্রিয়তা কমে যাচ্ছে। একই সঙ্গে মাটিতে জৈব পদার্থ, নাইট্রোজেন ও ফসফরাসের সহজলভ্যতাও কমে যাচ্ছে। তার বিপরীতে কপার ও জিংকের মাত্রা বাড়ছে। তবে বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টিপাতের কারণে লবণাক্ততা কিছুটা হ্রাস পায়। ওই সময় কিছু লবণাক্ত এলাকায় ধানের, বিশেষ করে আমন ফসলের আবাদ করা সম্ভব হয়। তবে মৌসুমের শেষ দিকে বৃষ্টি কমে এলে ফসলে দানার সংখ্যাও হ্রাস পায়। তাতে করে কৃষকরা ফলন ঠিকমতো পায় না। লবণাক্ততার প্রভাবে মাটির উর্বরতা যেমন কমছে, তেমনি কমছে গাছের উৎপাদনক্ষমতাও। দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে মাঝারি থেকে খুবই তীব্র মাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত জমির পরিমাণ ৮ লাখ ৭০ হাজার হেক্টর (স্বল্পমাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত জমিকে বাদ দিয়ে)। ওসব জমিতে প্রতি বছর লবণাক্ততার কারণে হেক্টরপ্রতি গড়ে ৩ দশমিক ৪৮ টন করে শস্য উৎপাদন কম হচ্ছে। সব মিলিয়ে উপকূলীয় অঞ্চলের জমিগুলো শুধু লবণাক্ততার কারণেই ৩০ লাখ ২৭ হাজার টনেরও বেশি ফলন হারাচ্ছে। সব মিলিয়ে দেশে প্রতি বছর শুধু উপকূলীয় জমিতে লবণাক্ততার কারণে ৩ হাজার ২৩৫ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে।
সূত্র জানায়, বিগত ১৯৭৩ সালে উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ত জমির পরিমাণ ছিল ৮ লাখ ৩৩ হাজার হেক্টর। বর্তমানে তা বেড়ে ১০ লাখ ৬০ হাজার হেক্টরে দাঁড়িয়েছে। ওই হিসেবে গত চার যুগে উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ত জমির পরিমাণ ২৭ শতাংশেরও বেশি বেড়েছে। তার মধ্যে হালকা মাত্রায় লবণাক্ত জমির পরিমাণ ১ লাখ ৯০ হাজার হেক্টর, মধ্যম মাত্রায় ২ লাখ ৫০ হাজার, তীব্র মাত্রায় ৪ লাখ ২০ হাজার ও খুব তীব্র মাত্রায় লবণাক্ত জমির পরিমাণ ২ লাখ হেক্টর। উপকূলীয় অঞ্চলে ওসব এলাকায় মোট আবাদি জমির পরিমাণ ২৮ লাখ ৩০ হাজার হেক্টর। তার মধ্যে চাষযোগ্য ২১ লাখ ৬২ হাজার হেক্টর। ওই হিসেবে উপকূলীয় অঞ্চলের চাষযোগ্য জমির প্রায় অর্ধেকই লবণাক্ত। লবণ পানির ভয়াবহতার কারণে প্রতি বছর শুষ্ক মৌসুমে উপকূলীয় এলাকায় ৫ লাখ হেক্টরেরও বেশি জমি অনাবাদি থেকে যায়।
সূত্র আরো জানায়, বৈশ্বিক উষ্ণতা ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ার কারণেই উপকূলীয় অঞ্চলের মাটিতে সমুদ্রের লবণাক্ত পানির অনুপ্রবেশ ঘটছে। একই সঙ্গে ভূগর্ভস্থ পানিতেও লবণাক্ততা বাড়ছে। তাছাড়া জলোচ্ছ্বাসের সময়েও সমুদ্রের নোনাপানি উঁচু ভূমিতে উঠে আসে। পরে তা নিষ্কাশনের ব্যবস্থা নেয়া হয় না। নদীতে সুপেয় পানির অভাব থাকায় নোনাপানি অপসারণ প্রক্রিয়াটিও বেশ কঠিন হয়ে পড়েছে। তাছাড়া পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাতের অভাব, উপকূলীয় নদ-নদী ভরাট হয়ে যাওয়ায় জোয়ারের সময় বাঁধ উপচে পড়ছে। ফলে কৃষিজমিতে সমুদ্রের লবণাক্ত পানি চলে আসছে। তাতে ব্যাহত হচ্ছে কৃষিজমির স্বাভাবিক উৎপাদনক্ষমতা। যদিও উপকূলীয় অঞ্চলের জমিগুলোয় আবাদের ক্ষেত্রে চার ধরনের পদ্ধতি রয়েছে। কিন্তু ওই চার ধরনের পদ্ধতিতে সিংহভাগ সময়ই জমি পতিত থাকে। তার মধ্যে পতিত-রোপা আমনে ব্যবহৃত হচ্ছে উপকূলীয় অঞ্চলের ৩৮ দশমিক ৫ শতাংশ জমি। ফলে ওখানে দুই মৌসুমেই পুরো জমি পতিত থাকছে। অন্যদিকে রবি-আউশ-রোপা আমনে ব্যবহৃত হচ্ছে ২৪ শতাংশ জমি, পতিত-রোপা আউশ-রোপা আমনে ব্যবহৃত হচ্ছে ১৪ দশমিক ১ শতাংশ জমি এবং পতিত-বোরো-রোপা আমনে ব্যবহৃত হচ্ছে ৯ দশমিক ৬ শতাংশ জমি। অতিরিক্ত লবণাক্ততার কারণে ওই অঞ্চলের অধিকাংশ জমি পতিত থাকছে। যে কারণে ওই অঞ্চলে লবণক্ততাসহিষ্ণু ধানের ও শস্যের জাত সম্প্রসারণ করা প্রয়োজন। বিশেষ করে সেখানে ধান, সবজি, মসলাজাতীয়, ফল ও তেলজাতীয় শস্যের আবাদ বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে। পাশাপাশি মাটি ও পানি ব্যবস্থাপনায় জোরদারের মাধ্যমে সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ করার বিষয়টিও জরুরি হয়ে পড়েছে।
এদিকে জলবায়ু বিশেষজ্ঞদের মতে, উপকূলীয় অঞ্চলের নদীর পানি ক্রমান্বয়ে লবণাক্ত হয়ে পড়ছে। লবণাক্ততার কারণে পরিস্থিতি গুরুতর খারাপের দিকেই যাচ্ছে। লবণাক্ত পানি প্রবেশ ঠেকাতে না পারা ও দুর্যোগের কারণে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসের কারণে বিপর্যয় আরো বাড়বে। জমি আবাদযোগ্য করে তুলতে না পারলে জনজীবন ও বাস্তুসংস্থানে তার প্রভাব পড়বে। লবণাক্ততাসহিষ্ণু জাত উদ্ভাবন ও তা দ্রুত কৃষকের কাছে পৌঁছানো এবং উন্নত প্রযুক্তি সম্প্রসারণ জরুরি। পাশাপাশি উপকূলীয় অঞ্চলে বাঁধ নির্মাণ ও পুননির্মাণ করে লবণ পানি প্রবেশ ঠেকাতে হবে। সার্বিকভাবে ওই অঞ্চলের উন্নয়নে সমন্বিত পরিকল্পনা ও তার বাস্তবায়ন জরুরি।
অন্যদিকে বিশ্বব্যাংকের ‘রিভার স্যালাইনিটি অ্যান্ড ক্লাইমেট চেঞ্জ এভিডেন্স ফ্রম কোস্টাল বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক গবেষণার তথ্যমতে, ২০৫০ সালের মধ্যে উপকূলীয় অঞ্চলের ১৪৮টি থানার মধ্যে ১০টি থানার বিভিন্ন নদীর পানি মাত্রাতিরিক্ত লবণাক্ততায় আক্রান্ত হবে। সেগুলো হলো সাতক্ষীরার শ্যামনগর, আশাশুনি, কালিগঞ্জ, খুলনার বটিয়াঘাটা, দাকোপ, ডুমুরিয়া, কয়রা, পাইকগাছা, বাগেরহাটের মোংলা ও পটুয়াখালীর কলাপাড়া। বর্তমানে সেখানে ১০ পিপিটি মাত্রার কাছাকাছি লবণাক্ততা বিরাজ করলেও ২০৫০ সালের মধ্যে তা কোনো কোনো স্থানে ২৫ পিপিটি মাত্রায় উন্নীত হবে। ওই সময়ে লবণাক্ততা, সমুদ্রের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি ও অন্যান্য জলবায়ুসংক্রান্ত বৈরী প্রভাবের কারণে বাংলাদেশের প্রায় ১ কোটি ৩৩ লাখ উপকূলীয় মানুষ বাস্তুচ্যুত হতে পারে। তাছাড়া উপকূলীয় তিন জেলা খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরার ১ হাজার ৬৫০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের অবস্থা এখন বেশ নাজুক। প্রায় ৬০ বছর আগে তৈরি ওসব বাঁধের এখন আর দুর্যোগ মোকাবেলার সক্ষমতা নেই। ওই কারণে উপকূলীয় অঞ্চলজুড়ে ধীরে ধীরে গ্রাাস করে নিচ্ছে নোনাপানি। আবাদহীন হয়ে পড়ছে স্থানীয়রা। ফলে কাজ হারিয়ে অন্য জেলায় উদ্বাস্তু হচ্ছে উপকূলের মানুষ।
সম্প্রতিত কৃষিমন্ত্রীর নেতৃত্বে কৃষি মন্ত্রণালয়ের উচ্চ পর্যায়ের এক বিশেষজ্ঞ টিম খুলনার উপকূলীয় অঞ্চলে পরিদর্শনে যায়। ওই পরিদর্শন কার্যক্রমের উদ্দেশ্য ছিল কৃষির উন্নয়ন ও সম্ভাবনা এবং প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলায় কর্মকৌশল নির্ধারণ। ওই সময় কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আবদুর রাজ্জাক জানান, দেশের উপকূলীয় ও দক্ষিণাঞ্চলের লবণাক্ত জমিতে কৃষি উৎপাদনের সম্ভাবনা কাজে লাগাতে ধান, ডাল, তরমুজ, আলু, ভুট্টা, বার্লি, সূর্যমুখী, শাকসবজিসহ অনেক ফসলের লবণাক্ততাসহিষ্ণু উন্নত জাত উদ্ভাবন করা হচ্ছে। ওসব জাত ও উৎপাদন প্রযুক্তি উপকূলবর্তী বিপুল এলাকার চাষীদের মধ্যে দ্রুত সম্প্রসারণের জন্য কাজ চলছে। ওই লক্ষ্যে রোডম্যাপ প্রণয়নের কার্যক্রম চলমান আছে। চাষীরা ওসব ফসলের চাষ করলে দক্ষিণাঞ্চলের লবণাক্ত এলাকায় নতুন করে কৃষি বিপ্লব ঘটবে। আমন ধান তোলার পর বছরের বাকি সময়টা মাঠের পর মাঠ জমি অলস পড়ে থাকতো। প্রতিকূল ও বিরূপ পরিবেশে বছরে কীভাবে দুবার বা তিনবার ফসল চাষ করা যায় ওই লক্ষ্য নিয়ে কাজ করা হচ্ছে।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category