নিজস্ব প্রতিবেদক :
বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অর্থ লুটপাট বা গুরুতর কোনো অপরাধ করলেও প্রতিষ্ঠানের গভর্নিং বডি, ম্যানেজিং কমিটি, নির্বাহী কমিটি, অ্যাডহক কমিটি ও বিশেষ পরিস্থিতি কমিটির বেসরকারি সদস্যদের বিরুদ্ধে এবারও কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি। আর্থিক লুটপাট করলেও তারা থাকবেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে শিক্ষা বোর্ড শুধু কমিটি ভেঙে দিতে বা সভাপতি কিংবা সদস্যদের পদ বাতিল করতে পারবে। এমন বিধান রেখেই নিম্ন মাধ্যমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকস্তরের বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গভর্নিং বডি, ম্যানেজিং কমিটি প্রবিধানমালা-২০২৪ প্রণয়ন করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। সম্প্রতি প্রবিধানমালাটি গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়েছে। প্রসঙ্গত, ২০০৯ সালের প্রবিধানমালাটিতেও শিক্ষক প্রতিনিধি ছাড়া প্রতিষ্ঠান পরিচালনা কমিটির কোনো সদস্য কিংবা সভাপতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ ছিল না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ব্যবস্থাপনা কমিটির বিরুদ্ধে আর্থিক কেলেঙ্কারির অভিযোগ উঠে বিভিন্ন সময়। এমনকি কমিটিকে নিয়ন্ত্রণে রাখা যাচ্ছিল না। ফলে দীর্ঘদিন পর ২০০৯ সালের প্রবিধান রহিত করে নতুন এই প্রবিধানমালা-২০২৪ প্রণয়ন করে গত ২৫ এপ্রিল তা গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়েছে। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক নেহাল আহমেদ বলেন, আগের প্রবিধানের চেয়ে অনেক বেশি স্বচ্ছ হয়েছে নতুন প্রবিধানমালা। জবাবদিহি বেড়েছে। তাছাড়া প্রতিষ্ঠানের প্রধান না চাইলে গভর্নিং বডির কোনো সদস্য, এমনকি সভাপতিও আর্থিক দুর্নীতি করতে পারবে না। আন্তশিক্ষা বোর্ড সমন্বয়ক ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তপন কুমার সরকার বলেন, আগের প্রবিধানমালার চেয়ে নতুন প্রবিধানমালা অনেক বেশি স্বচ্ছ হয়েছে। তাতে কমিটিকে অনেক বেশি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। তবে শিক্ষাবিদ ও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিক্ষক প্রতিনিধি ছাড়া প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা কমিটির কেউ দুর্নীতি করলে এই প্রবিধানমালা অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ নেই। তবে দেশের প্রচলিত আইনে যে কেউ মামলা করতে পারবে। অভিযোগ প্রমাণ হলে প্রচলিত আইনেও বিচার করার সম্ভব। তবে যারা কমিটির সভাপতি বা সদস্য হন, তাদের বিরুদ্ধে সাধারণ কেউ মামলা করার সাহস করে না। রাজধানীর অনেক প্রতিষ্ঠানে এখন আমলারা সভাপতি। শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যানের চেয়ে বেশি ক্ষমতা তাদের। এ কারণে চেয়ারম্যান কখনও সভাপতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারবে না। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও শিক্ষাবিদ রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, কমিটির বেসরকারি সদস্যদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ থাকলে ভালো হতো। গভর্নিং বডি, ম্যানেজিং কমিটি নিয়োগ বাণিজ্য, ভর্তি বাণিজ্যসহ নানা অপরাধ করে। অভিযোগ গুরুত্ব প্রমাণ হলে তাদের শাস্তি নিশ্চিত করা জরুরি। শিক্ষাব্যবস্থা ঠিক করার জায়গায় ত্রুটি থাকলে তো সমস্যা। চলিত আইনে মামলা করার সুযোগ হয়তো আছে, কিন্তু কে বাদী হবে? শুধু শিক্ষকদের বলির পাঁঠা বানিয়ে লাভ কী? প্রকাশিত প্রবিধানমালায় গভর্নিং বডি গঠন করার প্রক্রিয়া ও তার এখতিয়ার কর্মপরিধি সংরক্ষণ করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠান ব্যবস্থাপনা কমিটিকে আর্থিক ব্যবস্থাসহ সব দায়িত্ব পালনের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এমনকি লেখাপড়ার মান ও সহপাঠ কার্যক্রম নিয়েও দায়িত্ব পালন করবে ব্যবস্থাপনা কমিটি। অথচ স্বেচ্ছাচারিতা ও অর্থ লোপাট করলেও প্রবিধানমালা অনুযায়ী কমিটির শিক্ষক প্রতিনিধি ছাড়া অন্য কোনো বেসরকারি সদস্য বা সভাপতির বিরুদ্ধে আইনগত কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ রাখা হয়নি। তবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধান, শিক্ষক এবং শিক্ষক প্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ চাকরিচ্যুতির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। ৭১ প্রবিধানে বলা হয়, শিক্ষা বোর্ড স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে বা সরকারের নির্দেশে গভর্নিং বডি, ম্যানেজিং কমিটি, নির্বাহী কমিটি, অ্যাডহক কমিটি বা বিশেষ পরিস্থিতি কমিটির যেকোনও বিষয় অনুসন্ধান করতে কিংবা কোনো অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত করতে পারবে এবং সংশ্লিষ্ট রেকর্ডপত্র তলব করতে পারবে। প্রবিধানমালার ৭২-এর (১)-এ বলা হয়, এই প্রবিধানমালার কোনো বিধান লঙ্ঘন, সরকার বা শিক্ষা বোর্ড জারি করা কোনো নির্দেশনা অমান্য করলে আর্থিক অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা, প্রতিষ্ঠানের স্বার্থহানি বা অনুরূপ কোনো কারণ প্রমাণিত হলে শিক্ষা বোর্ড যেকোনও সময় গভর্নিং বডি, ম্যানেজিং কমিটি, নির্বাহী কমিটি, অ্যাডহক কমিটি বা বিশেষ পরিস্থিতি কমিটি বাতিল করতে পারবে। প্রবিধানমালার ৭২-এর ৫ উপ-প্রবিধানে বলা হয়, এই প্রবিধানে যা কিছুই থাকুক না কেন আর্থিক অনিয়ম ও প্রতিষ্ঠানের স্বার্থহানি দালিলিকভাবে প্রমাণযোগ্য কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া গেলে শিক্ষা বোর্ড কমিটি বাতিল করতে পারবে। প্রবিধানমালার ৭৩-এ বলা হয়েছে, সভাপতি ও কোনো সদস্যের কার্যকলাপ বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কিংবা শিক্ষার্থীদের স্বার্থ পরিপন্থি হলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধান স্বয়ং কিংবা ক্ষেত্রমতো দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের আবেদনের ভিত্তিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধান বা সংশ্লিষ্ট কমিটির কোনো সদস্য শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যানের কাছে লিখিতভাবে অভিযোগ জানাতে পারবে। ৭৩-এর ৫ উপ-প্রবিধানে বলা হয়েছে, অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে স্বেচ্ছাচারিতা, অদক্ষতা, আর্থিক অনিয়ম বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিপন্থি কোনো অপরাধ প্রমাণিত হলে শিক্ষা বোর্ড সভাপতি পদ বা সদস্য পদ বাতিল করতে পারবে। তবে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে কিছু বলা নেই প্রবিধানমালায়। অন্যদিকে শিক্ষক-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ দ- হিসেবে চাকরিচ্যুতির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।