নিজস্ব প্রতিবেদক :
খেলাপি হওয়ার ঝুঁকিতে বেসরকারি খাতে নেয়া বিপুল পরিমাণ বিদেশী ঋণ। মূলত টাকার বিপরীতে ডলারের বিনিময় হার বৃদ্ধির পাশাপাশি রিজার্ভে মার্কিন মুদ্রা সঙ্কটের কারণে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। চলতি বছরের জুন পর্যন্ত বেসরকারি খাতে বিদেশী ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৫৯৫ কোটি বা প্রায় ২৬ বিলিয়ন ডলার। বিপুল পরিমাণ ওই বিদেশী ঋণের ৬৮ শতাংশের মেয়াদই স্বল্পমেয়াদি। আর বেসরকারি খাতে দীর্ঘমেয়াদি বিদেশী ঋণের পরিমাণ ৮১৯ কোটি ডলার ছাড়িয়ে গেছে। তার মধ্যে বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎ ব্যবসায়ীরা ৪১০ কোটি ডলার নিয়েছেন। জ¦ালানি খাতে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের দীর্ঘমেয়াদি বিদেশী দায় যোগ করে তার পরিমাণ ৪৩৩ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে উদ্যোক্তারা নির্দিষ্ট সময়ে ঋণের কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হতে শুরু করেছে। আবার উদ্যোক্তারা চাইলেও মধ্যস্থতাকারী দেশী ব্যাংকগুলো ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে পারছে না। এমন পরিস্থিতিতে বিদেশীদের কাছে খেলাপি হওয়া থেকে বাঁচতে কেউ কেউ ইতোমধ্যে ঋণের মেয়াদ বাড়িয়ে নিয়েছে। আবার ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান মেয়াদ বাড়াতে রাজি না হলে অন্য বিদেশী প্রতিষ্ঠান থেকে বেশি সুদে ঋণ নিয়ে দায় সমন্বয়ের চেষ্টা করা হচ্ছে। ব্যাংকিং খাত সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, সরকারি ও বেসরকারি উভয় খাতেই গত ৫ বছরে বিদেশী উৎস থেকে ঋণ অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বিদেশী উৎস থেকে দেশের মোট ঋণের পরিমাণ ছিল ৪৫ দশমিক ৮১ বিলিয়ন বা ৪ হাজার ৫৮১ কোটি ডলার। আর চলতি বছরের জুন শেষে বিদেশী ওই ঋণের পরিমাণ ৯৫ দশমিক ৮৫ বিলিয়ন (৯ হাজার ৫৮৫ কোটি) ডলার ছাড়িয়ে যায়। বর্তমান বিনিময় হার অনুযায়ী বাংলাদেশী মুদ্রায় ওই ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ১০ লাখ ৬ হাজার কোটি টাকারও বেশি, যা দেশের মোট জিডিপির প্রায় ২২ শতাংশ। বিপুল অংকের ওই ঋণের সরকারের ৭৩ শতাংশ আর বাকি ২৭ শতাংশ ঋণ নিয়েছে বেসরকারি খাত। ৫ বছর আগে দেশের বেসরকারি খাতে বিদেশী ঋণের পরিমাণ ছিল ১২ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু চলতি বছরের জুন শেষে বিদেশী ওই ঋণের পরিমাণ ২৫ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন বা ২ হাজার ৫৯৫ কোটি ডলারে গিয়ে ঠেকেছে। বাংলাদেশী মুদ্রায় বেসরকারি খাতে বিদেশী ওই ঋণ ২ লাখ ৭২ হাজার কোটি টাকারও বেশি। করোনা মহামারীর দুই বছরে বিপুল অংকের ওই ঋণের অন্তত ১০ বিলিয়ন ডলার নেয়া হয়েছে। ব্যক্তি খাতের কোম্পানিগুলোর নেয়া বিদেশী ঋণের ৬৮ শতাংশই স্বল্পমেয়াদি। আর বেসরকারি খাতে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি বিদেশী ঋণের উল্লেখযোগ্য অংশ বিদ্যুৎ ও জ¦ালানি খাতে নেয়া হয়েছে। বিদ্যুৎ খাতের ব্যবসায়ীরা ৪১০ কোটি ডলার ঋণ নিয়েছে। বিদ্যুৎ কোম্পানি ছাড়াও রপ্তানি আয় নেই এমন অনেক শিল্পোদ্যোক্তাও বিদেশী বিভিন্ন উৎস থেকে ঋণ নিয়েছে। কিন্তু ডলারের সঙ্কট ও দাম বেড়ে যাওয়ায় এখন ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে তারা ক্ষতির মুখে পড়ছে। আবার অনেক ব্যবসায়ী ক্ষতির অজুহাতে বিদেশী ঋণ পরিশোধে বিলম্ব করতে চাচ্ছে। এ অবস্থায় অফশোর ইউনিটের মাধ্যমে ঋণের অর্থ জোগানদাতা ব্যাংকগুলোও বিপদে পড়েছে। আর বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) মাধ্যমে সরাসরি বিদেশী ঋণ নিয়ে আসা কোম্পানিগুলোও যথাসময়ে কিস্তি পরিশোধ করা নিয়ে শঙ্কায় রয়েছে।
সূত্র জানায়, ব্যাংকগুলোর ডলারের চাহিদা আর জোগানের মধ্যে প্রতিদিনই থেকে যাচ্ছে বড় ঘাটতি। রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় থেকে সংগৃহীত ডলার দিয়ে ব্যাংকের আমদানি এলসি দায়ই পরিশোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। তার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের নেয়া বিদেশী ঋণের কিস্তি। বিদেশী ঋণ নেয়া অনেক ব্যবসায়ীই ব্যাংকের নিয়মিত কিস্তি পরিশোধ করছে না। তার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে ডলারে ঋণ পরিশোধের চাপ। বর্তমানে বিদ্যুৎসহ রপ্তানি আয় নেই এমন খাতের ব্যবসায়ীরা বিদেশী ঋণ নিয়ে সবচেয়ে বেশি বিপদে রয়েছে। কিছু ব্যবসায়ী মেয়াদ বাড়িয়ে ঋণ নিয়মিত রাখার চেষ্টা করছে। কেউ কেউ এক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিয়ে অন্য প্রতিষ্ঠানের ঋণ পরিশোধ করছে। তবে এভাবে দীর্ঘ সময় বিদেশী ঋণ নিয়মিত রাখা সম্ভব হবে না। বিদেশী ঋণ খেলাপি হলে দেশের পুরো ব্যাংক খাতেরই ভাবমূর্তি সঙ্কটে পড়বে। বেসরকারি খাতে ২ হাজার ৫৯৫ কোটি ডলার বিদেশী ঋণের মধ্যে ৮১০ কোটি ডলার দীর্ঘমেয়াদি। দীর্ঘমেয়াদি ঋণের পাশাপাশি ট্রেড ক্রেডিট হিসেবে বিদেশী বিভিন্ন উৎস থেকে ওই ঋণ নেয়া হয়েছে। আর বেসরকারি খাতে বিদেশী ঋণের ১ হাজার ৭৭৫ কোটি ডলারের মেয়াদ স্বল্প। ওই ঋণের মধ্যে ১ হাজার ১৯৬ কোটি ডলারের ধরন হলো ট্রেড ক্রেডিট। বায়ারস ক্রেডিট, ডেফারড পেমেন্ট, ব্যাক-টু-ব্যাক এলসি হিসেবে ওসব ঋণ নিয়েছে দেশের ব্যবসায়ীরা। তাছাড়া স্বল্পমেয়াদি ঋণ হিসেবে ৫০৩ কোটি ডলারের ঋণ বিদেশী উৎস থেকে নেয়া হয়েছে।
সূত্র আরো জানায়, অফশোর ইউনিটের মাধ্যমে দেশের বেসরকারি খাতে যেসব বিদেশী ঋণ এসেছে তার দায়ভার সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে বহন করতে হবে। কারণ গ্রাহকরা বিদেশী ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলেও তহবিল জোগানদাতা ব্যাংককে তা পরিশোধ করে দিতে হবে। অন্যথায় সংশ্লিষ্ট ব্যাংক আন্তর্জাতিক অঙ্গনে খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হবে। ওই কারণে বিদেশী তহবিল সংগ্রহ এবং তার যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোকে আরো বেশি সতর্ক হওয়া জরুরি ছিল। পাশাপাশি যথাসময়ে ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে গ্রাহকদেরও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করা প্রয়োজন। দেশের বেসরকারি খাতে দীর্ঘমেয়াদি বিদেশী ঋণের অর্ধেকই বিদ্যুৎ, গ্যাস ও জ¦ালানি তেল খাতে এসেছে। চলতি বছরের জুন পর্যন্ত দীর্ঘমেয়াদি বিদেশী ঋণের পরিমাণ ছিল ৮১৯ কোটি ডলার। তার মধ্যে বিদ্যুৎ ও জ¦ালানি খাতে দীর্ঘমেয়াদি বিদেশী ঋণ ৪৩৩ কোটি ডলার। তার বাইরে বিভিন্ন ধরনের উৎপাদনমুখী শিল্পে দীর্ঘমেয়াদি বিদেশী ঋণ এসেছে ১৪৬ কোটি ৬৫ লাখ ডলার। তাছাড়া নির্মাণ খাতে ৩০ কোটি ৪৩ লাখ ডলার, ট্রেড অ্যান্ড কমার্স খাতের জন্য ব্যাংক ও এনবিএফআইগুলোয় ১৬৫ কোটি, যানবাহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থায় ৪০ কোটি এবং সেবা খাতে ৩ কোটি ৮৫ লাখ ডলারের বিদেশী ঋণ এসেছে।
এদিকে অর্থনীতিবিদদের মতে, যে কোনো বিদেশী ঋণ যথাসময়ে পরিশোধে ব্যর্থতা দেশের জন্য বিপদ। বিদেশী ঋণ নেয়া কোম্পানিগুলো পরিশোধের মেয়াদ বাড়িয়ে পুনঃতফসিল করার চেষ্টা করছে। কিছু প্রতিষ্ঠান ঋণ পরিশোধের মেয়াদ বাড়িয়েও দিচ্ছে। তবে বিদেশী অনেক প্রতিষ্ঠানই বাংলাদেশে তাদের ঋণ পুনঃতফসিল করবে না। কারণ যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপের দেশগুলোয় সুদহার এখন ঊর্ধ্বমুখী। কোনো প্রতিষ্ঠান বিদেশী ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলে সেটি দেশের জন্য বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। গত এক বছর দেশের বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে অস্থিরতার কারণে ডলারের বিপরীতে টাকার প্রায় ২৫ শতাংশ অবমূল্যায়ন হয়েছে। ২০২১ সালের অক্টোবরে দেশে প্রতি ডলারের বিনিময় হার ছিল ৮৫ টাকা। আর এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঘোষিত দর ১০৫ টাকা ৬৬ পয়সা। যদিও দেশের খুচরা বাজারে ওই দরে ডলার মিলছে না। কার্ব মার্কেটে প্রতি ডলারের জন্য গুনতে হচ্ছে ১১৫ টাকারও বেশি। স্বল্প সময়ে টাকার অস্বাভাবিক এমন অবমূল্যায়নের ফলে বিদেশী উৎস থেকে ডলারে ঋণ নেয়া ব্যবসায়ীদের ক্ষতির পরিমাণ প্রতিনিয়ত বাড়ছে।
অন্যদিকে বিদ্যুৎ খাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, সরকার বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর বিল পরিশোধ করতে পারছে না। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) কাছে উদ্যোক্তাদের পাওনা বকেয়া বিলের পরিমাণ ১৭ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ডলার সংকট ও ডলারের বিনিময় হার বৃদ্ধি। ওই কারণে উদ্যোক্তারা চাইলেও যথাসময়ে বিদেশী ঋণ পরিশোধ করতে পারছেন না। বিদেশী ঋণ নিয়ে বিদ্যুৎ খাতের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো এখন বিব্রতকর পরিস্থিতিতে রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিআইপিপিএ) সভাপতি ইমরান করিম জানান, করোনার কারণে সঠিক সময়ে অনেক ঋণপত্রের (এলসি) দায় পরিশোধ করা সম্ভব হয়নি। ওই সময়ের অনেক এলসির মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। এক বছরের বেশি সময় ধরে দেশে ডলারের সঙ্কট চলছে। বাংলাদেশ ব্যাংক কিছু ডলারের জোগান দিলেও তা চাহিদার তুলনায় খুবই কম। এ কারণে উদ্যোক্তারা চাইলেও বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর নেয়া বিদেশী ঋণ সঠিক সময়ে পরিশোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। টাকার বিপরীতে ডলারের বিনিময় হারও গত এক বছরে অন্তত ২৫ শতাংশ বেড়েছে। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি বিদেশী ঋণ গ্রহণকারী ব্যবসায়ীদের অনুকূলে নেই।