নিজস্ব প্রতিবেদক :
গ্রামীণ টেলিকম থেকে চাকরিচ্যুত ১৫৭ কর্মচারীকে পাওনা ৪৩৭ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। গত রোববার গণমাধ্যমকে এ তথ্য জানান চাকরিচ্যুতদের আইনজীবী অ্যাডভোকেট ইউসুফ আলী। এ ছাড়া তিনি সাংবাদিকদের কিছু নথি দিয়েছেন। নথি থেকে জানা যায়, চাকরিচ্যুত কর্মচারীদের মধ্যে ২৬ জন পেয়েছেন ৪ কোটি ১০ লাখ ৮১ হাজার ৯১৭ টাকা। ৪৩ জন পেয়েছেন ৩ কোটি টাকার বেশি, ২৫ জন পেয়েছেন ২ কোটির টাকার বেশি, ১৯ জন পেয়েছেন এক কোটি টাকার বেশি ও এক কোটি টাকার নিচে পেয়েছেন ৪৪ জন চাকরিচ্যুত কর্মচারী। বাকি চারজন মারা যাওয়া ও চারজন দেশের বাইরে থাকায় টাকা পরিশোধ করা হয়নি। মামলা সমঝোতার জন্য নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মালিকানাধীন গ্রামীণ টেলিকম থেকে ১২ কোটি টাকা নেওয়ার অভিযোগ উঠে আইনজীবী ইউসুফ আলীর বিরুদ্ধে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন তিনি। গণমাধ্যমে কথা বলার সময় কত টাকা নিয়েছেন সেদিকে ইঙ্গিত করে বিষয়টি ‘পরোক্ষভাবে’ বোঝানোর চেষ্টা করেন তিনি। আইনজীবী ইউসুফ আলী বলেন, সমঝোতা করে নয়, মামলায় মুহাম্মদ ইউনূসকে পরাজিত করে চাকরিচ্যুত কর্মচারীদের ৪৩৭ কোটি টাকা আদায় করে দিয়েছি। সেখান থেকে মোটা অঙ্কের ফি ক্লায়েন্টরা আমাকে দিয়েছেন। তিনি বলেন, ১২ কোটি টাকার কথা যে বলা হচ্ছে, তা টোটালি একটি ইমাজিনারি ফিগার। তবে আমি বড় অঙ্কের ফি পেয়েছি। আমার ক্লায়েন্টরা বড় অঙ্কের টাকা পেয়েছেন, আমাকে বড় অঙ্কের ফি দিয়েছেন। ইউসুফ আলী বলেন, ক্লায়েন্টদের মধ্যে যারা তিন কোটি বা তার বেশি পেয়েছেন, তারা নিজেরা ঠিক করেছিলেন ১৫-২০ লাখ টাকা করে দেবেন। আমার ১০০ জন ক্লায়েন্ট তিন কোটি টাকার বেশি পেয়েছেন। এটা থেকে আপনারা ধারণা করতে পারেন আমি কত টাকা পেয়েছি। ক্লায়েন্টরা আমাকে হাসি মুখে ফি দিয়েছেন। তারা কারও কাছে অভিযোগ করেননি। হিসাব অনুযায়ী ১০০ জন ক্লায়েন্ট যদি ১৫ লাখ করে ফি দেন, তাহলে আইনজীবী ইউসুফ আলী পেয়েছেন ১৫ কোটি টাকা। ১০০ ক্লায়েন্ট ২০ লাখ টাকা করে ফি দিলে আইনজীবী ইউসুফ আলী পেয়েছেন ২০ কোটি টাকা। অন্যদিকে, মামলা সমঝোতার নামে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মালিকানাধীন গ্রামীণ টেলিকম থেকে ১২ কোটি টাকা নেওয়ার অভিযোগ উঠে আইনজীবী ইউসুফ আলীর বিরুদ্ধে। তবে আইনজীবী নিজে টাকার বিনিময়ে সমঝোতার এ অভিযোগকে ‘আষাঢ়ে গল্প’ বলে দাবি করেছেন। তিনি বলেন, আমি শ্রমিকদের পক্ষে গ্রামীণ টেলিকমের বিরুদ্ধে ২৩৯টি মামলা করেছি। আমি কত টাকা নিয়েছি, সেটি বলতে চাই না। আমার মক্কেলরা যা দিয়েছে সেটা ফি হিসেবে নিয়েছি। অথচ সকালে বাংলাদেশ ব্যাংকে খোঁজ নিয়ে দেখলাম আমার ছয়টি ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ করা হয়েছে। টাকার বিনিময়ে সমঝোতার অভিযোগ অস্বীকার করে ইউসুফ আলী বলেন, গ্রামীণ টেলিকম থেকে ১২ কোটি টাকা নিয়ে শ্রমিক-কর্মচারীদের বঞ্চিত করে মামলা প্রত্যাহার সংক্রান্ত যে তথ্য প্রচার করা হয়েছে, তা ভিত্তিহীন, বানোয়াট ও অসত্য। তিনি বলেন, আমরা তথাকথিত সামাজিক ব্যবসার ধ্বজাধারী সুদখোর ইউসূনকে ‘চুবানি’ খাইয়ে সুদে-আসলে গ্রামীণ টেলিকমের শ্রমিক বন্ধুদের প্রাপ্য ন্যায্য পাওনা আদায় করে দিয়েছি। এদিকে, ১২ কোটি টাকায় সমঝোতার বিষয়টি জেনে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন বিচারপতি মুহাম্মদ খুরশীদ আলম সরকারের হাইকোর্ট বেঞ্চ। আদালত বলেছেন, আমরা শুনেছি শ্রমিকদের আইনজীবীকে অর্থের বিনিময়ে হাত করে তাদের মামলায় আপোশ করতে বাধ্য করা হয়েছে। কোর্টকে ব্যবহার করে অনিয়ম যেন না হয়। যদি সবকিছু আইন অনুযায়ী না হয়, তবে বিষয়টি সিরিয়াসলি দেখা হবে। আমি চাই না কোর্ট এবং আইনজীবীর সততা নিয়ে কোনো প্রশ্ন ওঠুক। এদিন আদালতে গ্রামীণ টেলিকমের পক্ষে শুনানি করেন ব্যারিস্টার মোস্তাফিজুর রহমান খান। শ্রমিকদের পক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট ইউসুফ আলী। গত ৭ ফেব্রুয়ারি নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মালিকানাধীন গ্রামীণ টেলিকমের অবসায়ন চেয়ে হাইকোর্টে আবেদন করা হয়। গ্রামীণ টেলিকমের শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের পক্ষে এ আবেদন দায়ের করা হয়। তিনি বলেন, গ্রামীণ টেলিকমের কাছে শ্রমিকদের পাওনা আড়াইশ কোটি টাকার বেশি। এ পাওনা টাকার দাবিতে কোম্পানিটির অবসায়ন চাওয়া হয়েছে। মামলা সূত্রে জানা যায়, দীর্ঘদিন ধরে গ্রামীণ টেলিকমে শ্রমিক ছাঁটাইকে কেন্দ্র করে শ্রমিক অসন্তোষ চলে আসছে। শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়ন (বি-২১৯৪) সিবিএর সঙ্গে আলোচনা না করেই এক নোটিশে ৯৯ কর্মীকে ছাঁটাই করে গ্রামীণ টেলিকম কর্তৃপক্ষ। গ্রামীণ টেলিকমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আশরাফুল হাসান স্বাক্ষরিত এক নোটিশের মাধ্যমে এ ছাঁটাই করা হয়েছে। এরপর ওই নোটিশের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট করেন ২৮ জন কর্মী। এই ছাঁটাইকে কেন্দ্র করে ড. ইউনূসকে তলব করেছিলেন হাইকোর্ট। ২০২১ সালের ৪ এপ্রিল শ্রমিকদের পুনর্বহালের নির্দেশ দেন আদালত। এছাড়া গত বছরের ১২ সেপ্টেম্বর শ্রম আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে গ্রামীণ টেলিকমের চেয়ারম্যান ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ চারজনের বিরুদ্ধে মামলা করে ঢাকার কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান অধিদপ্তর। ঢাকার তৃতীয় শ্রম আদালতে এ মামলা করেন কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান অধিদপ্তরের শ্রম পরিদর্শক আরিফুজ্জামান। বিবাদীদের আদালতে হাজির হওয়ার জন্য সমন জারিও করেছিলেন আদালত। মামলার অন্য আসামিরা হলেন- গ্রামীণ টেলিকমের এমডি আশরাফুল হাসান, পরিচালক নুর জাহান বেগম ও শাহজাহান।