• বুধবার, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ০১:০৬ অপরাহ্ন
  • ই-পেপার

ট্রেড লাইসেন্স দিয়ে ট্রাভেল এজেন্সি, মানবপাচারের সিন্ডিকেট

Reporter Name / ১৪১ Time View
Update : সোমবার, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২২

নিজস্ব প্রতিবেদক :
এসএসসি পাস করে ২০১৭ সালে দুবাই যান তোফায়েল আহমেদ (২৮)। সেখানে ইন্ডাস্ট্রিয়াল এরিয়ায় তার বাবার হোটেলের ব্যবসা দেখাশোনা শুরু করেন। করোনা মহামারির সময় তিনি দুবাই থেকে দেশে ফিরে আসেন। ওই সময় উপার্জন না থাকায় পরিচিত দুবাই প্রবাসী জাহিদের মাধ্যমে মানবপাচারে জড়িয়ে পড়েন তোফায়েল। এজন্য তিনি তার নিজ বাড়ি কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম এলাকায় একটি ট্রাভেল এজেন্সি চালু করেন। তবে ওই এজেন্সির কোনো লাইসেন্স বা বৈধ কোনো অনুমোদন ছিল না। পরে তোফায়েল শুধু মাত্র সিটি করপোরেশন থেকে লাইসেন্স নিয়ে রাজধানীর গুলশান ও পল্টন এলাকায় গড়ে তোলেন মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে মানবপাচারকারী একটি সিন্ডিকেট। সেখানে বিদেশ গমনেচ্ছুক অসংখ্য ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেয় এ চক্রটি। সম্প্রতি ভুক্তভোগীদের অভিযোগের ভিত্তিতে গত ২৬ সেপ্টেম্বর ভোরে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম ও রাজধানীর গুলশান এলাকায় অভিযান চালিয়ে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে মানবপাচার চক্রের অন্যতম হোতা তোফায়েল, মো. আক্তার হোসেন (৩৮), মো. আনিছুর রহমান (৩৬) ও মো. রাসেলকে (৩০) আটক করে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)। অভিযানে তাদের কাছ থেকে ১৬টি পাসপোর্ট, তিনটি চেক বই, চারটি স্ট্যাম্প, পাঁচটি মোবাইল ফোন, চারটি বিএমইটি কার্ড, চারটি রেজিস্ট্রার উদ্ধার করা হয়। আজ সোমবার দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র‌্যাব-৩ এর অধিনায়ক (সিও) লেফটেন্যান্ট কর্নেল আরিফ মহিউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, ২০১৭ সালে তোফায়েল দুবাই গিয়ে তার বাবার হোটেল ব্যবসায় সহায়তা করতে থাকেন। করোনা মহামারি শুরু হলে তিনি বাংলাদেশে ফিরে আসেন। ওই সময় তার কোনো উপার্জন না থাকায় তিনি কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম এলাকায় লাইসেন্স ছাড়াই একটি ট্রাভেল এজেন্সি চালু করেন। এদিকে মানবপাচারকারী দুবাই প্রবাসী জাহিদ সঙ্গে তোফায়েলের পরিচয় হয়। পরে জাহিদের মাধ্যমে আনিছুর এবং আক্তারের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। তাদের মাধ্যমেই রাসেলসহ অন্যান্য দালালদের সঙ্গে তোফায়েলের পরিচয় হয়। জাহিদ দুবাই থেকে ভ্রমণ ভিসা তৈরিতে এ চক্রকে সহায়তা করে থাকেন। এদিকে তোফায়েল নিয়মিত দুবাই আসা-যাওয়া করতেন। সর্বশেষ চলতি বছরের আগস্ট মাসে তিনি দুবাই গিয়ে সেপ্টেম্বর মাসে আবার দেশে ফিরে আসেন। তিনি বলেন, প্রাথমিক অনুসন্ধান ও আটক আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, চক্রের মূলহোতা দুবাই প্রবাসী তোফায়েল এবং বাংলাদেশে এ চক্রের অন্যতম হোতা আনিছুর ও আক্তার। এছাড়াও রাসেল হচ্ছে তাদের অন্যতম সহযোগী। তারা বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন দালালের মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে উচ্চ বেতনে বিভিন্ন কোম্পানিতে চাকরি দেওয়ার নাম করে ভুক্তভোগীদের এবং তাদের অভিভাবকদের প্রলুব্ধ করেন। মধ্যপ্রাচ্যে পাঠানোর খরচ বাবদ প্রাথমিকভাবে চক্রটি চার থেকে পাঁচ লাখ টাকা নিয়ে থাকে। এছাড়াও ইউরোপ ও এশিয়ার অন্যান্য দেশে পাঠানোর জন্য তারা ছয় থেকে আট লাখ টাকা নিয়ে থাকেন। অধিনায়ক (সিও) লেফটেন্যান্ট কর্নেল আরিফ বলেন, এ চক্রের প্রলোভনে ভুক্তভোগী এবং তাদের অভিভাবকরা রাজি হলে প্রথমে তারা পাসপোর্ট এবং প্রাথমিক খরচ বাবদ ৫০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা নিয়ে নেন। তারপর ভুক্তভোগী এবং অভিভাবকদের বিদেশ থেকে বিভিন্ন দালালের মাধ্যমে ফোন কল দিয়ে ভালো আছে বলে তাদের আশ্বস্ত করা হতো। এতে ভুক্তভোগী ও তাদের পরিবারের সদস্যরা আরও বেশি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে পরিবহন খরচ, ভিসা খরচ, মেডিকেল খরচ, বিএমইটি ক্লিয়ারেন্স ইত্যাদি খরচের কথা বলে চক্রটি ধাপে ধাপে ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে টাকা আত্মসাৎ করতে থাকেন। এরপর বিদেশে ফ্লাইটের দিন বিমানবন্দরে প্রবেশ গেইটে ভুক্তভোগীদের কাছে তাদের পাসপোর্ট, ভিসা এবং টিকিট হস্তান্তর করা হয়। বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশনে যাওয়ার পর ভুক্তভোগীরা বুঝতে পারেন তাকে ভ্রমণ ভিসায় বিদেশ পাঠানো হচ্ছে। তখন আসামিদের সঙ্গে ফোন কলে যোগাযোগ করা ছাড়া ভুক্তভোগীদের কিছুই করার থাকে না। আসামিরা তখন আশ্বস্ত করে বিদেশ যাওয়ার পর তাদের ওয়ার্কিং ভিসা করে দেওয়া হবে। তিনি বলেন, দুবাই বা সম্ভাব্য দেশে পৌঁছানোর দুবাই প্রবাসী জাহিদ ভুক্তভোগীদের স্বাগত জানিয়ে একটি অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যান। তারপর ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে তার পাসপোর্ট এবং নগদ অর্থ ছিনিয়ে নেওয়া হয়। তারপর তাদের একটি সাজানো কোম্পানিতে চাকরি দেওয়া হয়। চার থেকে পাঁচ দিন পর ওই কোম্পানি থেকে তাদের জানিয়ে দেওয়া হয় আইনি জটিলতার কারণে কোম্পানি বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। পরে জাহিদ পুনরায় ভুক্তভোগীদের অজ্ঞাত স্থানে বন্দি করে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করে অর্থ আদায় করেন। এ সময়ে ভুক্তভোগীদের কোনো খাবার দেওয়া হয় না। খাবার চাইলে জাহিদ বাংলাদেশ থেকে টাকা নিয়ে এসে খাবার কিনতে বলেন। এ সময়ে তোফায়েলের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তোফায়েল ভুক্তভোগীদের অপেক্ষা করতে বলেন। তিনি জানান আইনি জটিলতা দূর হলেই আবার কোম্পানি চালু হবে। তখন তারা বেতন ও কাজের সুযোগ পাবেন। ওই সময়ে ভিকটিমরা নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে অনেকে নিজেদের চেষ্টায় টিকিট জোগাড় করে দেশে আশার চেষ্টা করেন। তখন জাহিদের কাছে পাসপোর্ট ফেরত নিতে হলে ভুক্তভোগীকে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা পরিশোধ করতে হয়। সিও লেফটেন্যান্ট কর্নেল আরিফ বলেন, আটক আসামিদের ট্রাভেল এজেন্সি বা রিক্রুটিং এজেন্সি পরিচালনার কোনো লাইসেন্স নেই। তারা শুধুমাত্র সিটি করপোরেশন থেকে ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে সিটি এক্সপ্রেস ট্রাভেল এজেন্সি নামে মানবপাচার ব্যবসা করে আসছিল। স্বল্প সময়ে, বিনাশ্রমে অধিক লাভ বা অর্থ উপার্জনই তাদের একমাত্র লক্ষ্য ছিল। আটক আক্তার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একটি কলেজ থেকে মানবিক বিভাগে স্নাতক পাস করেছে। তিনি কিছুদিন বনানী এলাকায় একটি কাপড়ের দোকানে ম্যানেজার হিসেবে কাজ করে। পরে স্বল্প শ্রমে অধিক অর্থ উপার্জনের আশায় তিনি মানবপাচারকে পেশা হিসেবে বেছে নেন। আনিছুর ও আক্তার একই এলাকার হওয়ায় তাদের মধ্যে সখ্যতা গড়ে ওঠে। প্রথমে তারা পৃথকভাবে মানবপাচারে জড়িত থাকলেও ২০২১ সালের ডিসেম্বর থেকে তারা সিটি এক্সপ্রেস ট্রাভেল এজেন্সি নামে একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেন। এজন্য তারা প্রতারণার উদ্দেশে গুলশানের একটি অভিজাত এলাকায় একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে সুসজ্জিত অফিস চালু করে বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকান স্থানীয় দালাল নিযুক্ত করেন এবং বিভিন্ন এজেন্সির সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তোলে মানবপাচারের কাজে লিপ্ত হন। এ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান আক্তার ও ম্যানেজিং ডিরেক্টর আনিছুর। এদিকে আনিছুর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একটি কলেজ থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক সম্মান পাস করেছেন। তিনি কিছুদিন রাজধানীর একটি স্কুলে শিক্ষকতা করেছেন। স্বল্প শ্রমে অধিক অর্থ উপার্জনের আশায় তিনি মানবপাচারকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন। তার মধ্যপ্রাচ্যসহ ইউরোপ ও এশিয়ার কিছু দেশে প্রবাসী বন্ধু রয়েছেন। তাদের মাধ্যমে তিনি ভুয়া ডিমান্ড লেটার, ইনভাইটেশন ও ওয়ার্ক পারমিট সংগ্রহ করে বিভিন্ন দেশে মানবপাচার করে থাকেন। এছাড়াও এসব প্রবাসী দালালরা ভুক্তভোগী ও অভিভাবকদের বিদেশ থেকে ফোন কল উত্তম জীবনের নিশ্চয়তা দিয়ে প্রতারণায় আনিছুরকে সহায়তা করে থাকে। রাসেল কুমিল্লার একটি কলেজ থেকে অর্থনীতিতে মাস্টার্স পাস করেছেন। বিগত দুই বছর ধরে তিনি এ চক্রের অন্যতম সহযোগী হিসেবে কাজ করেছেন। আক্তার ও আনিছুর তার বিশ্বস্থতার পুরস্কার হিসেবে তাকে তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সিটি এক্সপ্রেস ট্রাভেল এজেন্সির ম্যানেজার হিসেবে নিযুক্ত করেন। এছাড়াও দুবাই প্রবাসী জাহিদের তিনি গৃহ শিক্ষক ছিলেন। জাহিদ ও রাসেলের নিজ বাড়ি কুমিল্লা এলাকায় হওয়ায় তাদের মধ্যে সখ্যতাও ছিল। আটক আসামিদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলেও জানান র‌্যাবের সিও লেফটেন্যান্ট কর্নেল আরিফ।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category