• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ০৮:১৩ পূর্বাহ্ন

দেশে খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতি বেড়েছে

Reporter Name / ১১৪ Time View
Update : মঙ্গলবার, ২৮ ডিসেম্বর, ২০২১

নিজস্ব প্রতিবেদক :
দেশের বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রায় সব পণ্যের দাম প্রতিনিয়ত বেড়েই চলছে। চাল, ডাল, তেল থেকে শুরু করে সবজি, সব কিছুর দামই উঠতি। এ অবস্থা যে শুধুমাত্র ঢাকা শহরে, তাও নয়। গ্রামেও সেই একই চিত্র। প্রতিনিয়ত নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়লেও বাড়ছে না মানুষের আয়। সেই সঙ্গে অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে পরিবহন ব্যয়।
দেশে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার প্রবণতার ফলে সার্বিক মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। পাশাপাশি বেড়েছে খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রকাশিত প্রতিবেদনের তথ্যানুসারে, দেশে সর্বশেষ নভেম্বর মাসে গড় মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৫ দশমিক ৯৮ শতাংশে হয়েছে। এটি অক্টোবর মাসেও ৫ দশমিক ৭০ শতাংশ ছিল। এদিকে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৫ দশমিক ৯ শতাংশ হয়েছে, যা অক্টোবর মাসে ৫ দশমিক ৬২ শতাংশ। এবং খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৬ দশমিক ৭৮ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, যা অক্টোবর মাসে ৬ দশমিক ১৭ শতাংশ ছিল।
চলতি অর্থবছর ২০২১-২২ এর সরকারের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় মূল্যস্ফীতি ওপরে অবস্থান করছে। চলতি অর্থবছরের বাজেটে মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৩ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছিল।
অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, নভেম্বরের শুরুতে সরকার ডিজেল ও কেরোসিনের দাম প্রতি লিটারে ১৫ টাকা বাড়ানোর কারণে ভোক্তাপর্যায়ে পণ্য দুটির দাম ৬৫ টাকা থেকে এক লাফে ৮০ টাকায় ওঠে। এর জেরে সব পরিবহনের ভাড়া বেড়েছে। এর প্রভাব পড়েছে মূল্যস্ফীতিতে।
বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, নভেম্বরে গ্রামে সার্বিক মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৬ দশমিক ২০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, যা আগের মাসে ছিল ৫ দশমিক ৮১ শতাংশ। খাদ্য মূল্যস্ফীতি আগের মাসের ৫ দশমিক ৬২ শতাংশ থেকে বেড়ে ৫ দশমিক ৯০ শতাংশ হয়েছে। খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৭৮ শতাংশে উঠেছে, যা আগের মাসে ছিল ৬ দশমিক ১৭ শতাংশ।
অন্যদিকে শহরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি আগের মাসের ৫ দশমিক ৫০ শতাংশ থেকে বেড়ে ৫ দশমিক ৫৯ শতাংশ হয়েছে। খাদ্য মূল্যস্ফীতি ৪ দশমিক ৩৭ শতাংশে উঠেছে, যা আগের মাসে ছিল ৪ দশমিক ৩১ শতাংশ। আর খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি আগের মাসের ৬ দশমিক ৮৯ শতাংশ থেকে ৬ দশমিক ৯৯ শতাংশ উন্নীত হয়েছে।
সূত্র জানায়, চলতি বছরের এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ছয় মাসের সময়ে জাতীয় গড় মূল্যস্ফীতি ৫-৬ শতাংশের মধ্যেই ওঠানামা করেছে। যদিও এ সময় দানাদার খাদ্যশস্য, বিশেষ করে চালের মূল্যস্ফীতির হার প্রায় সাড়ে ১২ থেকে শুরু হয়ে ১৫ শতাংশও ছাড়িয়েছে। স্বল্প আয়ের মানুষের চাল ভোগের পরিমাণ মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তের চেয়ে অনেক বেশি। সে হিসেবে চালের দাম বাড়লে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হয় দরিদ্ররাই। যদিও বাজারের বড় প্রভাবকদের মধ্যে প্রায়ই নানা পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে পণ্যটির মূল্য অস্থিতিশীল করে তোলার প্রবণতা দেখা যায়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ছয় মাসে জাতীয় মূল্যস্ফীতির চেয়ে চালের মূল্যস্ফীতি ছিল দ্বিগুণেরও বেশি। কখনো কখনো তা তিন গুণের কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে গড় মূল্যস্ফীতির হার সর্বোচ্চে উঠেছিল জুনে। খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতির চাপের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী জুনে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি হয়েছে ডালজাতীয় শস্যে, যার পরিমাণ ২৯.৩ শতাংশ। মসলাজাতীয় শস্যে মূল্যস্ফীতি ছিল ১৮.৬ শতাংশ। চালের পাশাপাশি মূল্যস্ফীতি হয়েছে দানাদার খাদ্যশস্যে। সেখানে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ১২.৩০ শতাংশ। এ ছাড়া খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মধ্যে বাড়িভাড়া ও জ¦ালানির ক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতি ছিল ৭ শতাংশ।
এটি স্পষ্ট যে, গড় মূল্যস্ফীতি বাড়লে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাবে, সে ক্ষেত্রে যারা সামর্থ্যবান আছে তারা পণ্য ক্রয় কত করবে, আবার যারা দরিদ্র তারা আরো দরিদ্র হবে। আর বাজারে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বাড়লে প্রান্তিক পর্যায়ে কিন্তু কৃষকরা লাভবান হন না। লাভবান হচ্ছেন মধ্যস্বত্বভোগীরা। কৃষক তথা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য দরকার খাদ্য প্রণোদনা।
দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে চালনির্ভরতা আয়ভিত্তিক অন্যান্য শ্রেণীর চেয়ে অনেক বেশি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ খানা আয়-ব্যয় জরিপে উঠে এসেছে, দেশে খানাপিছু গড় মাসিক আয় ১৫ হাজার ৯৪৫ টাকা। এর মধ্যে প্রায় ৪৮ শতাংশই যায় খাদ্য কেনায়। দরিদ্র ও প্রান্তিক পরিবারগুলোর ক্ষেত্রে মাসিক মোট আয়ের প্রায় ৭০ শতাংশ পর্যন্ত ব্যয় হয় খাদ্যের পেছনে। আবার এ জনগোষ্ঠীর চাল ভোগের পরিমাণও অন্যান্যের চেয়ে বেশি। দেশে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর চালের মাথাপিছু দৈনিক ভোগ ৪৭০ গ্রাম, যেখানে অন্যান্যের ক্ষেত্রে তা ৩৬৬ গ্রাম। প্রধান খাদ্যশস্যটির মূল্যস্ফীতির বোঝাও আবার তাদের জন্যই সবচেয়ে ভারী হয়ে দেখা দেয় বলে বিভিন্ন পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে।
চালের মূল্যস্ফীতিকে দরিদ্র ও নাজুক জনগোষ্ঠীর প্রকৃত আয় কমে যাওয়ারই নামান্তর বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। বিভিন্ন পরিসংখ্যান পর্যালোচনার ভিত্তিতে তারা বলছেন, চাল ও দানাদার খাদ্যশস্যের দাম বাড়লে দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষই সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হয়। খাদ্য ব্যয় বাড়লে তা নির্বাহের পর অবশিষ্ট টাকা দিয়ে অন্যান্য খরচ মেটাতে তাদের হিমশিম খেতে হয়। বিপন্ন হয় পুষ্টিনিরাপত্তা, শিক্ষা, চিকিৎসাসহ মৌলিক অন্যান্য প্রয়োজনীয়তা নিশ্চিতের বিষয়টিও।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) ‘বাংলাদেশ ফুড মার্কেট পারফরম্যান্স: ইনস্ট্যাবিলিটি, ইন্টিগ্রেশন অ্যান্ড ইনস্টিটিউশনস’ শীর্ষক সাম্প্রতিক এক গবেষণা প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, খাদ্যমূল্যস্ফীতি বাড়লে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় দরিদ্র ও হতদরিদ্র পরিবারগুলো। ৭০ শতাংশের বেশি হতদরিদ্র পরিবার তখন চালের ভোগ কমিয়ে দেয়। শুধু দরিদ্রদের বেলায় এ হার ৬৬ শতাংশ। দরিদ্র ও অতিদরিদ্রের বাইরে মধ্যবিত্তরাও খাদ্যমূল্যস্ফীতি দিয়ে প্রভাবিত হয়। এ শ্রেণীর প্রায় ২৪ শতাংশ পরিবার ভোগ কমিয়ে দেয়। কারণ পরিবারের অন্যান্য ব্যয় মেটাতে হিমশিম খেতে হয় তাদের। আবার খাদ্যচাহিদা মেটাতে গিয়ে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যয়ে পিছিয়ে পড়ে তারা। দরিদ্র বা অতিদরিদ্র শ্রেণীর পরিবারগুলো তাদের উপার্জনের ৫০-৭০ শতাংশ ব্যয় করে খাদ্য বাবদ। এর আবার সিংহভাগ ব্যয় হয় চাল কেনায়। ফলে চালের দাম বাড়লে বাধ্য হয়ে এ শ্রেণীর মানুষ ভোগ কমিয়ে দেয়। এর প্রভাব পড়ে দৈনন্দিন পুষ্টিচাহিদায়। এতে একদিকে পুষ্টিহীনতায় ভোগা পরিবারের সংখ্যা বাড়ে, অন্যদিকে দেশের বড় একটি জনগোষ্ঠীকে দারিদ্র্য থেকে বের করে আনা সম্ভব হয় না।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category