নিজস্ব প্রতিবেদক :
সড়ক, নৌ ও আকাশÑ এই তিনটি পথেই বিশে^র বিভিন্ন দেশ থেকে পণ্য আমদানি ও অনেক দেশে রপ্তানি করে বাংলাদেশ। তবে আমদানি-রপ্তানি উভয় খাতেই পণ্য পরিবহনের ব্যয় বেড়েছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, সমুদ্র, আকাশ ও সড়কপথে যথাক্রমে জাহাজ, উড়োজাহাজ ও ট্রাক-টেলরের ভাড়া এবং কনটেইনার, স্ক্যানার, হ্যান্ডলিংসহ বন্দরের আনুষঙ্গিক চার্জসহ সার্বিকভাবে পরিবহন খরচ আগের চেয়ে কয়েক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে রপ্তানিমুখী ব্যবসায়ীদের মুনাফায় টান পড়েছে। তা সত্ত্বেও বিদেশি ক্রেতা ধরে রাখার স্বার্থে অনেক রপ্তানিকারক কম মুনাফা করছেন এবং কেউ কেউ লোকসানের মুখেও পড়ছেন। জানা গেছে, সড়কে যাওয়া পণ্যগুলোর গন্তব্য কম দূরত্বের দেশগুলো। উড়োজাহাজে বেশি যাচ্ছে পচনশীল পণ্য। কিন্তু রপ্তানির সবচেয়ে বড় কারবার হচ্ছে জাহাজের মাধ্যমে। বিশ্বের প্রায় ১৪০টি দেশে পণ্য যাচ্ছে নৌপথে। বর্তমানে এ তিন পথেরই বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে বাড়তি ভাড়া। উড়োজাহাজ বা জাহাজের মতো উচ্চ না হলেও করোনার ধাক্কায় সড়কপথে পণ্য রপ্তানিতেও খরচ বেড়েছে। জানা গেছে, দেশের শতাধিক প্রতিষ্ঠান এখন ভারত, নেপাল ও ভুটানÑএই তিন দেশে পণ্য রপ্তানি করছে। যার মধ্যে ডজনখানেক বড় শিল্পগ্রুপ। এই তিন দেশে মাসে কয়েক লাখ টন পণ্য রপ্তানি হচ্ছে। যার প্রায় ৯০ শতাংশ যাচ্ছে সড়কে। এসব পণ্যের মধ্যে সবচেয়ে বেশি যাচ্ছে ভারতে। ওই দেশে পণ্য রপ্তানির অঙ্ক দেড় বিলিয়নের মাইলফলক ছোঁয়ার পথে হাঁটছে। রপ্তানি পণ্যের মধ্যে রয়েছে তৈরি পোশাক, প্লাস্টিক, সয়াবিন তেল, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, ইস্পাত, চামড়াজাত পণ্য, পাট ও পাটের সুতা, মাছ ইত্যাদি। তবে রপ্তানিকারকদের অভিযোগ, বাংলাদেশি কোম্পানিগুলোর পণ্য রপ্তানির পথ মসৃণ নয়। স্থলবন্দর দিয়ে পণ্য নানা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রপ্তানি হয়ে থাকে। আবার ভারতের সড়ক ব্যবহার করে নেপাল ও ভুটানে পণ্য রপ্তানিতে সহযোগিতা মেলে কম। এজন্য খরচের পরিমাণ অনেক বেড়ে যায়। এ ছাড়া ভারতে পণ্য খালাসেও সময় লাগে অনেক বেশি। রপ্তানিকারকরা জানান, বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে মিউচুয়াল রিকগনিশন অ্যাগ্রিমেন্ট না থাকায় অনেক সময় বন্দরে পণ্যের মান সনদ নিতে ভোগান্তি পোহাতে হয় রপ্তানিকারকদের। দীর্ঘক্ষণ পণ্যের চালান বন্দরে পড়ে থাকে। এ ছাড়া বিভিন্ন গুদামে সঠিক ব্যবস্থাপনা না থাকায় অনেক সময় পণ্য নষ্ট হয়ে যায়। এদিকে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পণ্য পরিবহনে সবচেয়ে বেশি খরচ হয় আকাশপথে। তারপরও সবচেয়ে দ্রুততম পথ হওয়ায় প্লেনে যায় বেশিরভাগ পচনশীল পণ্য। এ ছাড়া যায় গার্মেন্টস পণ্যও। কিন্তু বাংলাদেশের তুলনায় পার্শ্ববর্তী দেশের প্লেনভাড়া কম। এ কারণে ভারত ও পাকিস্তানের রপ্তানিকারকরা কম খরচে পণ্য পৌঁছাতে পারেন বিদেশে। অন্যদিকে পরিবহন খরচ বেশি হওয়ায় প্রতিযোগীদের সঙ্গে পেরে উঠছেন না বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা। ফলে চড়া দামের কারণে ক্রেতা হারাচ্ছেন তারা। বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের প্লেনভাড়ার চিত্র উঠে এসেছে সরকারের শাক-সবজি, ফলমূল ও কৃষি প্রক্রিয়াকরণ পণ্য রপ্তানি বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রস্তুত রোডম্যাপেও। সেখানে দেখানো হয়েছে, বর্তমানে প্লেনে বাংলাদেশ থেকে ইউরোপ পর্যন্ত পণ্য পাঠাতে খরচ হয় কেজিপ্রতি ৩ দশমিক ৩ থেকে ৩ দশমিক ৬ ডলার পর্যন্ত। যেখানে ভারতের কলকাতা থেকে একই গন্তব্যে সমপরিমাণ পণ্য পাঠাতে খরচ হয় ২ দশমিক ৮ ডলার থেকে সর্বোচ্চ ৩ ডলার। পাকিস্তান থেকে রপ্তানিতে এ খরচ আরও কম, যা ২ দশমিক ৪ ডলার থেকে আড়াই ডলার পর্যন্ত। অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্যে প্লেনভাড়ায় উল্লেখযোগ্য তারতম্য রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্য পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে কেজিপ্রতি পণ্যের প্লেনভাড়া গড়ে দেড় ডলার, যা পাকিস্তান থেকে মাত্র দশমিক ৪০ ডলার। অবশ্য একই গন্তব্যে ভারত থেকে কেজিপ্রতি পণ্যের প্লেনভাড়া ১ দশমিক ৮২ থেকে ১ দশমিক ৯১ ডলার পর্যন্ত। এছাড়া বাহরাইন, ওমান, মালয়েশিয়া, সুইডেন, কানাডা, জার্মানিসহ বিভিন্ন দেশেও এসব খাদ্যপণ্য রপ্তানি হয়। সবজি ও ফলের পাশাপাশি দু-তিন ধরনের মাছও রপ্তানি হয় এসব দেশে। এ ছাড়া দ্রুততম সময়ে পৌঁছানোর জন্য গার্মেন্টস পণ্যও যাচ্ছে একই গন্তব্যে। বাড়তি ভাড়ার কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন কৃষিপণ্য রপ্তানিকারকরা। কারণ সবজির বিশ্ববাজারে বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের পণ্যগুলোর ধরন একই। তিন দেশের রপ্তানির গন্তব্যও একই। কিন্তু ভারত-পাকিস্তানের ভাড়া ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বেশি হওয়ার কারণে বিদেশি ক্রেতারা তাদের থেকেই পণ্য কিনছেন বেশি। সম্ভাবনা সত্ত্বেও পিছিয়ে পড়ছেন বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা। এদিকে সড়ক ও আকাশ পথের চেয়ে সমুদ্রপথে দেশের সিংহভাগ আমদানি-রপ্তানি পণ্য আনা-নেওয়া হলেও সেখানেও বেড়েছে ব্যয়। বিশ্বের প্রায় ১৪০টি দেশে পণ্য যাচ্ছে নৌপথে। দেশের বেশিরভাগ পণ্য চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর দিয়ে আনা-নেওয়া করা হয়। আমদানি-রপ্তানিকারকেরা জানান, সাধারণত ২০ ফুট দৈর্ঘ্যরে প্রতিটি কনটেইনারবোঝাই পণ্য করোনার আগে ইউরোপে নিতে খরচ পড়ত বড়জোর দেড় হাজার ডলার। এখন এই খরচ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০-১২ হাজার ডলার। আর ৪০ ফুট দৈর্ঘ্যরে প্রতিটি কনটেইনার পণ্য বোঝাই করে ইউরোপে নিতে আগে খরচ হতো দুই থেকে আড়াই হাজার ডলার। এখন খরচ হয় ২০ থেকে ২৫ হাজার ডলার। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডাসহ উত্তর আমেরিকায় ২০ ফুট দৈর্ঘ্যরে এক কনটেইনার পণ্য পাঠাতে খরচ পড়ত বড়জোর দুই হাজার ডলার। এখন খরচ হয় ২০-২৫ হাজার ডলার। অন্য দিকে ৪০ ফুট দৈর্ঘ্যরে এক কনটেইনার পণ্য পাঠাতে খরচ হতো আড়াই থেকে তিন হাজার ডলার। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার ডলার। জানা গেছে, জাহাজ কোম্পানিগুলো করোনার কারণে খরচ কমাতে তাদের সব জাহাজ চালাচ্ছে না। অর্ধেক বা এর চেয়ে কম সংখ্যায় জাহাজ পরিচালনা করছে। ফলে চাহিদার তুলনায় জাহাজ কম থাকায় ভাড়া বেড়েছে। আবার জাহাজ কম চলায় কনটেইনার-সংকট দেখা দিয়েছে। কারণ, বিভিন্ন দেশ থেকে সেভাবে কনটেইনার আসছে না। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনা-পরবর্তী সময়ে অন্যান্য দেশেও ভাড়া বেড়েছে। কিন্তু তারা বিকল্প নানা ব্যবস্থা করে কম খরচে পণ্য রপ্তানি করছে। অন্যদিকে বাংলাদেশে সে রকম কোনো সুযোগ-সুবিধা না থাকায় ক্রেতা হারাতে হচ্ছে।