নিজস্ব প্রতিবেদক :
তরতর করে জ¦ালানি তেলের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। জ¦ালানি তেলের দাম হ্রাসের দাবিতে পরিবহন মালিক ও শ্রমিকদের অঘোষিত ধর্মঘটে শুক্রবার থেকে দেশের প্রায় সর্বত্র পণ্য ও যাত্রীবাহী যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। রাজধানী ঢাকায় সকাল থেকে বিআরটিসির কিছু বাস ছাড়া সড়কে যাত্রীবাহী বাস চলাচল করতে দেখা যায়নি। রাজধানী থেকে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের উদ্দেশে কোনো দূরপাল্লাহর যাত্রীবাহী বাস ছেড়ে যায়নি। দেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকেও কোনো বাস রাজধানীতে প্রবেশ করেনি। গণপরিবহনের পাশাপাশি বন্ধ রয়েছে পণ্যবাহী গাড়িগুলোও। এতে গোটা দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা হয়ে পড়েছে অচল। এ কারণে ভোগান্তিতে পড়েছেন সাধারণ কর্মজীবী মানুষ।
সূত্র জানায়, সরকার ডিজেল ও কেরোসিনের দাম বাড়ানোর পর ভাড়া বাড়ানোর দাবিতে শুক্রবার থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য গণপরিবহন ও পণ্যবাহী যানবাহন বন্ধ রাখার ঘোষণা দেন মালিক ও শ্রমিকরা। অঘোষিত পরিবহন ধর্মঘটের প্রথম দিনে কার্যত অচল হয়ে পড়ে দেশ। পথে পথে ছিল দুর্ভোগ। শিশু ও বয়স্কদের পড়তে হয় সবচেয়ে খারাপ অবস্থায়। ভর্তি ও চাকরির নিয়োগ পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারীরা পড়েছেন আরও বিপাকে। কয়েক গুণ ভাড়া দিয়ে বিকল্প উপায়ে তারা কেন্দ্রে পৌঁছেন।
জ¦ালানি মন্ত্রণালয় এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বুধবার রাতে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম বাড়ানোর বিষয়টি জানায়। লিটারে ১৫ টাকা বাড়ানোর ঘোষণা আসে। রাতেই তা কার্যকর হয়। এর ফলে ডিজেল ও কেরোসিন তেলের নতুন দর হয় প্রতি লিটার ৮০ টাকা; যা এতদিন ছিল ৬৫ টাকা।
ডিজেল ও কেরোসিনের এই অকস্মাৎ মূল্যবৃদ্ধিতে বহুমুখী সমস্যার উদ্ভব হতে চলেছে। এতে জীবনযাত্রার ব্যয় ও পরিবহন ভাড়া বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে প্রকট। ট্রাক, বাসসহ পরিবহনের জ¦ালানি হিসেবেই ডিজেলের ব্যবহার সবচেয়ে বেশি। সংশ্নিষ্টরা বলছেন, ট্রাক ভাড়া বাড়লে পণ্য পরিবহনের খরচ বেড়ে যাবে। দাম বাড়বে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের। চাপ পড়বে সীমিত আয়ের মানুষের ওপর।
জানা যায়, জ¦ালানি তেলের দাম বৃদ্ধি নিয়ে মালিক-শ্রমিকদের সঙ্গে রোববার বৈঠকে বসছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। ওই বৈঠকে ভাড়া বাড়ানোর ঘোষণা না আসা পর্যন্ত পরিবহণ খাতের এ অচলাবস্থার নিরসন হবে না বলে জানিয়েছেন পরিবহণ সংশ্লিষ্টরা। যদিও সরকারের তরফ থেকে শুক্রবার পরিবহণ ধর্মঘট প্রত্যাহারের আহ্বান জানানো হয়েছে। ওই আহ্বানে সাড়া না দিয়ে ধর্মঘট অব্যাহত রেখেছেন পরিবহণ সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে যানবাহনের অচলাবস্থার সুযোগ নিয়ে রিকশা এবং সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালকরা কয়েক গুণ বেশি ভাড়া আদায় করছেন। সিএনজিচালিত অটোরিকশায় যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তা থেকে মহাখালী আসতে একজন যাত্রীকে ভাড়া গুনতে হচ্ছে ৪০০ টাকা। স্বাভাবিক সময়ে এই পথের ভাড়া সর্বোচ্চ ২০০ টাকা। তেজগাঁও থেকে মগবাজারের দিলু রোডে যেতে রিকশা ভাড়া দাবি করা হচ্ছে ১৫০ টাকা। অথচ অন্য সময়ে এ পথের ভাড়া সর্বোচ্চ ৮০ টাকা।
সূত্র জানায়, অঘোষিত ধর্মঘটের কারণে দেশের বিভাগীয় ও জেলা শহরগুলোতে পরিবহন চলেনি। বন্দরনগরী চট্টগ্রামে বাস-ট্রাক-লরি চলাচল করতে দেখা যায়নি। তবে শহরে অটোরিকশা চলাচল করতে দেখা গেছে। বরিশাল শহরের রূপাতলী ও নথুল্লাবাদ বাস টার্মিনাল থেকে ভোর থেকে বাস চলাচল করতে দেখা যায়নি। অলসভাবে পড়ে থাকতে দেখা গেছে পণ্য পরিবহনের ট্রাক লরিকে। রাজশাহী শহর থেকে যাত্রী ও পণ্য পরিবহন প্রায় বন্ধ করে রেখেছে মালিক ও শ্রমিকরা। কিছু ট্রাক শহরে আসলেও শহর থেকে বাস-ট্রাক সব চলাচল বন্ধ আছে। খুলনা থেকে যে ২২টি রুটে বাস চলাচল করে সেগুলোতেও ভোর থেকে বাস চলাচল বন্ধ আছে। এ ছাড়া সিলেট, কুমিল্লা, বগুড়া, গাজীপুর, রংপুর, ময়মনসিংহ ও চাঁদপুরসহ আরো কয়েকটি এলাকা থেকে একই খবর পাওয়া গেছে।
অকস্মাৎ যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেওয়ায় ক্ষোভ ঝরেছে পথে নেমে নাকাল হওয়া সাধারণ মানুষের কণ্ঠে। তবে যেখানে ভয়াবহ যানজটের রাজধানীতে ছিল না যানজট, ছিল না একটি বাসের সঙ্গে অন্য বাসের অসুস্থ প্রতিযোগিতা। ট্রাফিক সিগন্যালগুলোতে ছিল না বাস, যানবাহনের দীর্ঘ সারি, বাসের হেলপারের চিরচেনা হাঁকডাকও শোনা যায়নি। রাজধানীর রাস্তায় কোনো বাস চলাচল না করায় অন্য একটি রূপ নিয়েছে এই যানজট আকীর্ণ নগরটি।
ইতোমধ্যে লঞ্চ ভাড়া দ্বিগুণ করার প্রস্তাব উত্থাপন করেছেন লঞ্চ মালিকরা। যাত্রীবাহী লঞ্চের ভাড়া ১০০ কিলোমিটার পর্যন্ত ১ টাকা ৭০ পয়সার পরিবর্তে ৩ টাকা ৪০ পয়সা ও ১০০ কিলোমিটারের বেশি হলে ১ টাকা ৪০ পয়সার পরিবর্তে ২ টাকা ৮০ পয়সা করার প্রস্তাব করেছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-চলাচল সংস্থা। শুক্রবার বিকাল ৩টায় সারা দেশের লঞ্চ মালিকদের সমন্বয়ে সংস্থাটির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক জরুরি সভায় এই প্রস্তাব করা হয়েছে। লিখিত প্রস্তাবটি বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লউটিএ) চেয়ারম্যানের কাছে পাঠানো হয়েছে।
এ বিষয়ে বিআইডব্লিউটিএর পরিচালক রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘ভাড়ার বিষয়ে আগামী ৮ নভেম্বর সোমবার আমাদের একটি পূর্বনির্ধারিত বৈঠক আছে। তবে মালিকদের এই আবেদনের প্রেক্ষিতে বৈঠকের সময় এগিয়ে আনা হতে পারে। এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি।’
বাস-লঞ্চ বন্ধের কারণে অতিরিক্ত চাপ পড়েছে ট্রেনের ওপর। শুক্রবার থেকে রাজধানীর কমলাপুর ও বিমানবন্দর স্টেশনে যাত্রীদের ভিড় চোখে পড়ার মতো। আন্তঃনগর ট্রেনগুলোতে করোনাকাল থেকেই দাঁড়িয়ে যাত্রী তোলা নিষেধ। স্ট্যান্ডিং টিকিট বিক্রি বন্ধ। কিন্তু যাত্রী চাপে শুক্রবার এসব নিয়মকানুনের বালাই ছিল না।
দুপুরে ভর্তি পরীক্ষা এবং বিকেলে নিয়োগ পরীক্ষা শেষে পরীক্ষার্থীদের প্রচ- চাপ ছিল কমলাপুরে। তাদের অধিকাংশই টিকিট পাননি। তারা বাধা না মেনে দাঁড়িয়ে ট্রেনে চড়েন। কমলাপুর স্টেশন মাস্টার আনোয়ার হোসেন জানিয়েছেন, বিকেলে যাত্রীর চাপ বাড়ে।
স্টেশনের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ধর্মঘটের কারণে যাত্রী ভোগান্তি বিবেচনা করে দাঁড়িয়ে ট্রেন যাত্রায় বাধা দেওয়া হয়নি। বিমানবন্দর স্টেশন থেকে ছাদে ট্রেন ভ্রমণের খবর মিলেছে।
মূলকথা হলো যাই হোক না কেন দিন শেষে বলির পাঠা হবে সাধারণ যাত্রী। ধর্মঘট চলাকালীন তাদের যেমন ভোগান্তি, ধর্মঘট শেষেও তাদের জন্য অপেক্ষা করছে ভাড়া ভোগান্তি। তেলের মূল্য প্রত্যাহার বা স্থগিত করার কথা বললেও অন্তরালে আসলে ভাড়া সমন্বয় করার একটা কৌশল চলছে।