নিজস্ব প্রতিবেদক :
জাতির মুক্তির জন্য দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে মহাকাব্যিক ভাষণ দিয়েছিলেন, সেটি ছিল আদতে বাঙালির স্বাধীনতার ডাক। এই ভাষণেই রচিত হয়ে গিয়েছিল বাঙালি জাতির মুক্তির ভিত্তি। যার ওপর ভর করে ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষিত হয়। বাঙালি ঝাঁপিয়ে পড়ে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে। দীর্ঘ নয় মাসের যুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদারদের হারিয়ে লাভ করে বহুল কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা। সেজন্য বাঙালি জাতির কাছে এই ভাষণের তাৎপর্য অপরিসীম।
বঙ্গবন্ধুর অমর এ ভাষণটিকে ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর বিশ্বের ঐতিহাসিক দলিল (বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য) হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো। আরও তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, ইউনেস্কো প্রথম কোনো ভাষণকে স্বীকৃতি দিয়েছে, যা অলিখিত। ৭ মার্চের ভাষণটি পৃথিবীর অনেক ভাষায় অনুবাদও হয়েছে।
ওই স্বীকৃতির পর ২০১৭ সালের ২০ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সম্পাদক ড. মো. বশির আহমেদ একটি রিট দায়ের করেন। রিটে ৭ মার্চকে ঐতিহাসিক জাতীয় দিবস ঘোষণা এবং যে মঞ্চে বঙ্গবন্ধু ভাষণ দিয়েছিলেন, সেই মঞ্চে তার আবক্ষ ভাস্কর্য নির্মাণের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা চাওয়া হয়।
ওই রিটের শুনানি নিয়ে ৭ মার্চকে কেন ‘জাতীয় ঐতিহাসিক দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন হাইকোর্ট। এছাড়া একাত্তরের ৭ মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে স্থানে, যে মঞ্চে ভাষণ দিয়েছিলেন, পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ, মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র সমর্পণ এবং ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্ধিরা গান্ধীকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিল যে স্থানে, সেই স্থানে মঞ্চ পুননির্মাণ কেন করা হবে না, তাও জানতে চান আদালত। পাশাপাশি ৭ মার্চের সেই ঐতিহাসিক ভাষণের সময় বঙ্গবন্ধুর ‘স্পিচ মোড’র (তর্জনি উঁচিয়ে ভাষণের ভঙ্গি) ভাস্কর্য নির্মাণের নির্দেশ কেন দেওয়া হবে না—তাও জানতে চাওয়া হয় রুলে।
একাত্তরের ৭ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে উত্তাল জনসমুদ্রে ভাষণ দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
সেই রুলের শুনানিতে রিট আবেদনকারীর সম্পূরক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০২০ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি ৭ মার্চকে ঐতিহাসিক জাতীয় দিবস ঘোষণা করতে নির্দেশ দেন আদালত। আদেশে আদালত মুজিববর্ষের মধ্যে দেশের প্রত্যেকটি জেলা ও উপজেলা কমপ্লেক্সে রাষ্ট্রীয় খরচে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি নির্মাণের নির্দেশ দেন। এছাড়া, প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তকে ৭ মার্চের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস অন্তর্ভুক্তির কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না তা জানতে চেয়ে রুলও জারি করেন আদালত।
২০২১ সালের ৮ সেপ্টেম্বর এসব রুলের নিষ্পত্তি করেন হাইকোর্টের বিচারপতির এফআরএম নাজমুল আহসান ও বিচারপতি শাহেদ নূর উদ্দীনের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ। সেদিন আদালত বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজ, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক প্রতিষ্ঠানের পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করার নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জাতির জনকের ৭ মার্চের ভাষণের তর্জনি উঁচিয়ে ভাষণের মুহূর্তের (স্পিচ মোড) ভাস্কর্য স্থাপন করতে বলেন। এ লক্ষ্যে একটি কমিটিও করতে বলা হয়।
সেদিন রাষ্ট্রপক্ষের শুনানিতে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন ও ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার এবিএম আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ বাশার। আবেদনের পক্ষে ছিলেন রিটকারী আইনজীবী ড. মো. বশির আহমেদ।
আইনজীবী ড. বশির আহমেদ সেদিন সাংবাদিকদের বলেন, হাইকোর্টের আগের আদেশ অনুযায়ী সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপন দ্রুত সম্পন্ন করার নির্দেশ দিয়েছেন। এছাড়া জেলায় জেলায় বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল স্থাপনে আগের আদেশ বাস্তবায়নেরও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এ বি এম আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ বাশার সাংবাদিকদের বলেছিলেন, স্বাধীনতার স্থপতি ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজ, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করার নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। সঙ্গে সঙ্গে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জাতির জনকের ৭ মার্চের ভাষণের তর্জনি উঁচিয়ে বক্তৃতার ভাস্কর্য স্থাপনের জন্য বলেছেন আদালত। তবে, এটা কোন পর্যায়ে, ক্যাটাগরি কী হবে তার জন্য একটা বিশেষজ্ঞ কমিটি নির্ধারণ করে দেওয়া হবে। কমিটিতে কারা থাকবেন সেটা রাষ্ট্রপক্ষ আদালতে দাখিল করবে। এরপর আদালত কমিটি চূড়ান্ত করে দেবেন। এই কমিটিই নির্ধারণ করে দেবে কোন পর্যায়ে বা কোন স্তরে ভাষণটি অন্তর্ভুক্ত করা হবে।
ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ওপর নরসিংদীর সাহে-প্রতাপ মোড়ে বঙ্গবন্ধুর ‘তর্জনি’র ভাস্কর্য
আদালতের ওই নির্দেশনা কতটুক বাস্তবায়ন হয়েছে, সে ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ৭ মার্চকে ২০২০ সালের ১৯ অক্টোবর ঐতিহাসিক দিবস হিসেবে ঘোষণা করে পরিপত্র জারি করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। বাকি নির্দেশনার বিষয়ে এখনো কোনো অগ্রগতি প্রতিবেদন হাইকোর্টে আসেনি বলে জানিয়েছেন রিটকারী আইনজীবী। সেজন্য আদালতের আদেশ কতটুকু বাস্তবায়ন হয়েছে, নাকি আদো হয়নি, সে বিষয়ে কিছু বলা যাচ্ছে না।
হাইকোর্টের আদেশ বাস্তবায়নের বিষয়ে রিটকারী আইনজীবী ড. মো. বশির আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, জাতির পিতা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের যে স্থানে দাঁড়িয়ে ভাষণ দিয়েছিলেন, সেই স্থান চিহ্নিত করে বঙ্গবন্ধুর তর্জনি উঁচিয়ে ভাষণের ভাস্কর্য স্থাপনের জন্য বলেছিলেন আদালত। এতদিন হয়ে গেলেও আদেশ বাস্তবায়ন হচ্ছে কি না, সেটির কোনো অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে কোনো অগ্রগতি প্রতিবেদন এখনো হাইকোর্টে আসেনি। আমারও জানা নেই, এর অগ্রগতি কতটুকু হয়েছে।
‘এছাড়াও বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজ, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করার নির্দেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। ওই আদেশের পর শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ অন্যান্য মন্ত্রণালয় কোনো পদক্ষেপ নিয়েছে কি না সেটিরও কোনো অগ্রগতি আছে বলে আমার জানা নেই’—বলেন ড. মো. বশির আহমেদ।
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার আব্দুল্লাহ্ আল মাহমুদ বাশার জাগো নিউজকে বলেন, ৭ মার্চকে ঐতিহাসিক জাতীয় দিবস ঘোষণা করা হয়েছে। এখন যেটা বাকি আছে ৭ মার্চের ভাষণটা পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা। এ আদেশ বাস্তবায়নে একটা বিশেষজ্ঞ কমিটি করার কথা ছিল, কোন স্তরে কোন মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের এটা পড়ানো যায় বা এ বিষয়ে কতটুকু গবেষণা করা যায়, এসব বিষয় বিশেষজ্ঞ কমিটি নির্ধারণ করবে। সেই কমিটি গঠন করা হয়েছে কিনা সেটা জানা নেই। তবে, বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠনের বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়ার কথা ছিল মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট যারা আছেন, তারা উদ্যোগ নেবেন।
স্থাপিত ভাস্কর্যের নিরাপত্তা নিশ্চিতে রুল
এদিকে ২০২০ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি প্রত্যেকটি জেলা ও উপজেলা কমপ্লেক্সে রাষ্ট্রীয় খরচে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি নির্মাণের নির্দেশের পর ওই বছরের ৬ ডিসেম্বর আরেকটি রিট করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী উত্তম লাহিড়ী। রিটে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যসহ দেশে বিদ্যমান সব ভাস্কর্য রক্ষায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে নির্দেশনা চাওয়া হয়। আদালতে রিটের পক্ষে শুনানিতে ছিলেন আইনজীবী শাহ মঞ্জুরুল হক ও নাহিদ সুলতানা যুথী। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানিতে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন ও ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল তুষার কান্তি রায়।
৮ ডিসেম্বর ওই রিটের শুনানিতে বিচারপতি জে বি এম হাসান ও বিচারপতি মো. খায়রুল আলমের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ জাতির পিতার ভাস্কর্য ভাঙচুরসহ অসম্মান প্রদর্শনকারী দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে সংবিধান ও প্রচলিত ফৌজদারি আইন অনুযায়ী শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে ভাস্কর্য, ম্যুরাল ও প্রতিকৃতি সম্পর্কে জনগণকে সচেতন ও জনমনে বিভ্রান্তি দূর করতে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক ও বায়তুল মোকাররম মসজিদের খতিবকে গণমাধ্যমে বক্তব্য প্রচার করতে বলেন।
সেদিন আইনজীবী নাহিদ সুলতানা যুথী বলেন, বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙচুরসহ অসম্মান প্রদর্শনকারীদের বিরুদ্ধে সংবিধানের ৭(ক) অনুসারে রাষ্ট্রদ্রোহিতাসহ প্রচলিত অন্যান্য আইনে ব্যবস্থা নিতে স্বরাষ্ট্র সচিবসহ বিবাদীদের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপন ও ব্যবস্থাপনায় সুরক্ষার ক্ষেত্রে ভাঙচুরকারী দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে সংবিধানের ৭(ক) অনুচ্ছেদ, দণ্ডবিধি ও প্রচলিত আইন অনুযায়ী শাস্তিমূলক ব্যবস্থার ক্ষেত্রে বিবাদীদের নিষ্ক্রিয়তা কেন আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না—এ বিষয়ে রুল হয়েছে।
ওই রুলের আদেশের অগ্রগতির বিষয়ে রিটকারী আইনজীবী উত্তম লাহিড়ী বলেন, রিটের আদেশের অগ্রগতির বিষয়ে পুরোপুরি জানা নেই। তবে আইনজীবী নাহিদ সুলতানা যুথীর সঙ্গে পরামর্শ করে রুলের শুনানির বিষয়ে উদ্যোগ নেবো।
সূত্র-জাগোনিউজ