নিজস্ব প্রতিবেদক :
করোনার কারণে বছরজুড়েই খুব একটা ভালো ছিল না দেশের অর্থনীতি। এর মাঝে কয়েক দফা বন্যায় নিত্যপণ্যের বাজারে বড় ধরনের অস্থিরতা দেখা দেয়। তবে তারও আগে বছর শুরু হয় পেঁয়াজের আগুনে দাম নিয়ে। জানুয়ারিতে প্রায় ১৫০ টাকায় কিনতে হয়েছে পেঁয়াজ। একই সময় বাড়তি ছিল চাল ও তেলের দামও। পরে বছরজুড়েই চাল, তেল, সবজি, পেঁয়াজ, আলুসহ বিভিন্ন নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বমুখী দাম ভুগিয়েছে ক্রেতাদের। আর শেষ মুহূর্তে চলতি ডিসেম্বরে ভরা মৌসুমেও চালের মূল্যবৃদ্ধি ও তেলের দামের নতুন রেকর্ডে বছর শেষে এসেও মানুষের ভোগান্তি চরমে উঠেছে। বাজার বিশ্লেষণে দেখা যায়, বছরজুড়েই আলোচনায় ছিল বিভিন্ন নিত্যপণ্য। বেশ কিছু পণ্যের সর্বোচ্চ দামের রেকর্ড হয়েছে এ বছর। করোনায় মানুষের আয় কমে গেলেও প্রায় সব পণ্যের দাম বেড়েছে। বেড়েছে নিত্যদিনের খরচ। এর মধ্যে চালের দামই বেড়েছে প্রায় ৫০ শতাংশ। করোনার প্রভাবে এমনিতেই সব দিকে অস্থিরতা, এমন অবস্থায় নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বমুখী দামে ভোক্তারা দিশাহারা হয়ে পড়েন। সবচেয়ে বেশি ভুগছেন গরিব ও নিম্নবিত্তরা। সীমিত আয়ে আকাশছোঁয়া দামে নিত্যপণ্য কিনতেই দিশাহারা অবস্থা। করোনা মহামারি জয় করে ২০২১ নতুন বছরে সাধারণ মানুষের আশা ছিল জীবনে স্বস্তি ফিরবে। কিন্তু করোনার প্রতাপ কমলেও সাধারণ মানুষের জীবনধারায় ভিলেন বা খলনায়ক হয়ে দাঁড়ায় নিত্যপণ্যের বাজার।
২০২০ সালে গড়ে মিনিকেট চালের দাম ছিল ৬২ টাকা কেজি। চলতি বছরের শুরুতেই তা হয়ে যায় ৬৬ টাকা। বছরজুড়ে এই দাম কিছুটা ওঠানামা করলেও বেশির ভাগ সময় ৬৬ টাকা কেজিই ছিল। একই অবস্থা নাজিরশাইল, আটাশ, স্বর্ণা, পাইজামসহ অন্য চালের দামেও। ২০২০ সালে নাজিরশাইলের কেজি ছিল ৬৯ টাকা। ২০২১-এর শুরুতেই তা ছাড়িয়ে যায় ৭০ টাকা।
চালের মতো এ বছর দামের প্রতাপ ছড়িয়েছে ভোজ্য তেল সয়াবিন ও পাম। ২০২০ সালে খোলা সয়াবিনের গড় দাম ছিল ১০১ টাকা কেজি। চলতি বছর তা দাঁড়ায় ১৫৫ টাকায়। চিনি ছিল ৬৮ টাকা কেজি, বর্তমানে ৮০ টাকা কেজি। করোনা মহামারি শুরুর পর ৬০ টাকা কেজির মসুর ডাল ৯০ টাকায় ওঠে। ২০২১ সালের মাঝামাঝিতে তা দাঁড়ায় ৯৫ টাকা কেজি। উৎপাদন খরচ ২২ থেকে ২৪ টাকা হলেও চলতি বছরজুড়ে পেঁয়াজের কেজি ছিল গড়ে ৭০ টাকার ওপরে। চলতি বছরের শেষ দিকে ফার্মের মুরগির বাজারও অস্থির হয়ে ওঠে। বছরের বেশির ভাগ সময় ব্রয়লার মুরগি ১২০ টাকা কেজির মধ্যে ছিল। অক্টোবরে এসে ১৯০ টাকা কেজিতে ওঠে। সোনালি ছিল ২৫০ টাকা কেজি, অক্টোবরে তা ৩৫০ টাকা ছাড়িয়ে যায়। বর্তমানে অবশ্য কিছুটা কমেছে।
টিসিবির হিসাবে বেশি দাম বেড়েছে তেজপাতা, লবঙ্গ, আমদানির পেঁয়াজ-রসুন, আদাসহ মসলাজাতীয় পণ্যের। এসব পণ্যের দাম বেড়েছে ১২ থেকে ৬৮ শতাংশ পর্যন্ত। করোনায় স্বাস্থ্যঝুঁকি এড়াতে মসলাজাতীয় পণ্যের চাহিদা বেড়েছে। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ভোজ্য তেল সয়াবিন ও পাম। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ার কারণ দেখিয়ে দেশের ব্যবসায়ীরা চলতি বছর কয়েক দফায় ২৯ থেকে ৪০ শতাংশ দাম বাড়িয়েছেন। তৃতীয় স্থানে থাকা আটা ও ময়দার দাম বেড়েছে ২৩ থেকে ৩৭ শতাংশ। চতুর্থ স্থানে থাকা মসুর ও ছোলার ডালের দাম বেড়েছে যথাক্রমে ১৫ ও ৩১ শতাংশ। চিনি ও রডের দাম বেড়েছে ২২ থেকে ২৬ শতাংশ। দাম বাড়ার তালিকায় আরো রয়েছে গুঁড়া দুধ, ডিম, গরু ও মুরগির মাংস, চাল, মাছসহ প্রায় সব পণ্য। অন্যদিকে ৯টি পণ্যের দাম কমেছে। সবচেয়ে বেশি ৪৫ শতাংশ কমেছে আলুর দাম। গত বছর চার দফা বন্যায় আলুর বিলম্বিত আবাদ ও করোনায় অসহায় মানুষের মধ্যে ত্রাণ হিসেবে আলু বিতরণÑএ দুই কারণে বাজারে চাহিদা বেড়ে যায়। গত বছর আলুর দাম সর্বোচ্চ ৫৫ টাকা কেজি পর্যন্ত উঠেছিল।
করোনার প্রকোপে ঝিমিয়ে পড়া অর্থনীতি কিছুটা সচল হয় বছরের শুরুতে। কিন্তু অর্থনীতিতে নতুন চাপ তৈরি করে তীব্র মূল্যস্ফীতি। আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধির পাশাপাশি সরবরাহ বিঘœতায় বেড়ে যায় আমদানিপণ্যের দাম। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে অভ্যন্তরীণ বাজারে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বুর্যের (বিবিএস) হিসাব বলছে, চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে মূল্যস্ফীতি ছিল ৫.০২ শতাংশ। পরের ছয় মাসে কখনো তা বেড়েছে, আবার কখনো মূল্যস্ফীতি কমেছে। তবে নতুন (২০২১-২২) অর্থবছরের প্রথম মাস থেকে মূল্যস্ফীতির গতি ঊর্ধ্বমুখী। জুলাই মাসে মূল্যস্ফীতি ছিল ৫.৩৬ শতাংশ। সর্বশেষ নভেম্বর মাসে মূল্যস্ফীতি বেড়ে হয়েছে ৫.৯৮ শতাংশ। সামগ্রিক অর্থে এই মূল্যস্ফীতি জানুয়ারি থেকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত বেড়েছে ০.৯৬ শতাংশ।
অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, সামনের দিকে আরো বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে মূল্যস্ফীতি। অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, বিবিএসের মূল্যস্ফীতির হিসাব বাস্তবতার সঙ্গে সম্পূরক নয়। তাঁরা বলছেন, প্রকৃত অবস্থা আরো বেশি ভয়াবহ। বিশেষ করে খাদ্যদ্রব্য ও জাতীয় পণ্যে মূল্যস্ফীতি অনেক বেশি হওয়ার কথা।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘ক্যালেন্ডার ইয়ারের শুরু ছয় মাসের দিক থেকে পর্যবেক্ষণ করলে আপনারা দেখতে পারবেন, দেশীয় অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতি বাড়ছে, আবার কমছে এর অন্যতম কারণ হলো, মানুষের চাহিদার তারতম্য। আবার শেষের পাঁচ মাসের দিকে তাকালে দেখবেন, মূল্যস্ফীতির নিম্নগতি নেই। তবে এ ক্ষেত্রে চাহিদা বৃৃদ্ধি, জোগান কম থাকা, আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম বেশি ইত্যাদি কারণ।’ তিনি আরো বলেন, ‘আমি মনে করি সহসাই এই মূল্যস্ফীতি কমবে না। বিশেষ করে খাদ্যদ্রব্যের মূল্যস্ফীতি। কারণ বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে চাহিদা কম, জোগান বেশিÑএমন পরিস্থিতি হয়নি।’
বিবিএসের দেওয়া তথ্য মতে, জানুয়ারিতে মূল্যস্ফীতি ছিল ৫.০২ শতাংশ। ফেব্রুয়ারি মাসে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫.৩২ শতাংশ। মার্চে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৫.৪৮ শতাংশ। এপ্রিল মাসে মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ৫.৫৬ শতাংশে। মে মাসে তা কমে এসেছে ৫.২৬ শতাংশে এবং অর্থবছরের শেষের জুন মাসে ছিল ৫.৬৪ শতাংশ। নতুন অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে মূল্যস্ফীতি কমে এসেছিল ৫.৩৬ শতাংশে। আগস্টে তা বেড়ে হয় ৫.৫৪ শতাংশ এবং সর্বশেষ সেপ্টেম্বর মাসে মূল্যস্ফীতি দাঁড়ায় ৫.৫৯ শতাংশ। অক্টোবরে ৫.৭০ শতাংশ এবং নভেম্বর মাসে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৫.৯৮ শতাংশে।