নিজস্ব প্রতিবেদক :
ডিপ্লোমেটিক বন্ডেড ওয়্যারহাউজগুলো বছরে কি পরিমাণ মদ-বিয়ার আমদানি করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরে তার তথ্য নেই। কিন্তু মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন অনুযায়ী বন্ডেড ওয়্যারহাউজগুলো মদ আমদানির জন্য অধিদপ্তরের অনুমতি নিতে বাধ্য। কিন্তু ওই নিয়মের তোয়াক্কা না করেই চাহিদার অতিরিক্ত মদ দেশে আমদানি করা হচ্ছে। আর ওই মদ-বিয়ার খোলাবাজারে চলে যাচ্ছে। মূলত পরিমাণ কিংবা সর্বনিম্ন আমদানি মূল্য বেঁধে না দেয়ায় ডিপ্লোমেটিক বন্ডেড ওয়্যারহাউজগুলো পানির দরে অ্যালকোহলযুক্ত মদ ও বিয়ার আমদানি করছে। ফলে কূটনৈতিক ও বিশেষ সুবিধাভোগী বিদেশি নাগরিকদের বছরে যে পরিমাণ মদ ও বিয়ারের চাহিদা রয়েছে তার চেয়ে বেশি পরিমাণ মদ দেশে ঢুকছে। বন্ডেড ওয়্যারহাউজগুলোর ওসব কারসাজি বন্ধে শুল্ক গোয়েন্দা ও চট্টগ্রাম কাস্টমস জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) চিঠি দিয়েছে। ওই চিঠিতে কারসাজি নিয়ন্ত্রণের জন্য শুল্কমুক্ত সুবিধায় মদ-বিয়ারের ন্যূনতম মূল্য অথবা পরিমাণ বেঁধে দেয়ার প্রস্তাব করা হলেও মাসের পর মাস কেটে গেলেও প্রস্তাবটির বিষয়ে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, অ্যালকোহলমুক্ত এক লিটার বিয়ারের ন্যূনতম আমদানি মূল্য আড়াই ডলার নির্ধারণ করা আছে। অথচ ডিপ্লোমেটিক বন্ডেড ওয়্যারহাউজগুলো অ্যালকোহলযুক্ত বিয়ার (৩৩০ মি.লি.র ক্যান) এক ডলারেরও কম দামে আমদানি করছে। আর দেড় থেকে ২ ডলারে হুইস্কিজাতীয় মদ আমদানি করছে। সম্প্রতি একটি ডিপ্লোমেটিক বন্ড ৩৫ হাজার ৫০০ লিটার বিয়ার, ১৩ হাজার লিটার হুইস্কি এবং প্রায় ১৪ হাজার লিটার ওয়াইনজাতীয় মদ আমদানি করে। বিয়ারের আমদানি মূল্য ৬৩ সেন্ট (এক ডলারের কম) ঘোষণা দেয়া হয়। হুইস্কি ও ওয়াইনের মূল্য যথাক্রমে এক ডলার ৯১ সেন্ট ও এক ডলার ১২ সেন্ট। অথচ চলতি অর্থবছরের বাজেটে ন্যূনতম মূল্যের প্রজ্ঞাপনে অ্যালকোহলমুক্ত মদের ন্যূনতম আমদানি মূল্য আড়াই ডলার নির্ধারণ করে দেয়া আছে।
সূত্র জানায়, গত এক বছরে দেশে শুল্কমুক্ত সুবিধায় ১৪৭টি আমদানি চালানের মাধ্যমে ২২ লাখ ৪ হাজার ৯০৫ লিটার মদ-বিয়ার আমদানি হয়েছে। ডিপ্লোমেটিক বন্ডগুলো কেবল বিশেষ সুবিধাভোগী ব্যক্তি ও কূটনৈতিকদের কাছে বিক্রির শর্তেই শুল্কমুক্ত সুবিধায় ওসব পণ্য আমদানি করতে পারে। কিন্তু দেশে শুল্কমুক্ত সুবিধায় আনা মদ-বিয়ারের অপব্যবহার হচ্ছে। তবে শুল্কমুক্ত সুবিধায় আনা মদ-বিয়ার খোলাবাজারে বিক্রি বন্ধে এনবিআর একটি সফটওয়্যার চালু করেছে। ওই সফটওয়্যারে প্রতিটি ডিপ্লোমেটিক বন্ডকে মদ-বিয়ার আমদানির যাবতীয় তথ্য লিপিবদ্ধ করার নির্দেশ দেয়া হয়। একই সঙ্গে পণ্য বিক্রির সময় কূটনৈতিক বা বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত ব্যক্তির পাশবুক অথবা কর অব্যাহতির সনদ নম্বর এবং পাসপোর্টের তথ্য যাচাই করে বরাদ্দ অনুযায়ী পণ্য বিক্রি এবং এক্স বন্ড নম্বর, বিক্রীত পণ্যের নাম, পরিমাণ সফটওয়্যারে এন্ট্রি দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কিন্তু ডিপ্লোমেটিক বন্ডগুলো সাইবার নিরাপত্তার অজুহাতে সফটওয়্যার ব্যবহারে অনীহা প্রকাশ করে আদালতে রিট করে। আর ওই রিট মামলাটি এখনো নিষ্পত্তি হয়নি।
সূত্র আরো জানায়, বর্তমানে ডিপ্লোমেটিক বন্ডগুলোকে ডলারে আমদানি প্রাপ্যতা দেয়া হয়। আর ওই সুযোগ কাজে লাগিয়ে প্রতিষ্ঠানগুলো আন্ডার ইনভেসিংয়ের মাধ্যমে মদ-বিয়ার খালাস করছে। কিন্তু অ্যালকোহলমুক্ত বিয়ারের মতো অ্যালকোহলযুক্ত মদ-বিয়ারেরও ন্যূনতম আমদানি মূল্য আরোপের মাধ্যমে খুব সহজেই চুরি ঠেকানো সম্ভব। অথবা ডলারের পরিবর্তে ডিপ্লোমেটিক বন্ডগুলোকে লিটারে আমদানি প্রাপ্যতা দেয়া হলেও অপব্যবহার অনেকাংশে কমে আসবে। মূলত ডিপ্লোমেটিক বন্ডের অপব্যবহার বন্ধে এনবিআরসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো কিছুই করেনি। আর ওই সুযোগই নিচ্ছে বন্ডগুলো। বন্ডের আমদানিকৃত মদ-বিয়ার বিভিন্ন ক্লাব ও উচ্চবিত্তদের বাসাবাড়িতেও দেখা যায়। ইতিপূর্বে চট্টগ্রাম কাস্টমস মদ-বিয়ার আমদানিতে ডিপ্লোমেটিক বন্ডগুলোর আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরে এনবিআরে চিঠি দিয়েছে। ওই অপতৎপরতা বন্ধে মদ-বিয়ার আমদানিতে ন্যূনতম মূল্য আরোপ অথবা ডলারের পরিবর্তে আমদানি প্রাপ্যতা লিটারে দেয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়। একই সঙ্গে ডিপ্লোমেটিক বন্ডের অর্থ পাচারের তদন্ত করতে শুল্ক গোয়েন্দা, শুল্ক মূল্যায়ন, বন্ড কমিশনারেট ও কাস্টমস হাউজের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে তদন্ত কমিটি গঠনেরও প্রস্তাব দেওয়া হয়। কিন্তু তাও আলোর মুখ দেখেনি।
এদিকে কাস্টমস কর্মকর্তাদের মতে, ডিপ্লোমেটিক বন্ডগুলো ভিয়েনা কনভেনশনের দোহাই দিয়ে একের পর এক অপকর্ম করে যাচ্ছে। আইন-কানুনের কোনো তোয়াক্কাই করছে না। সম্প্রতি শুল্ক মূল্যায়ন ও নিরীক্ষা কমিশনারেট একটি প্রতিষ্ঠানের অডিটের কাজে ওই প্রতিষ্ঠানের কাছে মদ-বিয়ার আমদানির তথ্য চাওয়া হলে প্রতিষ্ঠানটি তথ্য দেয়নি। শুল্ক গোয়ন্দাও অপর একটি প্রতিষ্ঠানের অর্থ পাচারের অনুসন্ধান করছে। সেজন্য তথ্য চাওয়া হলে ওই প্রতিষ্ঠানও কোনো দেয়নি। তাছাড়া ভ্যাট গোয়েন্দা স্থানীয় একটি বারের ভ্যাট ফাঁকির অনুসন্ধানের জন্য প্রতিষ্ঠানটির কাছে ভ্যাট রিটার্ন ও বার্ষিক অডিট রিপোর্ট চেয়েছিল। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি সহযোগিতা না করায় পরে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক থেকে ওই প্রতিষ্ঠানের অডিট রিপোর্ট ও ভ্যাট সার্কেল থেকে রিটার্ন সংগ্রহ করা হয়। শুধু কাস্টমস-আয়কর বিভাগ নয়, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরকেও ডিপ্লোমেটিক বন্ডেড ওয়্যার হাউজগুলো পাত্তা দেয় না। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন অনুযায়ী বন্ডেড ওয়্যারহাউজগুলো মদ আমদানির জন্য অনুমতি নিতে বাধ্য। কিন্তু ওসব প্রতিষ্ঠান নিয়ম না মেনে মদ আমদানি করছে। ফলে প্রতিষ্ঠানগুলো বছরে কী পরিমাণ মদ-বিয়ার আমদানি করছে তার তথ্য মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কাছে নেই।