• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৪:৩৭ পূর্বাহ্ন

বন্ধ হচ্ছেই না সিস্টেম লসের নামে অবাধে বিপিসির জ্বালানি তেল চুরি

Reporter Name / ১০৯ Time View
Update : মঙ্গলবার, ৩০ নভেম্বর, ২০২১

নিজস্ব প্রতিবেদক :
সিস্টেম লসের নামে অবাধে চুরি হচ্ছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরশনের (বিপিসি) জ্বালানি তেল। মূলত সিন্ডিকেটের ছত্রছায়ায় পরিবহন ও মজুদের সময় সিস্টেম লসের নামে অবাধে চুরি হচ্ছে জ্বালানি তেল। পাশাপাশি হিসাবের খাতায় নয়ছয় করেও তেল পাচারও হচ্ছে। প্রযুক্তির উৎকর্ষকালেও বিপিসি অ্যানালগ পদ্ধতিতেই চলছে। এখনো ফিতা আর কাঠি দিয়ে বিপিসির ট্যাঙ্কারের তেল পরিমাপ করা হয়। তাছাড়া প্রতিষ্ঠানটির হিসাব-নিকাশেও স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে। বিপিসির ওসব অব্যবস্থাপনা দূর করা গেলে সংস্থাটি যেমন অনেক ভালো অবস্থায় থাকতো, তেমনি জনগণও স্বস্তিতে থাকতো। বিপিসি সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বিদেশ থেকে বড় ট্যাঙ্কারে (মাদার ভেসেল) করে জ্বালানি তেল আমদানি করা হয়। বহির্নোঙরে থাকা ওসব ট্যাঙ্কার থেকে তেল খালাস করে মজুদের জন্য লাইটারেজে করে চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় বিভিন্ন ট্যাঙ্কে পাঠানো হয়। তারপর সড়ক, নৌ ও রেলপথে দেশের বিভিন্ন ডিপোতে তা পাঠানো হয়। তবে নৌপথেই বেশি তেল পরিবহন করা হয়। আর ট্যাঙ্কলরির মাধ্যমে বিভিন্ন ডিপো থেকে পেট্রোল পাম্পে তেল নেয়া হয়। লাইটারেজ, ডিপোর ট্যাঙ্ক, রেলগাড়ি, ট্যাঙ্কলরিতে তেল নেয়া বা খালাসের সময় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এখনো সনাতন পদ্ধতিতেই তেল পরিমাপ করা হয়। ট্যাঙ্ক, লাইটারেজ ও লরির রিজার্ভারে সুতা ফেলে বা কাঠের স্কেল দিয়ে তেলের মজুদ পরীক্ষা করা হয়। হাতেগোনা মাত্র কয়েকটি ট্যাঙ্কে স্বয়ংক্রিয় পরিমাপক পদ্ধতি রয়েছে। আর মাপের আড়ালেই চলে তেল চুরি। কারণ স্কেলের দুই-এক দাগ এদিক-সেদিক করা হলেই শত শত লিটার তেলের পরিমাণে হেরফের ঘটে যায়। সূত্র জানায়, বিগত ২০১৭ সালের অক্টোবরে বিপিসির পতেঙ্গা স্থাপনা থেকে দুটি জাহাজে করে খুলনার দৌলতপুর এবং নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় যমুনার ডিপোতে সরবরাহের সময় ১ লাখ ৫১ হাজার ৬৮২ লিটার ডিজেল পাচারের ঘটনা ঘটে। তৎকালীন বাজারমূল্য অনুসারে ওই চুরির ঘটনায় প্রায় এক কোটি টাকা ক্ষতি হয়। দুটি জাহাজে মোট ৩৮ লাখ ৪২ হাজার ৯৫২ লিটার ডিজেল ভরা হয়েছিল। কিন্তু কাগজে-কলমে ৩৬ লাখ ৯১ হাজার ২৭০ লিটার দেখানো হয়। অর্থাৎ জাহাজ দুটিতে ১ লাখ ৫১ হাজার ৬৮২ লিটার ডিজেল বেশি তোলা হয়। পতেঙ্গার প্রধান স্থাপনায় সংরক্ষিত রেজিস্টারে (ডিপ বুক) এবং দুটি জাহাজের চালানে (লোডিং স্লিপ) দুই রকম তথ্যের কারণে শেষ পর্যন্ত চুরির বিষয়টি ধরা পড়ে যায়। জ্বালানি তেলবাহী জাহাজ এম টি মনোয়ারায় করে ফতুল্লায় এবং এম টি রাইদায় করে দৌলতপুরে ওই তেল পাঠানো হয়। মনোয়ারায় সংরক্ষিত চালানের (লোডিং স্লিপ) তথ্য অনুযায়ী তাতে ১৮ লাখ ৩০ হাজার ৩৬৬ লিটার ডিজেল ভরা হয়। কিন্তু পতেঙ্গার প্রধান কার্যালয়ের ডিপ স্লিপে জাহাজটিতে ১৭ লাখ ২৯ হাজার ৫৮৪ লিটার ডিজেল রয়েছে দেখানো হয়। এমটি রাইদা জাহাজেও একই রকম জালিয়াতির ঘটনা ঘটে। এই জাহাজে তোলা হয় ২০ লাখ ১২ হাজার ৫৮৬ লিটার ডিজেল। কিন্তু ডিপ বুকে ৫০ হাজার ৯০০ লিটার ডিজেল কম দেখানো হয়। ওই সময় রাইদা থেকে পথেই বিক্রি করা ৮ হাজার লিটার ডিজেল জব্দ করে র‌্যাব। ওই ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করে যমুনা অয়েল। তদন্তে চুরির ঘটনায় যমুনার পাঁচ কর্মকর্তার জড়িত থাকার প্রমাণ মেলে। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে অভিযুক্তদের বিভাগীয় শাস্তিসহ ৯৫ লাখ টাকা জরিমানার সুপারিশ করা হয়। এভাবে হিসাবের হেরফেরে প্রায়ই পরিবহনের সময় তেল চুরির ঘটনা ঘটে চলেছে। শোধনাগার থেকে তেল নিয়ে যাওয়ার পথে ট্রাক থেকেও তেল চুরি যায়। হঠাৎ দুই-একটা ঘটনা ধরা পড়লেও অধিকাংশই আড়ালে থেকে যায়। চলতি বছরের ২৬ জুলাই রাতে পতেঙ্গায় শাহ আমানত বিমানবন্দর সড়ক থেকে ২ হাজার লিটার চোরাই ডিজেল, অকটেনসহ ২ জনকে আটক করে র‌্যাব। ২০১৯ সালের ৩১ জানুয়ারি বিপিসির একটি টিম গোদনাইলের ডিপোতে অভিযান চালায়। ওই সময় ডিপোর ট্যাঙ্কার মেপে ৬০ হাজার লিটার তেল কম পাওয়া যায়। তাৎক্ষণিকভাবে ডিপো ইনচার্জ বহিস্কার করা হয়। ২০১৭ সালের জুলাইতে যমুনা অয়েলের চাঁদপুর ডিপো থেকে ২ লাখ লিটার তেল চুরির ঘটনা ঘটে, যার বাজার মূল্য ছিল প্রায় এক কোটি ৩০ লাখ টাকা। ওই ঘটনায় ডিপো সুপারিনটেনডেন্ট বরখাস্ত করা হয়। সূত্র আরো জানায়, চট্টগ্রাম থেকে সিরাজগঞ্জের বাঘাবাড়ি ডিপোতে নৌপথে তেল পরিবহনের সময় হরিরামপুরের ধুলসুড়া, পাবনার বেড়া এবং রাজাবাড়ীর দৌলতদিয়াঘাট এলাকায় তেল চুরি হয়। নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে গোদনাইল ডিপো ঘিরে গড়ে উঠেছে চোরাই তেলের চক্র। জেট-ওয়ান, অকটেন, পেট্রোল, ডিজেল, কেরোসিন, ফার্নেস ও জিওবি তেল চুরি করে তা আশপাশেই বিক্রি হচ্ছে। প্রতি মাসে কোটি কোটি টাকার চোরাই জ্বালানি তেল খোলাবাজারে বিক্রি হয়। ডিপোর গেট থেকে শুরু করে এক কিলোমিটার সড়কের দুই পাশে ছোটো ছোটো দোকান ঘর রয়েছে। ডিপো থেকে বোঝাই করে গন্তব্যে যাওয়ার পথে ওসব ঘরের সামনে লরি থামিয়ে তেল চুরি করা হয়। লরিপ্রতি কমপক্ষে ৪ টিন (প্রায় ৮০ লিটার) তেল চুরি করা হয়। ওই ডিপো থেকে দিনে প্রায় ১৩০টি ট্যাঙ্ক লরি তেল বোঝাই করে দেশের বিভিন্ন গন্তব্যে রওনা দেয়। ডিপো কর্মকর্তা ও তেল পরিমাপকারীকে টাকা দিয়ে তেলের পরিমাণ খাতা-কলমে সঠিক দেখানো হয়। এভাবেই দিনের পর দিন চুরির উৎসব চালু রয়েছে। এদিকে বিপিসির হিসাব ও অডিট নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেবা আপত্তি জানিয়ে আসছে অর্থ মন্ত্রণালয়, কম্পট্রলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেলের (সিএজি) কার্যালয় ও আন্তর্জাতিক আর্থিক সংস্থাগুলো। বিদেশি প্রতিষ্ঠান দিয়ে বিপিসির অডিট করানোর জন্য আইএমএফ সরকারকে চাপ দিলেও তা কাজে আসেনি। অর্থ বিভাগ ও জ্বালানি বিভাগও বিপিসিতে সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য বারবার তাগিদ দিলেও কোনো লাভ হয়নি। বরং বিপিসি নিজের খেয়ালখুশি মতোই চলছে। বছরে হাজার হাজার কোটি টাকার লেনদেন হলেও তাতে স্বচ্ছতা নেই। সম্প্রতি লাভ-লোকসানের অস্বচ্ছ হিসাব দেখিয়ে হুট করে ডিজেলের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে বিপিসি। অথচ আইন অনুসারে এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের জ্বালানি তেলের দাম নির্ধারণ করার কথা। কিন্তু বিপিসি কখনোই কমিশনের আওতায় আসেনি। মূলত হিসাবে স্বচ্ছতা নেই বলেই প্রতিষ্ঠানটি জনগণের সামনে শুনানিতে অংশ নিতে ভয় পায়। অন্যদিকে দেশে জ্বালানি তেলের চাহিদা বছরে ৬৫ লাখ টন। তার এক-তৃতীয়াংশ অর্থাৎ ১৫ লাখ টন ক্রুড অয়েল আমদানি করে ইস্টার্ন রিফাইনারিতে পরিশোধনের মাধ্যমে অকটেন, পেট্রোল, ডিজেল, কেরোসিনসহ বিভিন্ন পেট্রোলিয়াম পণ্য উৎপাদন করা হয়। চাহিদার বাকিটুকু পরিশোধিত জ্বালানি তেল হিসেবে আমদানি করা হয়। তবে অকটেন ও পেট্রোলের প্রায় পুরোটাই দেশে উৎপাদিত হয়। আর জেট ফুয়েল, ফার্নেস অয়েল আর ডিজেল প্রায় পুরোটাই আমদানিনির্ভর। দেশে বছরে ব্যবহৃত মোট জ্বালানি তেলের মধ্যে ডিজেলের পরিমাণই ৫০ লাখ টন। পরিবহন খাতে তার ৬৩ শতাংশ ব্যবহৃত হয়। আর সেচকাজে ডিজেলের ব্যবহার ১৬ শতাংশ এবং বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার ৬ শতাংশ ডিজেলচালিত কেন্দ্র। সরকারের নির্দেশনা অনুসারে জ্বালানি তেলের চাহিদার ৫০ শতাংশ জিটুজি চুক্তিতে এবং অবশিষ্টাংশ আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে বিভিন্ন উৎস থেকে সংগ্রহ করতে হয়। এ বিষয়ে বিপিসি চেয়ারম্যান এবিএম আজাদ জানান, পুরো তেল পরিবহন ব্যবস্থাপনাকে ঢেলে সাজানোর কাজ চলছে। সমুদ্র থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত এবং পতেঙ্গা থেকে ঢাকা পর্যন্ত পাইপলাইন তৈরির কাজ চলছে। সেটা হয়ে গেলে তেল চুরি, সিস্টেম লস কমে আসবে। একই বিষয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ জানান, সব ট্যাঙ্কার, ডিপো অটোমেশনের আওতায় আনা হচ্ছে। আগেই এ উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। কিন্তু করোনার কারণে তা পিছিয়ে যায়। অটোমেশন হলেই তেল পরিমাপে স্বচ্ছতা আসবে।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category