নিজস্ব প্রতিবেদক :
বিদ্যুৎ খাতে বাড়ছে সরকারের ব্যয়। মূলত ডলারের উচ্চমূল্যের কারণেই এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। কারণ বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো (আইপিপি) থেকে বিদ্যুৎ কিনতে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে (বিপিডিবি) ডলারে মূল্য পরিশোধ করতে হয়। কিন্তু ডলারের ঊর্ধ্বমুখি দামে এখন সরকারকে আগের চেয়ে বাড়তি অর্থ পরিশোধ করতে হবে। ফলে বিদ্যুৎ খাতে সরকারের ব্যয়চাপ বাড়ার পাশাপাশি আরো বাড়তে যাচ্ছে সরকারি দায়দেনার বোঝা। বিদ্যুৎ বিভাগ সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বিপিডিবি একক ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে আইপিপিগুলোর কাছ থেকে পূর্বনির্ধারিত মূল্যে বিদ্যুৎ কিনে থাকে। সেক্ষেত্রে বিদ্যুতের ইফনিটপ্রতি মূল্য মার্কিন সেন্টে প্রতি কিলোওয়াট ঘণ্টা হিসেবে নির্ধারণ করা হয়। তবে তা বাংলাদেশী টাকায় পরিশোধ করা হয়। ওই অনুযায়ী ডলারের বিনিময় হার বাড়লে বিদ্যুৎ কিনতে বিপিডিবির খরচও বেড়ে যায়। শুধু দেশী উদ্যোগে গড়ে ওঠা ৩০ মেগাওয়াটের কম সক্ষমতার আইপিপির ক্ষেত্রেই এ নিয়ম অনুসরণ করা হয় না। বরং বিভিন্ন মেগা প্রজেক্টের আওতায় গড়ে ওঠা বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো থেকেও বিপিডিবি ডলার ইনডেক্সেশনের ভিত্তিতেই বিদ্যুৎ কেনে। আর ডলার ইনডেক্সেশনের নিয়ম অনুযায়ী, প্রতি ডলারের বিনিময় হার যখন ৮৫ টাকা ছিল, তখন প্রতি কিলোওয়াট ঘণ্টা ১০ সেন্টে বিক্রির জন্য চুক্তিবদ্ধ আইপিপিকে বিপিডিবির প্রতি ইউনিটে সাড়ে ৮ টাকা করে পরিশোধ করতে হয়েছে। আবার প্রতি ডলারের বিনিময় হার ৯৫ টাকায় দাঁড়ালে ওই ক্রয়মূল্য বেড়ে প্রায় সাড়ে ৯ টাকায় দাঁড়ায়।
সূত্র জানায়, বর্তমানে মুদ্রাবাজারে ডলারের বিনিময় হার বাড়ছে অত্যন্ত দ্রুতগতিতে বাড়ছে। তাতে বিদ্যুৎ খাতে বিপিডিবির খরচও বাড়ছে। যদিও সংস্থাটিকে দীর্ঘদিন ধরেই লোকসানের বোঝা টানতে হচ্ছে। কিন্তু ডলার ইনডেক্সেশনের কারণে বর্তমান পরিস্থিতিতে সংস্থাটির লোকসানের বোঝা আরো ভারি হয়ে হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। কারণ গত বছরের জুন শেষেও দেশে প্রতি ডলারের বিনিময় মূল্য ছিল ৮৪ টাকা ৮০ পয়সা। কিন্তু চলতি বছরের এপ্রিলে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৮৬ টাকা ৪৫ পয়সায়। মে মাসে তা আরো বেড়ে হয় ৮৯ টাকা এবং জুন শেষে প্রতি ডলারের বিনিময় হার দাঁড়ায় ৯৩ টাকা ৪০ পয়সায়। আর গত মাসের শেষে তা ছিল ৯৪ টাকা ৭০ পয়সা। বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯৫ টাকায়। বৈশ্বিক জ¦ালানির বাজারদরে অস্থিতিশীলতার কারণে এখন বিপিডিবির নিজস্ব বিদ্যুৎ কেন্দ্রেও উৎপাদন ব্যয় বাড়ছে। বিপিডিবির নিজস্ব বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় (নিট) গত অর্থবছরে আগেরবারের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে সংস্থাটির বিদ্যুৎ উৎপাদনে নিজস্ব ব্যয় ছিল ৬ হাজার ২৩৩ কোটি টাকা। গত অর্থবছরে তা প্রাক্কলন করা হয়েছে ১১ হাজার ৩০১ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে জ¦ালানির ব্যয় বাড়ার পাশাপাশি তার সঙ্গে ডলারের বিনিময় হার বৃদ্ধিও অতিরিক্ত চাপ যুক্ত করতে যাচ্ছে।
সূত্র আরো জানায়, বিপিডিবির দেনা প্রতি বছরই বাড়ছে। ভর্তুকি দিয়েও তা কমানো যাচ্ছে না। তার মধ্যেও সংস্থাটিকে আইপিপি থেকে উচ্চমূল্যে বিদ্যুৎ কিনে তা কম দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। সঙ্গে চলতি অর্থবছরে যুক্ত হচ্ছে পায়রা ও রামপালের মতো যৌথ বিনিয়োগভিত্তিক বড় প্রকল্প থেকে বিদ্যুৎ কেনার ব্যয়ও। আর ওই চাপকে এবার আরো ব্যাপক মাত্রায় বাড়িয়ে দেবে বিদ্যুৎ ক্রয়ে ডলার ইনডেক্সেশনের বিধি। ইতোমধ্যেই কোনো কোনো বিদ্যুৎ কেন্দ্র উৎপাদনে না এলেও চলতি অর্থবছরেই সেগুলোর দেনা পরিশোধ শুরু হচ্ছে। সরকারের আগামী ২০৪১ সালের মধ্যে বিদ্যুতের উৎপাদন সক্ষমতা ৬০ হাজার মেগাওয়াটে তোলার লক্ষ্য রয়েছে। সেজন্য স্থানীয় ও বিদেশী বিভিন্ন উৎস থেকে ঋণ নিয়ে বেশকিছু বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। তাছাড়া বিদ্যুৎ খাত পরিচালনা করতে গিয়ে সরকারি কোম্পানিগুলোর দায়দেনাও বেড়েছে। সব মিলিয়ে গত এক দশকে বিদ্যুৎ খাতের প্রকল্প বাস্তবায়ন ও রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানিগুলো পরিচালনা করতে গিয়ে খাতটিতে মোট দায়দেনার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ১৮ হাজার কোটি টাকার বেশি। মূলত বিদেশী ঋণে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করতে গিয়েই দেশের বিদ্যুৎ খাতে মোট দায়দেনার বৃহদংশই তৈরি হয়েছে। সরকারের কাছে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর দেনার পরিমাণ এবং বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের জন্য গৃহীত বিদেশী ঋণের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, বিদ্যুৎ খাতে সরকারের মোট দায়দেনার পরিমাণ ২ লাখ ১৮ হাজার ৬৪৪ কোটি টাকা। তার মধ্যে খাতসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর সরকারি বকেয়া পরিশোধ বাকি রয়েছে ৭৮ হাজার ৯১ কোটি টাকা। ওই বকেয়া বিপিডিবির সবচেয়ে বেশি। সংস্থাটির সরকারি বকেয়া পরিশোধ বাকি রয়েছে ৬০ হাজার কোটি টাকার বেশি। বাকি ১ লাখ ৪০ হাজার ৫৫৩ কোটি টাকার দায় বিদেশী ঋণে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করতে গিয়ে তৈরি হয়েছে। তবে ওই বিপুল পরিমাণ ব্যয় ও দায়দেনা সত্ত্বেও দেশের বিদ্যুৎ পরিস্থিতির খুব একটা উন্নতি হয়নি। বর্তমানে দেশে বিদ্যুতের উৎপাদন সক্ষমতা সাড়ে ২৫ হাজার মেগাওয়াটের বেশি। কিন্তু ওই সক্ষমতার বিপরীতে প্রায় অর্ধেক বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে। আইপিপি-নির্ভর বিদ্যুৎ খাত চাহিদামাফিক বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে না পারায় সারা দেশে এখন লোডশেডিংয়ের মাত্রাও বেড়েছে, যা গৃহস্থালি ও শিল্প খাতসহ সার্বিক অর্থনীতিতেই ক্ষত বাড়াচ্ছে।
এদিকে বাংলাদেশে ডলারের বিনিময় হার বৃদ্ধির ধাক্কা শুধু বিদ্যুতের ইফনিটপ্রতি মূল্যেই সীমাবদ্ধ নয়। ২০০৪ সালে সংশোধিত প্রাইভেট সেক্টর পাওয়ার জেনারেশন পলিসি অব বাংলাদেশের তথ্যানুযায়ী বিদ্যুতের ট্যারিফ কাঠামোর অংশ হলো দুটি। তার একটি হলো ক্যাপাসিটি পেমেন্ট, অন্যটি এনার্জি পেমেন্ট। বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সক্ষমতার ভিত্তিতে দুটি ভাগে ক্যাপাসিটি পেমেন্ট পরিশোধ করা হয়। তার মধ্যে বৃহদংশ দেয়া হয় বিদেশী ঋণ পরিশোধ এবং বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ফিক্সড কষ্ট বা অপরিবর্তনশীল ব্যয় নির্বাহের জন্য। তারও বড় একটি অংশ শুরুতেই ডলারে নির্ধারিত হয়। ওই ব্যয়ও ডলারের ওঠানামার সঙ্গে সংগতি রেখে টাকায় পরিশোধ করা হয়। আর এনার্জি পেমেন্টের আওতায় পরিশোধ করা হয় বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পরিবর্তনশীল ব্যয়। তার মধ্যে পরিচালন, রক্ষণাবেক্ষণ ও জ¦ালানির ব্যয় অন্তর্ভুক্ত। আর তা দেশী মুদ্রায় পরিশোধ করা হলেও বিশ্ববাজারে জ¦ালানি মূল্যের ওাানামা ক্ষেত্রে বড় প্রভাবকের ভূমিকা রাখে। সব মিলিয়ে ডলারের বিনিময় হার বৃদ্ধি দেশের আইপিপি-নির্ভর বিদ্যুৎ খাত নিয়ে বড় ধরনের আশঙ্কা তৈরি করছে। গত অর্থবছরে বিপিডিবির বিদ্যুৎ ক্রয় বাবদ মোট প্রাক্কলিত ব্যয় ছিল ৫৯ হাজার ৩১৯ কোটি টাকা। তার মধ্যে শুধু আইপিপি ও এসআইপিপিগুলোকে পরিশোধের জন্য ব্যয়ের পরিমাণ ধরা হয়েছিল ৩৭ হাজার ৯৬৩ কোটি টাকা, যা মোট প্রাক্কলিত ব্যয়ের প্রায় ৬৪ শতাংশ।
অন্যদিকে আইপিপির উদ্যোক্তাদে দাবি, ডলারের বিনিময় হার বৃদ্ধির কারণে তারাও লোকসানে আছে। এ প্রসঙ্গে বেসরকারি বিদ্যুৎ খাতের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার অ্যাসোসিয়েশনের (বিআইপিপিএ) প্রেসিডেন্ট ইমরান করিম জানান, ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে উদ্যোক্তারা ব্যাপক হারে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। মূলত জানুয়ারি থেকেই উদ্যোক্তারা ক্ষতির সম্মুখীন হেিছ। কারণ বিপিডিবি জানুয়ারির জ¦ালানি তেলের খরচ মার্চে দেয়ার কথা থাকলেও তা মে মাসে দিয়েছে। আর জানুয়ারিতে ডলারের যে বিনিময় মূল্য ছিল ওই হারেই অর্থ পরিশোধ করা হয়েছে। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) সিলিং রেট অনুযায়ী ডলারের দাম ৯৫ টাকা বেঁধে দেয়া হলেও খোলাবাজারে তার দাম আরো বেশি। ফলে সেখানে একটি বড় ব্যবধান রয়েছে। তবে সরকারের সঙ্গে যে চুক্তি রয়েছে সেখানে ক্ষতিপূরণের বিষয়ে কিছু ধারা রয়েছে। বর্তমানে ওই ধারা অনুসারে সরকারের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ পাওয়ার জন্য কাজ করা হচ্ছে। তাতেও উদ্যোক্তাদের পুরো ক্ষতি পোষানো সম্ভব হবে না। মুদ্রার অবমূল্যায়নের কারণে যে ক্ষতি হচ্ছে তা জানিয়ে বিপিডিবিকে ইতোমধ্যে চিঠি দেয়া হয়েছে। কিন্তু এখনো ও চিঠির কোনো জবাব আসেনি।