নিজস্ব প্রতিবেদক :
দেশের কৃষকদের অর্থায়নকারী প্রধান প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক (বিকেবি)। বিভিন্ন সময়ে সরকার এ ব্যাংকের মাধ্যমে কৃষিঋণ ও সুদ মওকুফ করায় কৃষক স্বস্তি পেলেও ব্যাংকটি নিজেই ‘স্বস্তিতে’ নেই। সর্বশেষ হিসেবে এর মূলধন ঘাটতির পরিমাণ ১১ হাজার ৮৪৪ কোটি টাকা। ব্যাংটিতে একদিকে বিপুল অঙ্কের মূলধন ঘাটতি তৈরি হয়েছে, ফলে গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ী ঋণ দিতে ব্যর্থতা। অন্যদিকে বাণিজ্যিক মুনাফার চেয়ে সামাজিক দায়বদ্ধতা ও সরকারের উন্নয়ন কর্মসূচিকে বেশি গুরুত্ব দিতে গিয়ে ব্যাংকটি বাজারভিত্তিক আয়ও করতে পারছে না। এর অন্যতম কারণ, বিভিন্ন সময়ে সরকার কৃষিঋণ ও সুদ মওকুফ করলেও ব্যাংকে তার ক্ষতিপূরণের অর্থ পরিশোধ করেনি। এ রকম আরও কিছু রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ভার টানতে গিয়ে ধুঁকছে ব্যাংকটি। কৃষি ব্যাংকের দীর্ঘদিনের কার্যক্রম বিশ্নেষণে এমন চিত্র উঠে এসেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, কৃষি খাতে ঋণপ্রবাহ বাড়াতে বিশেষ আইনে প্রতিষ্ঠা করা হয় কৃষি ব্যাংক। কিন্তু মূল উদ্দেশ্য থেকে সরে আসায় ব্যাংকটির বিতরণ করা ঋণ কাক্সিক্ষত হারে আদায় হচ্ছে না। ফলে খেলাপি ঋণ বেড়ে প্রভিশন ও মূলধন ঘাটতি সৃষ্টি হয়েছে। এতে লোকসান বৃদ্ধিসহ নানা সংকট দেখা দিয়েছে ব্যাংকটিতে। দেশের পুরো ব্যাংকিং খাতে মূলধন ঘাটতিতে শীর্ষে আছে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক। এ ছাড়া খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির পাশাপাশি প্রভিশন ঘাটতিও রয়েছে। দুর্যোগসহ বিভিন্ন পরিস্থিতিতে কৃষকদের সহায়তায় সরকারি সিদ্ধান্তে কৃষিঋণ ও সুদ মওকুফ করে বিকেবি। এতে কৃষক স্বস্তি পেলেও স্বস্তিতে নেই ব্যাংক। বড় অঙ্কের মূলধন ঘাটতিতে পড়ায় ব্যাংকটি এখন গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ী ঋণ দিতে পারছে না। এ ছাড়া কৃষকদের অর্থায়নকারী ব্যাংক হলেও হঠাৎ করে ২০১০ সালে বিকেবি শিল্প খাতে বড় অঙ্কের ঋণ বিতরণ শুরু করে। পোশাকশিল্প, কোল্ডস্টোরেজসহ আরও কিছু বড় শিল্পে ঋণ দেয়। এই ঋণের পরিমাণ ১ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। এসব ঋণ সময়মতো আদায় না হওয়ায় ব্যাংকের খেলাপি ঋণ অনেক বেড়ে গেছে। বর্তমানে খেলাপি ঋণের বড় অংশই শিল্প খাতের।
জানা গেছে, ১৯৮৬ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত কয়েকটি সরকার জনগণের কাছে জনপ্রিয় হতে গিয়ে ব্যাংকটিকে ভঙ্গুর অবস্থায় ফেলেছে। দায়িত্বশীল কয়েকটি সূত্র জানিয়েছে, ব্যাংকটি গত সেপ্টেম্বরে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে পুনঃমূলধনীকরণ সহায়তা চেয়েছে। তবে নগদ টাকা চায়নি। চেয়েছে ১০ বছর মেয়াদি জিরো কুপন বন্ড। এটি ৪ শতাংশ সুদের বন্ড। অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে এ আবেদন করেছে কৃষি ব্যাংক। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ আবেদনটি বিবেচনার জন্য অর্থ বিভাগে পাঠিয়েছে।
আবেদনে বলা হয়, বর্তমান যে মূলধন ঘাটতি তার অন্যতম কারণ দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত লোকসান। এ ছাড়া বাজারভিত্তিক সুদহার বিবেচনা না করে ধারাবাহিকভাবে হ্রাসকৃত সুদহারে ঋণ বিতরণও ব্যাংকের দুর্বল পরিস্থিতির জন্য দায়ী। সরকারি সিদ্ধান্তের কারণে তহবিল ব্যয়ের চেয়ে কম সুদে ঋণ বিতরণ করে ব্যাংকটি। এজন্য প্রতি বছর বিপুল পরিমাণে লোকসান দিতে হয়।
আবেদনে আরও বলা হয়, কৃষি ব্যাংক তুলনামূলক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ খাতে অর্থায়ন করে থাকে। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ও গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙ্গা রাখতে এ কর্মকৌশল সরকারই নির্ধারণ করেছে। বাংলাদেশের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগপূর্ণ দেশে শস্যঋণ অনেক ঝুঁকিপূর্ণ। এ ব্যাংকের ঋণ পোর্টফলিওর ৮৫ ভাগই কৃষিঋণ। প্রায়ই বন্যা, খরা, নদীভাঙনসহ বিভিন্ন কারণে ফসলহানি ঘটে। বাজারজাতকরণও ব্যাহত হয়। এতে উৎপাদকরা যেমন ঋণ পরিশোধ করতে পারেন না, তেমনি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও রুগ্ন হয়ে পড়ে। এ বিষয়ে কৃষি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শিরীন আখতার ওই বলেন, মূলধন ঘাটতি পূরণে বন্ড ইস্যুর জন্য যে আবেদন করা হয়েছে, এখনও তার অনুমোদন পাওয়া যায়নি।
তবে শুধু ভর্তুকির ঘাটতি এবং কম সুদে ঋণ বিতরণের কারণেই কৃষি ব্যাংক সমস্যায় পড়েছে, তা মানতে চান না আর্থিক খাতের বিশ্নেষকরা। তারা বলছেন, ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনায়ও নানা দুর্বলতা ছিল। এ পরিস্থিতি থেকে বের হতে ভালো গ্রাহক নির্বাচন, প্রকৃত কৃষি খাতে ঋণ বিতরণ এবং কার্যকর ঋণপণ্য তৈরির পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
কৃষি ব্যাংকের এ পরিস্থিতির বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, কৃষি ব্যাংকের ভঙ্গুর পরিস্থিতি পুরোনো। বাংলাদেশ ব্যাংকও কয়েক বার মূলধন সহায়তা দিয়েছে। তিনি বলেন, ভর্তুকি না পাওয়া বা কম সুদে ঋণ দেওয়া কৃষি ব্যাংকের নাজুক পরিস্থিতির একটি কারণ। তবে এটি সামগ্রিক দুর্বলতার একমাত্র কারণ নয়। কৃষির নামে অনেক বড় ঋণ দেওয়া হয়েছে, যেগুলো পরে খেলাপি হয়ে গেছে। যাচাই-বাছাই করে প্রকৃত গ্রাহককে ঋণ দেওয়া হয়নি। আবার কৃষকের ঋণে মধ্যস্বত্বভোগী ঢুকে পড়েছে। এসব কারণেই ব্যাংকটি সংকটে পড়েছে।
কৃষি ব্যাংকের একজন সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, মূলধন ঘাটতির প্রধান কারণ হচ্ছে কষ্ট অব ফান্ড বা তহবিল ব্যয়ের তুলনায় কম সুদে ঋণ বিতরণ। সরকার কম সুদে কৃষি ঋণ বিতরণের নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্রতিষ্ঠার শুরু থেকে কৃষি ব্যাংক কম সুদে ঋণ বিতরণ করে আসছে। এ কারণে লোকসান হচ্ছে। দীর্ঘদিনের লোকসানের কারণে মূলধন ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এ ছাড়া সরকারি সিদ্ধান্তে মওকুফ করা ঋণ ও সুদের পুনর্ভরণ সময়মতো না পাওয়ার কারণে ব্যাংকটি মূলধন ঘাটতিতে পড়েছে।
এছাড়া ২০১০ সালে হঠাৎ করেই ব্যাংকটি শিল্প খাতে বড় ঋণ বিতরণ শুরু করে। পোশাক শিল্প, কোল্ডস্টোরেজসহ আরও কিছু বড় শিল্পে ঋণ দেয়। এতে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ হঠাৎ অনেক বেড়ে যায়। বর্তমানে যে খেলাপি ঋণ রয়েছে তার বেশিরভাগই শিল্প খাতে। আবার ব্যাংকটির তহবিল ব্যয়ও বেশি। গত জুনের হিসাব অনুযায়ী, ব্যাংকটির কষ্ট অব ফান্ড বা তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয় ৮ দশমিক ১০ শতাংশ। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক কৃষিঋণের সর্বোচ্চ সুদহার ৮ শতাংশ নির্ধারণ করে দিয়েছে। কৃষি ব্যাংক অনেক ক্ষেত্রে ৮ শতাংশের কমেও ঋণ বিতরণ করছে। ফলে ব্যাংকের লোকসান অবধারিতভাবেই হচ্ছে।