নিজস্ব প্রতিবেদক :
বাংলাদেশে বর্তমানে এক কোটি ৮০ লাখ মানুষ থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত। থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিকে বোন ম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্টেশন (অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন) করে সুস্থ করে রাখা কঠিন। এর জন্য প্রয়োজন সামাজিক বিপ্লব। বিয়ের আগে থ্যালাসেমিয়া আছে কিনা সেটা জেনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ রোগটিকে অনেকটাই কমিয়ে ফেলেছে। বাংলাদেশেও এ রোগীর সংখ্যা কমাতে হলে জাতীয় পরিচয় পত্রে (এনআইডি কার্ড) তথ্য সংযোজন কিংবা নিয়ের আগেই আক্রান্ত কিনা সেটা জেনে নেওয়া জরুরি। রোববার সকাল সাড়ে ১১টায় বিশ্ব থ্যালাসেমিয়া দিবস উপলক্ষে আয়োজিত এক সেমিনারে এসব কথা বলেন বক্তারা। রাজধানীর শেরে বাংলা নগরে বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের থ্যালাসেমিয়া সেন্টারের উদ্যোগে এ সেমিনারের আয়োজন করা হয়। সেমিনারে বক্তব্য দেন বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের পরিচালনা বোর্ডের সভাপতি অধ্যাপক ডাক্তার মোহাম্মদ সহিদুল্লা। তিনি বলেন, এখানে থ্যালাসেমিয়া রোগীদের জন্য স্ক্রিনিংয়ের ব্যবস্থা করা হবে।
‘এ রোগের চিকিৎসার চেয়ে সচেতনতা অনেক বেশি জরুরি। এ সময় থ্যালাসেমিয়া রোগীরা যেন আরও ভালোভাবে চিকিৎসা নিতে পারে সেজন্য সবাইকে সহযোগিতার আহ্বান জানান তিনি।’ থ্যালাসেমিয়া সেন্টারের মহাসচিব অধ্যাপক ডা. মো. সেলিমুজ্জামান বলেন, প্রতিবছর আমরা হাসপাতালের থ্যালাসেমিয়া রোগীদের প্রায় ১২ লাখ টাকা দেওয়ার চেষ্টা করি। এখানে নামমাত্র খরচে তাদের চিকিৎসা দিয়ে থাকি আমরা। এ সময় রোগীদের অযথা ট্রান্সপ্ল্যান্টেশন না করার জন্য চিকিৎসকদের প্রতি অনুরোধ জানান তিনি। ইরানের দুটি প্রদেশে থ্যালাসেমিয়ার ব্যাপকতার কথা উল্লেখ করে ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ইরানের দুটি প্রদেশে তারা নিজেদের সম্প্রদায়ের মধ্যে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়। তাদের কোনো নিয়মের মধ্যে আবদ্ধ রাখা যায় না। যার ফলে সেখানে থ্যালাসেমিয়া রোগের নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হয় না। তিনি বলেন, ম্যারেজ কাউন্সিলরের অনুমতি ছাড়া যদি বিয়ে না হয় তবে থ্যালাসেমিয়া অনেকটাই কমে যাবে। ছেলেমেয়েদের মধ্যে প্রেম হয়ে গেলে কেউ আর দেখবেনা যে থ্যালাসেমিয়া রোগী কি না। এর জন্য প্রয়োজনে মাধ্যমিক কিংবা প্রাথমিক পর্যায়ে পরীক্ষা করতে হবে। দেশে ৩ লাখ মানুষের বোন ম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন শুধু সচেতনতার। বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের পেডিয়াট্রিক হেমাটোলজি অ্যান্ড অনকোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. আফিকুল ইসলাম বলেন, সারা পৃথিবীর লোকসংখ্যার ৫ ভাগ মানুষ থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত। থ্যালাসেমিয়া সম্পর্কে আমরা সচেতন নই। দেশে এর চিকিৎসা ও ট্রান্সপ্ল্যান্টেশনের সুযোগ কম। আমাদের দরকার এই রোগের প্রতিরোধ। সিএমএইচ হাপাতালের অধ্যাপক কর্নেল (অব.) ডা. শরমিন আরা ফেরদৌস বলেন, দৃঢ় প্রত্যয় নিয়েই হেমাটোলজিতে কাজ করা শুরু করি। থ্যালাসেমিয়া ট্রান্সপ্ল্যান্টেশন অনেক ব্যয়বহুল ছিল। থ্যালাসেমিয়া রোগীদের লাল কষ্ট, নীল কষ্ট কমানোর চেষ্টা করছি আমরা। আমরা জোরালোভাবে এর জন্য কাজ করছি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এডিজি অধ্যাপক ডা. আমিরুল মের্শেদ খসরু বলেন, থ্যালাসেমিয়া চিকিৎসার জন্য কিছুই বলার দরকার নেই। এর জন্য সবচেয়ে বেশি জরুরি হলো প্রতিরোধ। ইতালিতে সবচেয়ে বেশি থ্যালাসেমিয়ার রোগী ছিল। ইরানে একটা ম্যারেজ কাউন্সিলর করে রেখেছে সেখানে অনুমতি নিতে হয়। বাংলাদেশের জন্যও এটি সবচেয়ে উপযোগী পদ্ধতি। বিয়ে করার আগে শুধু একজন ম্যারেজ কাউন্সিলরের অনুমতি নিয়ে বিয়ে করলে, ১০ বছর পর দেখা যাবে ৫০ ভাগ থ্যালাসেমিয়া রোগী কমে গেছে। আমরা ১৮ কোটি মানুষের পরীক্ষা করতে পারবো না। শুধু বিয়ের আগে জেনে বিয়ে করলেই ভবিষ্যতে এই রোগীর সংখ্যা অনেকটাই কমে যাবে। এর আগে নিজের কষ্টের কথা জানিয়ে থ্যালাসেমিয়া রোগী কামরুন নাহার মুকুল বলেন, রোগটি ধরা পড়ার পর থেকেই আমাদের কষ্টের জীবন শুরু হয়। নানা ঝুঁকি নিয়েই রক্ত নিতে হয়। প্রতি মুহূর্তেই মৃত্যু নিয়ে বসবাস করি আমরা। এ রোগের চিকিৎসাকে সহজ ও ওষুধের মূল্য কমানোর আহ্বান জানান তিনি। এ সময় রোগীদের সঙ্গে ডাক্তারদের ভালো আচরণ করারও অনুরোধ জানান তিনি। সেমিনারে এছাড়াও বক্তব্য দেন বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডাক্তার মো. বেলায়েত হোসেন, জুনিয়র কনসালটেন্ট ডা. নিলুফার আখতার বানু চৌধুরী ও ডাক্তার আবদুল ওহাব। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের ডাক্তার ও শিক্ষার্থীসহ থ্যালাসেমিয়া রোগীরা।