নিজস্ব প্রতিবেদক :
বাংলাদেশ সরকারকে বিভিন্ন খাতে লোকসান দিতে হয়। ভর্তুকি দিয়ে চালাতে হয় এসব খাত। তবে স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশ সরকারকে সবচেয়ে বেশি লোকসান গুনতে হয়েছে রেল খাতে। তবে প্রথমদিকে রেল খাত বেশ লাভজনকই ছিল। ধীরে ধীরে দুর্নীতির ঘুণ ধরে এটি লোকসান খাতে চলে যায়। লোকসানের সেই সিলসিলা এখনো অব্যাহত আছে। নানা প্রচেষ্টা চালিয়েও রেল খাতকে আজও লাভজনক খাতে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়নি। লোকসান পাল্লা দিয়ে প্রতিবছর যেন বাড়ছে। লাগাম টানতে নতুন যাত্রীবাহী ট্রেন চালু, প্রকল্প গ্রহণেও কাক্সিক্ষত ফল আসছে না। দেশে মোট যাত্রী চলাচলে রেলের ভাগ মোটে ৮ শতাংশ। যদিও স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে এ হার ছিল ৩০ শতাংশ। গত পাঁচ দশকে উন্নয়ন যাত্রায় দেশ এগিয়ে গেলেও যাত্রী পরিবহনে ধারাবাহিকভাবে পিছিয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। একই সঙ্গে মোট পণ্য পরিবহনে রেলের অবদান ২৮ থেকে নেমে এসেছে ১৬ শতাংশে। বিপুল বিনিয়োগের পরও ফেরানো যাচ্ছে না রেলের হারানো গৌরব। উল্টো প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা, ভুল নীতি ও উন্নয়ন সহযোগীদের কৌঁসুলি ভূমিকা দেশের রেলওয়ে খাতকে ক্রমেই খাদের কিনারে ঠেলে নিয়ে গিয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। যদিও রেলের কর্তাব্যক্তিরা দাবি করছেন, খাতটির উন্নয়নে তাদের নেয়া মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে এ চিত্র বদলে যাবে। ১৯৯০ থেকে ২০১০ পর্যন্ত সময়টুকু বাদ দিয়ে স্বাধীনতার পর এ পর্যন্ত জাতীয় বাজেটে পরিবহন খাতে বরাদ্দের ২০-৩০ শতাংশ পর্যন্ত অর্থ পেয়েছে রেল খাত। বিশেষ করে ২০১১ সালে আলাদা মন্ত্রণালয় গঠনের পর রেল খাতে বরাদ্দ বাড়তে শুরু করে। চলতি অর্থবছর রেলে বরাদ্দের পরিমাণ ১৩ হাজার ৫৫৮ কোটি টাকা। পাঁচ বছর ধরে প্রায় এ হারে বরাদ্দ পেয়ে আসছে খাতটি। এসব টাকায় কেনা হয়েছে নতুন ইঞ্জিন-কোচ। বসানো হয়েছে নতুন লাইন। আধুনিকায়ন হয়েছে স্টেশন ও সিগন্যালিং ব্যবস্থার। কিন্তু যাত্রী ও পণ্য পরিবহনে এসব উন্নয়নের ছাপ খুব একটা লাগেনি। জাতিসংঘের ইকোনমিক অ্যান্ড সোস্যাল কমিশন ফর এশিয়া অ্যান্ড দ্য প্যাসিফিকের (ইএসসিএপি) তথ্য অনুযায়ী, স্বাধীনতার পর ১৯৭৫ সালে দেশে সড়ক, রেল ও নৌপথে এমন যাত্রার সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৭০০ কোটি। এর ৩০ শতাংশ বা প্রায় ৫১০ কোটি পিকেএম ছিল রেলপথে। ২০১৯ সালে দেশে প্যাসেঞ্জার কিলোমিটার যাত্রীর সংখ্যা ছিল সাড়ে ১৯ হাজার কোটি। এর মধ্যে রেলওয়ে পরিবহন করেছে প্রায় দেড় হাজার পিকেএম, যা যাত্রার মাত্র ৮ শতাংশ। যাত্রীর মতোই রেলওয়েতে কমেছে পণ্য পরিবহন। ১৯৭৫ সালে যেখানে দেশের মোট পরিবাহিত পণ্যের ২৮ শতাংশই পরিবহন হয়েছিল রেলপথে। ২০১৯ সালে তা নেমে এসেছে ১৬ শতাংশে। রেলে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগেরও ঘাটতি ছিল বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন অনেক যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ। তাঁদের মতে, রেলে গত এক দশকে মোটা অংকের বিনিয়োগ হয়েছে ঠিকই, কিন্তু সেসব বিনিয়োগ হয়েছে বিচ্ছিন্নভাবে ও প্রকল্পকেন্দ্রিক। ফলে এসব বিনিয়োগ যাত্রী ও পরিবহনে খুব একটা পরিবর্তন আনতে পারেনি। উল্টো অনেক সময়ই তা রূপ নিয়েছে মন্দ বিনিয়োগে। দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রেলপথ ঢাকা-চট্টগ্রামের একটি বড় অংশ ৪ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ডাবল লাইনে রূপান্তর করা হয়েছিল। যদিও লাইন আগের মতোই মিটার গেজ থেকে যায়। এ প্রকল্পের দুই অংশের বাস্তবায়ন শেষ হয় ২০১৫ ও ২০১৮ সালে। কয়েক বছর যেতে না যেতেই এখন রেলপথটি আবার ডুয়াল গেজ করার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।
এছাড়া কোটি কোটি টাকা খরচ করে রেলের ইঞ্জিন কেনা হলেও অনেকগুলোরই মান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বছরের পর বছর ব্যবহার না করেই নষ্ট করা হয়েছে এন্টারপ্রাইজ রিসোর্স প্ল্যানিং (ইআরপি) সরঞ্জাম। যেখানে সরকার সিদ্ধান্ত দিয়েছে পর্যায়ক্রমে দেশের মিটার গেজ রেলপথ তুলে দেয়া হবে, সেখানে কেনা হচ্ছে সাড়ে ৪০০ মিটার গেজ ওয়াগন। রেলপথ নির্মাণ ও সংস্কার, স্টেশন ভবন আধুনিকায়ন, রোলিং স্টক সংগ্রহসহ বেশির ভাগ প্রকল্পেই এমন সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাব রয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের ভাষ্যমতে, গত এক দশকে রেলে ২০ হাজার কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ হলেও এখনো পুরনো ইঞ্জিন-কোচ, নড়বড়ে রেলপথ, ঝুঁকিপূর্ণ সেতু, লোকবল সংকট, যাত্রীসেবায় অব্যবস্থাপনা-অনিয়ম-দুর্নীতিসহ নানা সমস্যা রেলওয়েতে প্রকট। রেল খাতে বিনিয়োগে সমন্বয়ের ঘাটতি এই খাতকে ঘুরে দাঁড়াতে দেয়নি। কোন কাজটি আগে করতে হবে, কোনটি পরে হবে তা সঠিকভাবে নির্ধারণ করা হচ্ছে না। রেলের আজকের এ অবস্থার জন্য প্রধানত তিনটি বিষয় দায়ী। প্রথমত, প্রতিষ্ঠান হিসেবে রেলের সক্ষমতার যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। যাত্রীদের স্বাচ্ছন্দ্যময় যাতায়াতের জন্য সংস্থাটি এখনো উপযোগী হয়ে উঠতে পারেনি। দ্বিতীয়ত, সরকারের ভুল নীতি। অতীতের সরকারগুলো রেলের উন্নয়নের বদলে সড়কপথে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। দীর্ঘদিন উন্নয়নবঞ্চিত থাকার একটা শূন্যতা রেল খাতে তৈরি হয়েছে, যা থেকে এখনো রেল বের হতে পারেনি। তৃতীয়ত, উন্নয়ন সহযোগীদের কৌশলগত ভূমিকাও রেলকে পিছিয়ে দিয়েছে। ব্যবসায়িক স্বার্থের কারণে তারা সড়কপথের উন্নয়নের জন্য আমাদের সহায়তা করেছে, বঞ্চিত হয়েছে রেল খাত।
শুধু কি লোকসান? রেলমন্ত্রী রেলকে সেবামূলক বললেও সেবা বাড়েনি মোটেও। সুবর্ণ এক্সপ্রেস ট্রেন ২০০০ সালে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে যাতায়াত করত পাঁচ ঘণ্টায়। ১৬ বছর পর এখন ওই ট্রেনের নির্ধারিত সময় ছয় ঘণ্টা। কখনো কখনো এই সময়ও মেনে চলে না। নতুন কোচ দিয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম পথে চালু করা সোনার বাংলা এক্সপ্রেস ট্রেনেরও নির্ধারিত সময় পৌনে ছয় ঘণ্টা। উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের ট্রেনের যাত্রা সময় তো আরও বেশি। ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথে প্রায় চার হাজার কোটি টাকা খরচ করে নতুন লাইন নির্মাণ করা হয়েছে। চট্টগ্রামের চিনকি আস্তানা থেকে আশুগঞ্জ পর্যন্ত বিদ্যমান রেলপথ সংস্কারের ৩০০ কোটি টাকার প্রকল্প প্রায় শেষ। অথচ এই পথ দিয়ে চলা কোনো ট্রেনের গতি বাড়েনি।
তবে কর্তৃপক্ষের ভাষ্য, পণ্যবাহী ট্রেনই কেবল লোকসান কমিয়ে লাভের মুখ দেখাবে। এজন্য ঢাকা-পায়রা বন্দর-কুয়াকাটা রেলপথ প্রকল্প হবে অন্যতম। ২১৫ কিলোমিটার এ রেলপথ নির্মাণের মধ্য দিয়ে লাভের সঙ্গে দক্ষিণাঞ্চলের দরজাও খুলবে।
জানা যায়, বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে রেলেপথে মাত্র ৪ শতাংশ পণ্য বহন করা হয়। তাতেই যাত্রীবাহী ট্রেনের প্রায় দুই-চতুর্থাংশ টাকা আয়। পায়রা ও মোংলা বন্দর রেলে যুক্ত হলে যাত্রী আয়ের ৫ গুণ বেশি আয় হবে পণ্যবাহী ট্রেনে। এ ক্ষেত্রে বন্দর থেকে দ্রুত পণ্য পৌঁছানোসহ ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ পণ্যবহন বাড়াতে হবে।
দুর্নীতি, অদক্ষতা ও অপরিকল্পিত প্রকল্প গ্রহণ বন্ধ হলে আশা করা যায় রেলের এই দুর্দিন একদিন কাটবে। তখন আর ভর্তুকির ইঞ্জিন দিয়ে ট্রেনকে টানতে হবে না।