নিজস্ব প্রতিবেদক :
করোনার কারণে বেসরকারি অনেক চাকরিজীবি দীর্ঘদিন কর্মহীন জীবন কাটিয়েছেন, এবং এখনো অনেকে কর্মহীনতায় দিন কাটাচ্ছেন। আবার আর্থিক লোকসান সামাল দিতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাদের ব্যয় সংকোচন করছে নানাভাবে লকডাউন না থাকা সত্ত্বেও। যার প্রভাব পড়ছে সমাজের সাধারণ মানুষের প্রাত্যহিক জীবনযাত্রায়। সঞ্চিত অর্থ দিয়ে চলার সার্মথ্য এ দেশে খুবই কম মানুষের রয়েছে। তাই স্বাভাবিকভাবেই চাল আনতে পান্তা ফুরায় মানুষের কাছে জীবন এখন করোনার চেয়ে ভয়ংকর হয়ে পড়ছে বাজার পরিস্থিতির কারনে। নিত্যপণ্যের দাম সাধারণ মানুষের আয়ত্বের বাইরে চলে যাওয়ার পরও ব্যাপারটিকে স্বাভাবিক হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য এবং কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক। শুক্রবার রাজধানীর খামারবাড়িতে বিশ্বখাদ্য দিবস উপলক্ষে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘পণ্যের চাহিদা যদি বেশি হয় এবং সেই তুলনায় যদি সরবরাহ কম থাকে তাহলে পণ্যের দাম কিছুটা বাড়বেই। হাজার চেষ্টা করেও তখন দাম কমানো সম্ভব নয়। যেমন বর্তমানে আলুর দাম কম, এখন কি সিন্ডিকেট করে দাম বাড়ানো সম্ভব তারপরেও আমরা সরবরাহ বৃদ্ধি এবং মনিটরিংয়ের মাধ্যমে চেষ্টা করি বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে। যারা ব্যবসা করেন তারা আরও বেশি মুনাফা করতে চাইবেন এটাই স্বাভাবিক। সারা পৃথিবীতেই এমন হয়।‘ তিনি আরও বলেন, একটা জিনিস আমাদের সবাইকে বিবেচনায় নিতে হবে, প্রতিবছর ২৪ লাখ জনসংখ্যা বাড়ছে। পৃথিবীর বহু দেশে ২৪ লাখ মানুষ নেই। আবার আমাদের কৃষি জমির পরিমাণ কমে যাচ্ছে। একই জমিতে শিল্প কলকারখানাও গড়ে তোলা হচ্ছে। দেশের উন্নয়নের ফলে মানুষের আয় বাড়ছে। জমি কমে যাওয়ার পরেও আমরা কিন্তু উৎপাদন বাড়িয়েছি। হাঁস-মুরগি এবং পশু পালন, মৎস্য চাষের ফলে খাদ্যের ব্যবহার এবং চাহিদা বেড়েছে।
এটি সত্য যে দেশে কৃষিজাত পন্যে উৎপাদনে ঘাটতি নেই। কিন্তু ঘাটতি না থাকলেও কৃষক তার উৎপাদিত পণ্যের যথাযথ মূল্য পাচ্ছে না। বাজারে দাম লাগামহীনের কারণ হিসাবে উঠে আসছে মধ্যস্বত্বভোগীদের নাম। এ মধ্যস্বত্বভোগীদের দাপটের কাছে অবরুদ্ধ সকল আইন নিয়ম নীতি। কিন্তু তারা কি করে এত প্রভাবশালী তার ব্যাখ্যা দিতে পারে না সরকার ও প্রশাসন। কৃষিপণ্য বাজারজাতকরণে এই মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য লাগামহীন পর্যায়ে পৌঁছেছে। সরকার তাদের থামাতে পারছে না কোনোভাবেই। কৃষক পর্যায় থেকে খুচরা বাজারে আসতে কৃষিপণ্য চার-পাঁচ হাত বদল হয়। এতে ভোক্তা পর্যায়ে পণ্যের মূল্য তিন-চার গুণ দামে বিক্রি হচ্ছে। ফলে লাভের সব টাকা চলে যায় মধ্যস্বত্বভোগীদের হাতে। কৃষি বিপণন অধিদফতরের নানা পদক্ষেপেও ঠেকানো যাচ্ছে না মধ্যস্বত্বভোগীদের।
মধ্যস্বত্বভোগী ছাড়াও মৌসুমের সময় স্থানীয় ব্যবসায়ীরা কম মূল্যে কৃষকের কাছ থেকে কৃষিপণ্য কিনে নিজেদের কাছে ধরে রাখছে। পরে তারা সেগুলো ধীরে ধীরে দাম বাড়িয়ে বাজারে ছাড়ে।
কৃষি বিপণন অধিদপ্তর সূত্র জানায়, উৎপাদনকারী থেকে পণ্য ভোক্তা পর্যায়ে আসতে বেশ কয়েকটি ধাপ পেরোতে হয়। এর মধ্যে রয়েছে- স্থানীয় ব্যবসায়ী, স্থানীয় মজুদদার, স্থানীয় খুচরা বাজার, বেপারি, পাইকারি ব্যবসায়ী, কেন্দ্রীয় বাজার বা টার্মিনাল, আড়তদার, প্রক্রিয়াজাতকারী, খুচরা বাজার, খুচরা ব্যবসায়ী ইত্যাদি। এ ছাড়া বিভিন্ন স্থানে চাঁদাবাজিও পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির অন্যতম একটি কারণ।
এ বিষয়ে কৃষি বিপণন অধিদফতরের উপ-পরিচালক দেওয়ান আশরাফুল হোসেনের ভাষ্য, মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য কোনোভাবেই বন্ধ করা যাচ্ছে না। অধিদফতরের পক্ষ থেকে নর্থ ওয়েস্ট ক্রপ ডাইভারসিফিকেশন প্রজেক্ট ও সাউথ ওয়েস্ট ক্রপ ডাইভারসিফিকেশন প্রজেক্টের মাধ্যমে কৃষকের মাঠ থেকে সরাসরি পণ্য রাজধানী ও রাজশাহীর খুচরা বাজারে পণ্য বিক্রির প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছিল। কিন্তু তেমন একটা কাজে আসেনি। কারণ বাজারের যেসব কৃষি পণ্য আসে তা সারা দেশ থেকে আনার পর একসঙ্গে মিশিয়ে একটি দাম নির্ধারণ করে বিক্রি হয়। কিন্তু কৃষকরা একেক দিন একেক জেলা থেকে পণ্য বাজারে নিয়ে আসতেন। সেখানে দেখা গেছে, কৃষকদের পণ্যের চেয়ে বাজারে পণ্যের দাম তুলনামূলক কম। তাই এ প্রজেক্ট কাজে আসেনি।
একইসাথে ব্যবসায়ীদের অধিক মুনাফা অর্জনের কাছে পরাজিত হচ্ছে সরকারের সকল ব্যবস্থা তাও অস্বীকার করার জো নেই। প্রকৃত পক্ষে করোনার কারনের লোকসান পুষিয়ে নিতে ব্যবসায়ীরা জুলুমবাজি করছে জনগণের উপর। সে সাথে এ ধরনের অনৈতিক কাজকে রুখে দেবার সব পদ্ধতি অন্ধ হয়ে আছে বলেই সব সম্ভবের দেশে পরিনত হচ্ছে বাংলাদেশ।
এই অধিক মুনাফালোভী ব্যবসায়ী ও মধ্যস্বত্বভোগীদের নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে কৃষিমন্ত্রী অবশ্য কিছুই বলেননি, বরং দেশের উত্তরাঞ্চলকে মঙ্গামুক্ত আখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, খাদ্যের দামের বিষয়টা আন্তর্জাতিক বাজারের ওপর নির্ভরশীল। খাদ্যের আন্তর্জাতিক বাজার মূল্য স্থানীয় বাজারের ওপর প্রভাব বিস্তার করে। এখন আশ্বিন কার্তিক মাস, এই সময়ে দেশে মঙ্গা শুরু হতো, কিন্তু আমরা মঙ্গা নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছি। খাদ্যের জন্য দেশে এখন আর হাহাকার নেই, খাদ্যের সংকট নেই, তবে খাবারের দাম একটু বেশি। বর্তমান সময়ে একজন শ্রমিক কিংবা রিকশাওয়ালা একদিনের আয় দিয়ে ১০ থেকে ১২ কেজি চাল কিনতে পারেন। সেটা কিনতে পারেন বলেই দেশের মানুষের মধ্যে খাদ্য নিয়ে হাহাকার নেই, মানুষ না খেয়ে নেই। কুড়িগ্রাম নীলফামারী অঞ্চলের মানুষ এখন বলে দেশে মঙ্গা নেই আমরা ভালো আছি।
দুঃখজনক হল সরকারের দিক থেকে সাধারণ মানুষের জীবন যাত্রা নিয়ে চিন্তা করার মত লোকের অভাব রয়েছে। তা না হলে বাজারে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রীর লাগামহীন দাম নিয়ন্ত্রণ করার ব্যবস্থা হত দ্রুত গতিতে। আমাদের মাননীয় মন্ত্রীরাও পরস্থিতির সুরাহা না করে এভাবে ধামাচাপা দিতেন না। এ দেশে যতক্ষণ পর্যন্ত কোন বিষয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী হস্তক্ষেপ না করে সে বিষয়ে সুরাহা হবার আশা করা ভুল। তাই বাজার পরিস্থিতি সামাল দিতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কোন আশার বানী শোনাবেন সে প্রত্যাশায় অপেক্ষামান আছে জনগন।
মাননীয় কৃষিমন্ত্রী অবশ্য সংবাদ সম্মেলনের পুরোটা সময় আশার বানী শুনিয়ে গেছেন। দেশের মানুষ যে ন খেয়ে নেই সে কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তিনি এও বলেন, ‘খাদ্যে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ কিনা সেটা আমরা বলছি না, কিন্তু আমাদের দেশে খাদ্যের উৎপাদন বাড়ছে। চালের দাম একটু বেশি হলেও, চাল নিয়ে দেশে অস্থিরতা নেই।‘
এদিকে, চাল, ডাল ও তেলসহ নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে সম্প্রতি বরিশালে মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়েছে। গণসংহতি আন্দোলন বরিশাল জেলা শাখার ব্যানারে নগরীর সদর রোডের অশ্বিনী কুমার হলের সামনে এই মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়।
জেলা গণসংহতি আন্দোলনের আহ্বায়ক দেওয়ান আবদুর রশিদ নিলুর সভাপতিত্বে মানববন্ধনে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন জেলা শাখার সহসভাপতি হাসিব আহমেদ, ইয়াসমিন সুলতানা ও আরিফুর রহমান প্রমুখ।
মানববন্ধনে বক্তারা চাল, ডালসহ নিত্য পন্যের মূল্য বৃদ্ধি ও সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রনের দাবী জানান। দ্রব্যমূল্য সহনীয় পর্যায়ে আনতে ব্যর্থ হলে জনগন রাস্তায় নেমে আসবে বলেও মানববন্ধনে হুঁশিয়ারী দেন জেলা গনসংহতি আন্দোলনের আহ্বায়ক দেওয়ান আবদুর রশিদ নিলু।