লায়লা খন্দকার
‘আমি খুব ভালো শিক্ষক, কারণ আমার ছাত্র-ছাত্রীদের ধমক কিংবা শাস্তি দিই না। তারা যদি কোনো কিছু বুঝতে না পারে, আমি তাদের বুঝিয়ে বলি।’ কথাগুলো চার বছর বয়সী একটি শিশুর। শিশুটি একজন ‘শিক্ষকের’ ভূমিকায় অভিনয় করছিল; আর ‘ছাত্র-ছাত্রীর’ ভূমিকায় তার মা-বাবা। এই খেলা দেখতে দেখতে আমি উপলব্ধি করলাম ছোট্ট এই শিশুটি, যে এখনো স্কুলেই যায়নি, তার মধ্যেও একজন ভালো শিক্ষকের গুণাবলি কী হওয়া উচিত, সে সম্পর্কে একটা ধারণা তৈরি হয়েছে। সেই সঙ্গে বুঝলাম যে এই বয়সেই শিশুটি ‘শাস্তি’ নামের ভয়ংকর বিষয়টি সম্পর্কে জানতে পেরেছে। শিশুদের প্রতি সহিংসতার বৈশ্বিক অবস্থা-সংক্রান্ত ইউনিসেফের প্রতিবেদন ‘এন্ডিং লিগালাইজড ভায়োলেন্স অ্যাগেইনস্ট চিলড্রেন গ্লোবাল প্রোগ্রেস রিপোর্ট ২০১৬’-এর তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে ২ থেকে ১৪ বছর বয়সী প্রায় ১০০ কোটি শিশু তাদের বাড়িতে শারীরিক শাস্তির শিকার হচ্ছে। প্রতিবছর বিশ্বে কয়েক হাজার শিশু শারীরিক শাস্তির কারণে মারা যায় এবং আরও কয়েক লাখ শিশু আহত হয়। ২০১৫ সালে প্রকাশিত ‘মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে ২০১২-২০১৩’ থেকে জানা যায়, বাংলাদেশে ১ থেকে ১৪ বছর বয়সী ৮২ দশমিক ৩ শতাংশ শিশু জরিপ-পূর্ববর্তী এক মাসে মানসিক নির্যাতন কিংবা শারীরিক শাস্তি পেয়েছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শিশুদের মা-বাবা, শিক্ষক, নিয়োগকর্তা কিংবা লালনপালনকারী ‘শৃঙ্খলা’ শেখানোর নামে তাদের শাস্তি দিয়েছেন। গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ টু অ্যান্ড অল করপোরাল পানিশমেন্ট অব চিলড্রেন কর্তৃক বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ১৫০টি গবেষণার বিশ্লেষণ থেকে জানা গেছে, শারীরিক শাস্তি প্রত্যক্ষভাবে স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদে শিশুর শারীরিক ক্ষতি করে এবং পরোক্ষভাবে তাদের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। আমরা আরও জেনেছি, শাস্তি শিশুর মধ্যে আগ্রাসী মনোভাব তৈরি করে। শিশু যাদের সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করে (মা-বাবা, শিক্ষক), তাঁরা যখন শিশুদের মারধর করেন, তখন তারা ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিগত সম্পর্কের মাঝে সহিংসতাকে স্বাভাবিক মনে করতে শেখে এবং বড় হলে নিজেরাও পরিবারের সদস্য ও অন্যদের সঙ্গে সহিংস আচরণ করতে পারে। বিশ্বের ৫৩টি দেশ সব ক্ষেত্রে শারীরিক শাস্তি আইন করে নিষিদ্ধ করেছে। বাংলাদেশ এখনো এই তালিকায় নেই। আমরা যদি সত্যিই শিশুদের অধিকার নিশ্চিত করতে চাই, তাহলে তাদের সব ধরনের শাস্তি দেওয়া নিষিদ্ধ হওয়া প্রয়োজন। এ লক্ষ্যে বাড়ি, স্কুল, কর্মক্ষেত্র, বিকল্প সেবাব্যবস্থা-সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানসহ অন্য সব ক্ষেত্রে শারীরিক এবং অবমাননাকর শাস্তি নিষিদ্ধ করে একটি নতুন আইন প্রণয়ন করতে হবে। এ ছাড়া শিশুদের অধিকার নিশ্চিত করতে এবং শাস্তিসহ সব ধরনের সহিংসতা থেকে সুরক্ষার গুরুত্ব বিষয়ে জনসচেতনতা বাড়ানো প্রয়োজন। মা-বাবা এবং শিক্ষকদের দক্ষতা বাড়ানো দরকার, যাতে তাঁরা শাস্তি ছাড়াই সন্তান বড় করতে এবং পড়াতে পারেন। সহিংস শাস্তি থেকে আইনি সুরক্ষা পাওয়া শিশুদের মৌলিক অধিকার। শিশুদের শাস্তি অনুমোদন করে এমন আইন বৈষম্যমূলক এবং আইনের অধীনে শিশুদের সমতার অধিকারের লঙ্ঘন। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার অন্যতম লক্ষ্য শান্তি ও নিরাপত্তা অর্জনের জন্য শিশুদের বিরুদ্ধে সব ধরনের সহিংসতার অবসানের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে এবং এর মধ্যে শিশুদের প্রতি শাস্তিও অন্তর্ভুক্ত। আইন যদি শিশুদের শারীরিক ও অবমাননাকর শাস্তি বন্ধ না করতে পারে, তাহলে শিশু সুরক্ষার কোনো ব্যবস্থাই কার্যকর হবে না। আইনগতভাবে শারীরিক শাস্তি পুরোপুরি নিষিদ্ধ করার যেকোনো উদ্যোগ বয়স্ক ব্যক্তিদের (মা-বাবা, শিক্ষক, নীতিনির্ধারক প্রমুখ) দ্বারা বাধার সম্মুখীন হয়। আমরা প্রায়ই শুনতে পাই বিভিন্ন আর্থসামাজিক অবস্থানে থাকা মা-বাবা শাস্তির পক্ষে বলছেন। তাঁরা বলেন, শিশুদের ‘শৃঙ্খলা’ শেখাতে হলে বা ‘মানুষ করতে’ হলে শাস্তি দিতেই হবে। মা-বাবা, শিক্ষক ও লালনপালনকারী অভিভাবকদের মধ্যে এই ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে যে শাস্তি শিশুদের সঠিক আচরণ শেখায়। বড়রা শিশুদের যা শেখাতে চান, শাস্তি দিলে সেটা তারা শেখে না। মা-বাবা যখন শিশুদের মারেন বা বকাঝকা করেন, শিশুরা তখন শুধু শাস্তি এড়ানোর কৌশল শেখে, কিন্তু কেন তাদের নির্দিষ্ট আচরণটি করা থেকে দূরে থাকতে হবে বা কোনো কিছু করতে হবে, সেটি তারা বুঝতে পারে না। ফলে তাদের শাস্তি দেওয়া হলো যে কারণে সেই আচরণ তারা আবারও করতে পারে। এর মানে হলো শিশুদের বড় করার ক্ষেত্রে শাস্তি কার্যকর কোনো ভূমিকা রাখে না। ‘মা-বাবা আমাদের মেরেছেন, কিন্তু তাতে আমাদের কোনো সমস্যা হয়নি, তাহলে আমরা নিজের সন্তানদের মারতে পারব না কেন?’ শারীরিক শাস্তি নিষিদ্ধ করা-সংক্রান্ত আলোচনায় এই মন্তব্য সবচেয়ে বেশি শোনা যায়। মা-বাবা যদি কখনোই না মারতেন, তাহলে তাদের জীবন কেমন হতো, সেটা জানা এখন আর সম্ভব না। অনেকে আবার মা-বাবা দ্বারা শাস্তির ফলে কষ্টের বিষয়টি অস্বীকার করে। আগে গ্রহণযোগ্য ছিল বলেই আমরা কোনো কাজ করা অব্যাহত রাখতে পারি না, বিশেষ করে আমরা যখন জানি যে তা মানুষের মর্যাদা ক্ষুণ্ন করে। কেউ কেউ শাস্তির পক্ষে যুক্তি দিতে গিয়ে বলেন, অনেক মা-বাবা খুব কঠিন পরিবেশে সন্তানদের লালনপালন করেন এবং শ্রেণিকক্ষে অধিকসংখ্যক শিক্ষার্থীর কারণে শিক্ষকেরা চাপের মধ্যে থাকেন এবং এ কারণেই তাঁরা প্রায়শ শারীরিক শাস্তি দিয়ে থাকেন। এমনটাও দেখা যায় যে বয়স্করা নিজেদের ব্যক্তিগত ও পেশাগত জীবনের হতাশা থেকে নিজেকে মুক্ত করার একটা উপায় হিসেবে শিশুদের শাস্তি দিচ্ছেন। অনেক পরিবারে ও প্রতিষ্ঠানে বড়দের আরও বেশি সহায়তা দরকার; কিন্তু তাই বলে তাঁরা নিজেদের অসুবিধার কারণে শিশুদের মারবেন বা অপমান করবেন, এটা কোনোমতেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। শিশুরা বয়সে ছোট বলে তাদের মানবাধিকার বড়দের চেয়ে কম নয়। শিশুদের শাস্তিকে যৌক্তিকতা দেওয়ার প্রবণতা বন্ধ করা প্রয়োজন। শাস্তিকে অগ্রহণযোগ্য করতে হবে। এ জন্য শিশুদের অধস্তন মনে করার সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আনা জরুরি। শিশু নির্যাতনের ক্ষেত্রে আমরা যদি নিজেদের জীবনের সমস্যা থাকাকে যুক্তি হিসেবে মেনে নিই, তাহলে শেষ পর্যন্ত আমরা এমন একটি সমাজব্যবস্থার দিকে এগিয়ে যাব, যেখানে শিশুরা আরও বেশি সহিংসতার ঝুঁকির মধ্যে পড়বে এবং তাদের অধিকারগুলো মারাত্মকভাবে লঙ্ঘিত হবে। আসুন, আমরা শিশুদের সম্মান ও মর্যাদা দিই, সব ক্ষেত্রে শারীরিক ও অবমাননাকর শাস্তি নিষিদ্ধ করে আইন প্রণয়ন করার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করি এবং শাস্তির সামাজিক গ্রহণযোগ্যতার অবসান ঘটাই।