নিজস্ব প্রতিবেদক :
লক্ষ্মীপুরে পৌর এলাকার ১২ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা মুন্নি আক্তার আড়াই লাখ টাকা ঋণ নেওয়ার আশায় সোনার চেইন বন্ধক রাখেন ‘সাউথ প্যাসিফিক বিজনেস ডেভেলপমেন্ট’ নামে একটি এনজিও সংস্থায়। জামানত বাবদ সঙ্গে ১৮ হাজার টাকাও দেন ওই এনজিওর কর্মীর হাতে। তিনদিন পর অফিসে এসে দেখেন এনজিও সংস্থার কেউ নেই। অফিসে তালা ঝুলছে। কর্মীদের মোবাইল নম্বরও বন্ধ। ঋণ দেওয়া তো দূরের কথা, মুন্নি আক্তারের মূলধন নিয়ে রাতারাতি উধাও ‘সাউথ প্যাসিফিক বিজনেস ডেভেলপমেন্ট’ নামের ওই সংস্থাটি। একইরকম পরিণতি মুন্নির প্রতিবেশী শাহিনুর বেগমের। ব্যবসা করতে ৩ লাখ টাকা ঋণের বিপরীতে আগাম জমা দেন ১৭ হাজার টাকা। এভাবে মুন্নির এলাকার ৭ জন গ্রাহকের কাছ থেকে মোট এক লাখ ৪৫ হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়েছে ওই এনজিও সংস্থার লোকজন। এদিকে ভবানীগঞ্জের চরভূতা গ্রামের নজরুল ইসলাম তার ছেলেকে বিদেশ পাঠাতে সেই এনজিও সংস্থা থেকে সাড়ে চার লাখ টাকা লোনের আবেদনের ভিত্তিতে জামানত বাবদ আগাম দেন ৩৩ হাজার টাকা। সেই টাকাও খোয়ালেন নজরুল। মুন্নি, শাহিনুর, নজরুল ইসলামের মতো এমন অন্তত তিন শতাধিক নারী-পুরুষ ঋণ নেওয়ার আশায় ওই এনজিও কর্মীদের হাতে টাকা তুলে দিয়েছেন। কেউ ধারদেনা করে, কেউ স্বর্ণালংকার বন্ধক রেখে আবার কেউ বা জমানো টাকা তুলে দিয়েছেন তাদের হাতে। সংস্থাটির কর্মীর হাতে বিভিন্ন অঙ্কের টাকা জমা দিয়ে একইভাবে প্রতারিত হয়েছেন খোদেজা, মনিকা আক্তার, হাজেরা বেগম, নুর নাহার, বকুল বেগম, আক্তার জাহান, জোসনা, রিয়াজ, আবুল কাশেম, সালেহা বেগম, ফাতেমা বেগম, শারমিন, জোৎনা, আজাদ, খোরশেদ আলম, হুমায়ুন কবির, হালিমাসহ অনেকে। এভাবেই অন্তত অর্ধকোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে সংস্থাটি হঠাৎ উধাও হয়ে গেছে বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীদের। গ্রাহকেরা জানান, আজ রোববার এবং আগামীকাল সোমাবার গ্রাহকদেরকে ঋণের টাকা তুলে দেওয়ার কথা ছিল এনজিও সংস্থাটির। কিন্তু গতকাল রোববার সকালে এসে তারা দেখতে পান এনজিওটির অফিসে তালা ঝুলছে। কর্মকর্তা এবং কর্মীদের কেউ নেই। তাদের ব্যবহৃত ফোন নাম্বারও বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। জানা গেছে, প্রায় মাস খানেক আগে লক্ষ্মীপুর পৌর এলাকার ৮ নম্বর ওয়ার্ডের গো-হাঁটা-তেরবেকি সড়কের পাশে লামচরী এলাকায় একটি ভবনের ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে ‘সাউথ প্যাসিফিক বিজনেস ডেভেলপমেন্ট’ নামীয় একটি এনজিও সংস্থা তাদের কার্যক্রম শুরু করে। ভবনের দ্বিতীয় তলায় এনজিওটির নামে একটি সাইনবোর্ড ঝোলানো ছিল। স্থানীয় লোকজন জানায়, ওই এনজিওর অফিসে ৭ জন কর্মকর্তা-কর্মী ছিল। এদের মধ্যে দুজন নারী। তারা লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে সাধারণ লোকজনকে ঋণের প্রলোভন দেখায়। গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত জামানত হিসেবে প্রতিটি এলাকা থেকে এনজিওটি কর্মীর নামে প্রতারক চক্রটি লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। গতকাল রোববার দেখা যায়, ‘সাউথ প্যাসিফিক বিজনেস ডেভেলপমেন্ট’ অফিসের সামনে শত শত গ্রাহক বিক্ষোভ করেছেন। এনজিওটির অফিস ছিল তিনতলা একটি ভবনের দ্বিতীয় তলায়। ভবনের মূল ফটকে তালাবদ্ধ দেখা গেছে। ভবনের মালিককেও পাওয়া যায়নি। পাশের এলাকায় ছিল ভবন মালিকের বাড়ি, বাড়িতে গিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি। এনজিওর নামে প্রতারকেরা গ্রাহকদের হাতে শুধুতাদের ভিজিটিং কার্ড এবং লিফলেট দিয়েছেন। তবে টাকা জমা নেওয়ার জন্য লিখিত কোনো কাগজ দেননি। ভিজিটিং কার্ডে এনজিও নাম এবং ঢাকা অফিসের ঠিকানা দেওয়া রয়েছে। ব্রাঞ্চ ম্যানেজার হিসেবে আবদুল আসাদ (রাসেল) নামে একজনের নাম রয়েছে। সেখানে তার ব্যবহৃত মোবাইলফোন নাম্বার ‘০১৩০২৬৬০১৭৮’ দেওয়া। আর প্রধান কার্যালয়ের ঠিকানায় লেখা রয়েছে হেড অফিস: ব্লক-সি, রোড নং-০৯, হাউজ নং-৪২০, কাকলী, বনানী, মিলি সুপার মার্কেট সংলগ্ন, ঢাকা-১২৩০। গ্রাহকদের কাছে দেওয়া এনজিওটির লিফলেটে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক অনুমোদিত এবং জবম. ঘড়.: ঝ ১৫৪৫/ঈ ৯২১৮৯/২২/ঈ ৭৮৪২৪/৫২’ উল্লেখ রয়েছে। এতে মো. শাহাদাত হোসেন নামে একজন মাঠকর্মী ও তার মোবাইলফোন নাম্বার (০১৯২৩৯১৩০৬৬) লেখা রয়েছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, প্রতারকরা সুকৌশলে গ্রামের সহজ-সরল নারী-পুরুষদের সঙ্গে প্রতারণা করে টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। পৌর এলাকার জেবি সড়কের বাসিন্দা ভুক্তভোগী কহিনুর বেগম বলেন, এনজিও সংস্থার একজন কর্মী আমাদের এলাকায় গিয়ে ঋণ দেওয়ার কথা বলে। তারা যে শর্তগুলো দিয়েছে, খুব সহজ মনে হয়েছে। আমাদের দোকানের জন্য আমি ৫ লাখ টাকা ঋণ নিতে আগ্রহী ছিলাম। এজন্য একহাজার ৫০ টাকা দিয়ে প্রথমে ভর্তি হই। এরপর ৫ লাখ টাকা ঋণের জন্য আগাম জামানত হিসেবে ৩০ হাজার টাকা জোগাড় রাখতে বলে। গত বৃহস্পতিবার (১৫ ফেব্রুয়ারি) ওই কর্মী আমাদের বাড়িতে গিয়ে ৩০ হাজার টাকা নিয়ে আসে। গতকাল রোববার (১৮ ফেব্রুয়ারি) আমাকে ঋণের ৫ লাখ টাকা অফিস থেকে নিয়ে আসতে বলেছে। ঋণের সঙ্গে ঋণ এবং জামানতের বইও ইস্যু করে দেওয়ার কথা বলা হয়। কিন্তু আজ (গতকাল রোববার) অফিসে এসে দেখি তারা কেউ নেই। সদর উপজেলার মান্দারী ইউনিয়নের মোহাম্মদ নগর গ্রামের বাসিন্দা আবদুল্লা বলেন, আমরা এক গ্রুপে ১২ জন সদস্য ঋণের জন্য আবেদন করি। আমাদেরকে এক হাজার ৫০ টাকা দিয়ে ভর্তি হতে হয়েছে। প্রত্যেকের কাছ থেকে ৩০০ টাকা করে নিয়েছে স্ট্যাম্প বাবদ। আর আমাদের ১০ জনের কাছ থেকে ঋণের জামানত বাবদ এক লাখ ৯৫ হাজার টাকা নিয়েছে। গত বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে একজন কর্মী আমাদের বাড়িতে গিয়ে টাকাগুলো নিয়ে আসে, গতকাল রোববার আমাদের অফিসে আসতে বলেছে। এসে দেখি কেউ নেই। একই এলাকার জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন, ৩ লাখ টাকা লোনের আশায় আমি ১৬ হাজার ৩০০ টাকা তুলে দিয়েছি। ধার করে টাকা নিয়েছি, আমাকে বলেছে আজকে ঋণ দেবে। ঋণ পেয়ে ধারের টাকা পরিশোধ করতাম। কিন্তু আমার সঙ্গে প্রতারণা করা হয়েছে। আমাদের টাকাগুলো নিয়ে তারা লাপাত্তা হয়ে গেছে। আমরা প্রশাসনের কাছে বিচার চাই। প্রতারকদের আইনের আওতায় এনে আমাদের টাকাগুলো উদ্ধার করা হোক। লক্ষ্মীপুর সদর থানার ওসি মো. সাইফুদ্দিন আনোয়ার বলেন, প্রতারণার তথ্য পেয়ে আমরা সেখানে গিয়েছি। তবে প্রতারকদের কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। লিখিত অভিযোগ দিলে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।