• সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৪:৩৭ অপরাহ্ন
সর্বশেষ
শ্রমিকদের জন্য কর্মবান্ধব পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে: স্পিকার ‘মাদক নিয়ে আমাদের অবস্থান জিরো টলারেন্স’ আইনগত সহায়তা দরিদ্র-অসহায় নাগরিকের অধিকার: আইনমন্ত্রী রোগীর প্রতি চিকিৎসকের অবহেলা সহ্য করা হবে না : স্বাস্থ্যমন্ত্রী নৌকা-জাল মেরামতে ব্যস্ত, নদীতে নামার অপেক্ষায় জেলেরা বান্দরবানে জাতীয় আইনগত সহায়তা দিবস পালিত হয়েছে সাংবাদিকবৃন্দদের সাথে মতবিনিময় উপজেলার চেয়ারম্যান প্রার্থী আব্দুল কুদ্দুছ থাইল্যান্ডের ব্যবসায়ীদের বাংলাদেশে বিনিয়োগের আহ্বান পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কৃত্রিম বৃষ্টিতে শিশু-কিশোরদের সঙ্গে ভিজলেন মেয়র আতিক বিএনপির ইতিহাসে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কোনো নজির নেই: কাদের

শিল্পকারখানায় বীভৎস অগ্নিকান্ডের ঘটনা থামছেই না

Reporter Name / ২০৩ Time View
Update : রবিবার, ৭ নভেম্বর, ২০২১

নিজস্ব প্রতিবেদক :
দেশে স্থাপিত অনেক শিল্পকারখানা, বহুতল বাণিজ্যিক ভবন, এ্যাপার্টমেন্ট যেন অগ্নিকা-ের মৃত্যুকূপ। রাজধানীর বসুন্ধরা সিটি কমপ্লেক্স, এনটিভি ভবন এবং বনানীর এফআর টাওয়ারের ভয়াবহ অগ্নিকা-ের স্মৃতি এখনও মানুষ বিস্মৃত হয়নি। এ ছাড়া পুরান ঢাকায় ঘটেছে একাধিক বীভৎস অগ্নিকা-। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে ভয়াবহ অগ্নিকা-ে মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনা আজও অনেকে তাড়া করে দুঃস্বপ্নের মতো।
পুরান ঢাকা আবার দুঃস্বপ্নের মতো অগ্নিকান্ডের মুখোমুখি হলো। এবার নিহতের তালিকায় যুক্ত হলেন পাঁচজন। এর আগে ২০১০ সালের ৩ জুন নিমতলী অগ্নিকা-ে নিহত হন ১২৪ জন, ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি চকবাজারের চুড়িহাট্টা অগ্নিকা-ে নিহত হন ৭১ জন।
সূত্র জানায়, সোয়ারীঘাটের কামালবাগে রোমানা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ নামের একটি জুতার কারখানায় বৃহস্পতিবার রাত ১টায় আগুন লাগে। ওই আগুনে পুড়ে অঙ্গার হয়েছেন পাঁচজন শ্রমিক। প্রাথমিকভাবে ফায়ার সার্ভিস জানতে পেরেছে, কারখানাটির ভেতরে রাখা রাসায়নিক (কেমিক্যাল) থেকে আগুনের সূত্রপাত।
নিহতরা হলেন বরিশালের আবদুর রহমান রুবেল (৩৫), চাঁদপুরের মনির হোসেন (৩১), কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরের মো. শামিম মিয়া (৩৫), শেরপুরের কামরুল ইসলাম (২২) এবং মানিকগঞ্জের আমিনুল (৩০)। তাঁরা সবাই ওই কারখানার শ্রমিক ছিলেন। এ দুর্ঘটনায় আরো কয়েকজন আহত হয়েছেন। নিহত ও আহতদের স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে (মিটফোর্ড) পাঠানো হয়েছে।
স্থানীয় বাসিন্দা, পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস সূত্র জানায়, বৃহস্পতিবার রাত ১টার দিকে রোমানা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ নামের জুতার কারখানার নিচতলায় বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট বা অন্য কোথাও থেকে আগুনের সূত্রপাত। সেখানে রাসায়নিক দ্রব্য থাকায় মুহূর্তে আগুন চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় কারখানার দ্বিতীয় তলায় ঘুমিয়ে থাকা শ্রমিকরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই আগুনে পুড়ে অঙ্গার হয়ে যান। ফায়ার সার্ভিসের আটটি ইউনিট সেখানে পৌঁছে দুই ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।
মরদেহগুলো উদ্ধার করে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ (মিটফোর্ড) হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়েছে। আগুনে পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাওয়ায় নিহতদের লাশ শনাক্ত করা যায়নি। ডিএনএ পরীক্ষা ছাড়া মরদেহের পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব নয় বলে জানিয়েছে সিআইডির ক্রাইম সিন ইউনিট।
সূত্র জানায়, নারায়নগঞ্জের জুতার কারখানায় অগ্নিকা- ঘটার পাশাপাশি আশুলিয়াতেও বৃহস্পতিবার রাতে একটি জুতা তৈরির কারখানায় অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটেছে। খবর পেয়ে সাভার ও আশুলিয়া ফায়ার সার্ভিসের সাতটি ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছে আড়াই ঘণ্টা চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। বৃহস্পতিবার রাত পৌনে ১২টার দিকে নরসিংহপুরের সরকার মার্কেট এলাকার পেস ইন্টারন্যাশনাল বিডি লিমিটেড নামের জুতা তৈরির কারখানায় এই অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটে।
ডিইপিজেড ফায়ার সার্ভিসের সিনিয়র স্টেশন কর্মকর্তা জাহাঙ্গির আলম বলেন, কারখানার ভেতরে কেমিক্যাল থাকার কারণে আগুন নেভাতে বেগ পেতে হয়। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, কারখানার পাশে কেমিক্যালের ময়লার স্তূপ থেকে এই অগ্নিকা-ের সূত্রপাত।
জানা যায়, বৃহস্পতিবার দুটি আলাদা জায়গায় দুটি জুতা কারখানায় অগ্নিকান্ডের ঘটনার পর শুক্রবার রূপগঞ্জে একটি টেক্সটাইল কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটেছে। আগুনে ওই কারখানায় থাকা কাপড়, সুতাসহ মেশিন পুড়ে গেছে। শুক্রবার দুপুরে উপজেলার কাঞ্চনবাজার এলাকায় এই ঘটনা ঘটে।
কাঞ্চন ও পূর্বাচল ফায়ার সার্ভিসের দুটি ইউনিট এক ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।
কাঞ্চন ফায়ার সার্ভিসের ইনচার্জ রফিকুল ইসলাম বলেন, দ্রুত আগুন নেভাতে না পারলে আশপাশে ছড়িয়ে পড়লে আরো বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হতো।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে অগ্নিকা-ে মৃত্যুর প্রধান কারণ বৈদ্যুতিক গোলযোগ বা শর্টসার্কিট। গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশে ৯৬ হাজার অগ্নিকান্ডের ঘটনা হয়েছে। এর মধ্যে শর্টসার্কিট থেকে অগ্নিকান্ডের সূত্রপাত হয়েছে ৩৫ হাজার ৫৯৮টি। অর্থাৎ অগ্নিকান্ডের ৩৭ ভাগের সূত্রপাত শর্টসার্কিট থেকে। এ সময়ের মধ্যে অগ্নিকান্ডের ঘটনায় মারা গেছে ৪৭৯ জন। এই অগ্নিকান্ডের আর্থিক ক্ষতির পরিমান ২ হাজার কোটি টাকা। শর্টসার্কিটের পর বেশি অগ্নিকা- ঘটে চুলার আগুন থেকে। আর ১৫ ভাগ অগ্নিকান্ডের সূত্রপাত সিগারেটের আগুন থেকে এবং ১৮ ভাগ অগ্নিকান্ডের সূত্রপাত হয় চুলার আগুন থেকে।
ফায়ার সার্ভিসের দেয়া প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে- গত ২০১৯ অগ্নিকান্ডের ঘটনায় মারা গেছেন ১৮৪ জন। ২০১৮ সালে মারা গেছেন ১৩০ জন। ২০১৭ সালে মারা গেছেন ৪৫ জন, ২০১৬ সালে ৫২ এবং ২০১৫ সালে মারা গেছেন ৬৮ জন। ২০২০ সালের ৪ সেপ্টেম্বর রাতে নারায়নগঞ্জের ফতুল্লায় বায়তুস সালাত মসজিদে বিস্ফোরন থেকে সূত্রপাত হওয়া অগ্নিকা-ে মারা গেছেন ২৭ জন। সর্বশেষ ঢাকার মগবাজারে গ্যাস সার্কিট ও বিস্ফোরনে মারা গেলেন ৭ জন। একই লাশের মিছিলে যোগ হল কিছুদিন আগে নারায়নগঞ্জের রূপগঞ্জের হাসেম ফুড এ- বেভারেজ। এ অগ্নিকা-ে ৫৩ জনের প্রান গেল। একই ধারা লাশের মিছিল আর পোড়া গন্ধে ও কালো ধোয়ায় তমসাচ্ছন্ন আমাদের সমাজ ও পরিবেশ।
দেশের শিল্প কারখানার পরিবেশ নিশ্চিত করতে বর্তমানে প্রচলিত ১৯৬৫ সালের কারখানা আইন অনুযায়ী প্রতিটি কারখানায় কর্মরত শ্রমিকের নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিশ্চিত করা বাধ্যতামূলক। কর্মস্থলে শ্রমিকদের নিরাপদে প্রবেশ ও বের হবার জন্য প্রতিটি কারখানার মেঝে এবং মজবুত সিঁড়ি ও চলাচল পথ রাখার জন্য মুখে নিরাপত্তামূলক ঢাকনাসহ পিট ও সুড়ঙ্গ থাকাও বাধ্যতামূলক।
আইনের ধারায় কলকারখানায় অগ্নিকান্ডের বিরুদ্ধে সতর্কতা, যন্ত্রপাতি ঘিরে রাখা, চলমান যন্ত্রের ওপরে বা নিচে কাজ না করা, বিপজ্জনক কাজে তরুণ শ্রমিক নিয়োগ না দেওয়া, স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রপাতি ও নতুন যন্ত্রপাতি ব্যবহারে বিশেষ সতর্কতা, চোখের নিরাপত্তা বিধান, ত্রুটিপুর্ন সরঞ্জাম, বিপজ্জনক ধোঁয়া ও বিস্ফোরক গ্যাস সম্পর্কিত বিধিবিধান রয়েছে। বিভিন্ন যন্ত্রপাতি ব্যবহারের ক্ষেত্রে শ্রমিকদের চলাচলের জন্য পর্যাপ্ত প্রবেশপথ, যন্ত্রপাতি ব্যবহার প্রক্রিয়া সম্পুর্ন ঝুকিমুক্ত রাখা, দুর্ঘটনা রোধে যন্ত্রপাতির নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ নিশ্চিত করা সহ বিভিন্ন বাধ্যবাধকতাও রয়েছে।
এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, শতকরা ৩৬টি কারখানার ওঠানামার জন্য ১টি সিঁড়ি আছে, ৫৬ টি কারখানায় ২টি এবং মাত্র ৮ভাগ কারখানায় ৩টি সিঁড়ি আছে। শতকরা ৫৪টি কারখানায় কোন বিকল্প সিঁড়ি নেই। আর যেগুলোতে আছে, তা অধিকাংশই লোক দেখানোর জন্য, ব্যবহারের উপযোগী নয়।
কারখানায় গ্যাস সিলিন্ডার থাকলেও ৬৫.৪% শ্রমিক জানেনা এগুলো কিভাবে ব্যবহার করতে হয়। ৪১% শ্রমিক জানে না অগ্নি নির্বাপক যন্ত্রের ব্যবহার। ২৬% কারখানার কোন শ্রমিকই আগুন নেভানোর কোন প্রশিক্ষন পায়নি। ১৬% কারখানার কোন শ্রমিকই আত্মরক্ষার প্রশিক্ষন পায় না। ১৪% কারখানায় কোন অগ্নিদুর্ঘটনা মহড়া হয় না। ৭৮% হয় কিন্তু অনিয়মিত। ৮% হয় কিনা তা শ্রমিকরা জানে না। ২০% কারখানায় অগ্নিনির্বাপক দল নেই। ছোট-বড় প্রায় ৫০ হাজার কারখানা দেখভাল করার জন্য মাত্র ৫৫ জন কারখানা পরিদর্শক আছেন, যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, মিরপুরের ৯১টি পোশাক শিল্পের মধ্যে ৮৭টিই ছিল ত্রুটিপূর্ণ।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category